শেয়ারবাজার কী নতুন ‘দরবেশের’ কব্জায়?

স্টাফ রিপোর্টার
১৫ মে ২০২৫ ১৫:০৭

স্টাফ রিপোর্টার : ১৯৯৬ সালে দেশের শেয়ারবাজারে মহাধস নামে। এরপর সেই ধস আবারও দেখা দেয় আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১০-১১ সালে। ওইসময় বিনিয়োগকারীদের আত্মহত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটে। ক্ষোভ-বিক্ষোভে দিনের পর দিন রাস্তায় প্রতিবাদ সমাবেশ করে, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এরপর আর সুখবর মেলেনি দেশের শেয়ারবাজারে। গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মূল হোতা হিসেবে মানুষ চিনতো শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান বা দরবেশ বাবাকে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর তো দরবেশবাবা জেলে, তাহলে এখন এ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে নতুন কোনো দরবেশ? নাকি পুরনো দরবেশের প্রেতাত্মারা এখনো রয়ে গেছে বাজারের অভ্যন্তরেÑ এ প্রশ্ন বাজারসংশ্লিষ্টদের। গত ১৩ মে এ রিপোর্ট যখন তৈরি হচ্ছিল, ঠিক তখনো দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মূল্যসূচকের পতনের মধ্য দিয়ে লেনদেন চলছিল।
বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। বাজারের কোনোকিছুই কাজ করছে না। তারল্যপ্রবাহে ভাটা, অব্যাহতভাবে কমছে মূল্যসূচক এবং নতুন কোনো কোম্পানি আসছে না। অর্থাৎ উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী- কোনো পক্ষেরই এ বাজারের প্রতি আস্থা নেই। সবকিছু মিলে বাজারের চরম অধঃপতন ঘটেছে। অনেকেরই প্রশ্ন, এ বাজার থাকার দরকার কী, বরং থাকলেই মানুষের ক্ষতি হয়। তাদের মতে, বাজারের এ অবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের দুর্বল নেতৃত্ব। বাজারের বিভিন্ন অংশীজন, মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিএসইসির কর্মকর্তাদেরও এ নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা।
বিনিয়োগকারীদের ১৫ দাবি : পুঁজিবাজারের স্থায়ী স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও শক্তিশালী করতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে ১৫ দফা দাবি জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। গত ১২ মে সোমবার পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জাতীয় ঐক্য ফাউন্ডেশন (ক্যাপমিনাফ)-এর পক্ষ থেকে শেয়ারবাজারকে বাঁচাতে লিখিত দাবি পেশ করা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে- এক. পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বাজারের তারল্য সঙ্কট থেকে উত্তরণে আসন্ন বাজেটে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে। দুই. পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাই বর্তমানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে ব্যাংকগুলোর সুদহার ১০ শতাংশর নিচে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিন. বিনিয়োগকারীদের স্থায়ীভাবে আস্থা ফেরানোর লক্ষ্যে বিএসইসির চেয়ারম্যান অপসারণ ও ডিএসই, সিএসই, আইসিবি, সিডিবিএল এবং সিএমএসএফ ফান্ডকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিশেষ করে বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যানকে দ্রুত অপসারণ করে যোগ্য ও পুঁজিবাজার সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে। চার. পুঁজিবাজারে বর্তমানে দ্রুত তারল্য সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে দেশীয় বড় বিনিয়োগকারী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার জন্য তাদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের (ইনসেনটিভ) পদক্ষেপ নিতে হবে। পাঁচ. শেয়ারমার্কেট ও ব্যাংক লুটকারী সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং তার বিশেষ সহযোগী শেয়ারমার্কেট খেকো ও মিউচুয়াল ফান্ড লুটকারী হাসান তাহের ইমামকে অতি দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।
ছয়. বাজারে দ্রুত তারল্যপ্রবাহের লক্ষ্যে বিএসইসির ২সিসি ধারা অনুযায়ী কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের এককভাবে ২ শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০% শেয়ার ধারণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সাত. পুঁজিবাজার উন্নয়নে সরকার কর্তৃক আইসিবিকে দেয়া ৩ হাজার কোটি টাকার ফান্ড পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের স্বচ্ছ প্রতিবেদন দ্রুত জনসম্মুখে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। আট. মিউচুয়াল ফান্ড হলো পুঁজিবাজারের প্রাণ। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের পুঁজিবাজারের ক্রান্তিকালে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো যাবতীয় সাপোর্ট অব্যাহত রাখে। কাজেই আমাদের দেশেও বাজারের বর্তমান ক্রান্তিকালে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সার্বিক সাপোর্ট অতীব জরুরি। সুতরাং মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসিকে অত্যন্ত স্বচ্ছ ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়. পুঁজিবাজারে লিস্টেড কোম্পানিগুলোর ক্যাটগরি পরিবর্তনে সম্পূর্ণ দায়স্বরূপ ইস্যু ম্যানেজার, নিরীক্ষক এবং কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের আইনের আওতায় আনা অতীব জরুরি। কেননা কোম্পানির শেয়ারদর নিম্নমুখী হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বিধায় এরূপে কোনোক্রমেই ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীদের শাস্তি (ক্ষতিগ্রস্ত করা) দেয়া চলবে না। দশ. পুঁজিবাজারে লিস্টেড কোম্পানিগুলোর কোয়ার্টারলি আর্থিক প্রতিবেদন অত্যন্ত স্বচ্ছ ও ম্যানিপুলেশনবিহীন করতে হবে এবং কোম্পানিগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড ডিভিডেন্ড প্রদানে উৎসাহিত করণের ব্যবস্থা নিতে হবে। এগারো. আসন্ন বাজেটে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর করমুক্ত আয়ের সীমা কমপক্ষে ৭ লাখ টাকায় উন্নীত করতে হবে। এবং পুঁজিবাজারে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার মার্জিন ঋণধারী অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এগুলোকে সচল করার লক্ষ্যে ১০০% সুদ সম্পূর্ণ নিঃশর্তভাবে মওকুফের ব্যবস্থা করতে হবে।
বারো. বাজারের প্রতি আস্থা ফেরানোর জন্য বিনিয়োগকারীদের করবর্ষে ৫০ লাখ টাকার অধিক অর্জিত মূলধনী মুনাফার ওপর করের হার ১৫ শতাংশর পরিবর্তে ৫ শতাংশ করারোপের সুব্যবস্থা নিতে হবে। তেরো. পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ভালো ও মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি বাজারে আনতে হবে। কোনক্রমেই দুর্বল ও ঋণগ্রস্ত কোম্পানি তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়া যাবেনা এবং বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে বাই-ব্যাক আইন দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। চৌদ্দ. বিনিয়োগকারীদের স্থায়ী আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে ইনভেস্টরস ওয়েলফেয়ার প্রটেকশন ফান্ড দ্রুত গঠন করতে হবে। একইসঙ্গে বার্ষিক এজিএমগুলো সশরীরে আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পনেরো. পুঁজিবাজারে স্থায়ী স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, ডিএসই, সিএসই, আইসিবি, বিনিয়োগকারীদের রেজিস্টার্ড সংগঠনের প্রতিনিধি, এবিবি, বিএবি, বিএমবিএ, ডিবিএ, সিডিবিএল, সিসিবিএল, বিএপিএলসি ও সিএমএসএফের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে গ্রহণযোগ্য সমন্বয় মিটিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জাতীয় ঐক্য ফাউন্ডেশনের সভাপতি রুহুল আমিন আকন্দ জানান, দীর্ঘ মন্দায় আমরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। এ মুহূর্ত্বে বাজারে অর্থ প্রবাহ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় এরকম মন্দায় সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বাজার ঠিক করেছে। আমাদের নতুন সরকারকেও সেরকম উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি।
দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ চান বিএমবিএ : শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক পতনের ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের মূলধন হারাচ্ছেন। এ অবস্থায় যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। গত ১২ মে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন মার্চেন্ট ব্যাংকাররা। মতবিনিময় সভা শেষ বিএমবিএ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিএমবিএ’র সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ নজরুল ইসলামের সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, নেতৃবৃন্দ শেয়ারবাজার স্থিতিশীল ও বিনিয়োগবান্ধব করতে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। এতে শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি; বিশেষ করে মার্চেন্ট ব্যাংকের নেগেটিভ ইক্যুইটি, আনরিয়েলাইজড লস এবং বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। অংশগ্রহণকারীরা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, চলমান বাজার পরিস্থিতিতে নেগেটিভ ইক্যুইটি একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছেন। যা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাঁচ নির্দেশনা প্রধান উপদেষ্টার : গত ১১ মে দেশের পুঁজিবাজার পরিস্থিতি উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে যমুনায় বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। ওই বৈঠকে পরিস্থিতি উন্নয়নে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, লুটপাটের মাধ্যমে শেয়ারবাজারকে বেসামাল করে দেওয়ার পেছনে গত কয়েক দশক ধরে যারা জড়িত, তাদের বিচার না হলে মানুষের আস্থা ফিরবে না। শেয়ারবাজারকে যে অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা অকল্পনীয়। এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে- যাতে এটি লুটেরাদের আড্ডাখানা না হয়ে মানুষের আস্থার জায়গা হয়ে ওঠে। প্রধান উপদেষ্টার পাঁচ নির্দেশনাগুলো হচ্ছে- এক. সরকারের মালিকানাধীন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর শেয়ার কমিয়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। দুই. দেশীয় বড় বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে প্রণোদনাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। তিন. স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি রোধে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় তিন মাসের মধ্যে পুঁজিবাজার সংস্কার। চার. পুঁজিবাজারে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ। পাঁচ. বড় ঋণপ্রবণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংকঋণনির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজার থেকে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহে উৎসাহিত করা।
যা বলছেন বিশ্লেষকরা : বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশনের ডেপুটি হেড অব নিউজ কলামিস্ট ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক মোস্তফা কামাল বলেছেন, ১২ মে সোমবার দেশের দুই পুঁজিবাজার ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়নি। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা থাকলেও দিনের শুরু থেকে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসইতে প্রধান সূচকের উল্লম্ফন দেখা যায়নি। ডিএসইতে লেনদেনের প্রথম ১০ মিনিট সূচকের ঊর্ধ্বমুখী দেখা গেলেও এরপর ব্যাপক ওঠানামা শুরু হয়। ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধে দেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল আতঙ্ক। এর ফলে দেশের শেয়ারবাজারে ঢালাও দরপতন দেখা দেয়। নমুনাদৃষ্টে প্রশ্ন উঠেছেÑ শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে দেওয়া পাঁচ নির্দেশনার মধ্যে একেবারে নতুন কী আছে? দীর্ঘদিন নয়, বছরের পর বছর শেয়ারবাজারে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন আয়োজনে এ ধরনের সুপারিশ শুনে এসেছেন। গত ৮ মাসে শেয়ারবাজার থেকে ৮০ হাজার কোটি ‘নাই’ হয়ে গেছে বলে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ। বিনিয়োগকারীদের অনেকের বড় ক্ষোভ বিএসইসির চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদকে নিয়ে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি অর্থ উপদেষ্টার পরম আত্মীয়। কারও আত্মীয় হওয়া অভিযোগ নয়। কিন্তু তার ক্ষেত্রে কেন এ অভিযোগ। এ নিয়ে বৈঠকে কোনো কথা বা আলোচনা হয়েছে কি-না, সেই তথ্য নেই। প্রধান উপদেষ্টা নিজের চোখে শেয়ারবাজারকে দেখছেন? না অর্থ উপদেষ্টার আত্মীয়ের চোখ দিয়ে দেখছেন এমন ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্নও উঠেছে। তাই প্রধান উপদেষ্টার শেয়ারবাজার নিয়ে বৈঠকটি বিনিয়োগকারীদের কতটা আস্থা ফেরাতে পারবে, এ নিয়ে ব্যাপক কথা চালাচালি হচ্ছে। শেয়ারবাজার দেশের অর্থনীতির আয়না। পৃথিবীর সব দেশ যে কারণে এমন শেয়ারমার্কেট গঠনে উদ্যোগী হয়। শ্রীলঙ্কা এটা বুঝেছিল। তাই অর্থনীতির চেহারা ফেরাতে তাদের বেশি সময় লাগেনি। আর এখানে ১৮ লাখ বিনিয়োগকারীর প্রায় ৯০ শতাংশ পুঁজিই হাওয়া। ক্রমাগত লোকসানের কারণে গত ৯ মাসে ৩০ হাজার বিনিয়োগকারী সব শেয়ার বিক্রি করে কেনাবেচার বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। ৫৭ হাজার বিনিয়োগকারী নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এ সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক এক হাজার পয়েন্টের বেশি কমেছে, যার কারণে পুঁজিবাজারের যাচ্ছেতাই অবস্থা।
সাংবাদিক ও বিশ্লেষক আবদুর রহিম হারমাছির ভাষ্য, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে সেই দরবেশেরও (সালমান এফ রহমান) পতনের পর বিনিয়োগকারীরা একটু হাঁফ ছেড়েছিল। কিন্তু বাজার পরিস্থিতি শঙ্কা জাগাচ্ছে, এক দরবেশ গিয়ে আবার কি অন্য কোনো দরবেশ আসছে? নাকি দরবেশের আসর রয়ে গেছে? তিন দশক আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে গভর্নরকে হুমকি দিয়ে এসে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিলেন সালমান রহমান। তখনই পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারিতে এসেছিল তার নাম। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টার পদ পান তিনি। বাড়ে তার ‘দরবেশী ক্ষমতা’, আর তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের গোটা আর্থিক ব্যবস্থায়। ১৯৯৩ সাল থেকে ৩১ বছরে পুঁজিবাজারে এমন কোনো কেলেঙ্কারি নেই, যেখানে সালমান রহমানের সংযোগ ছিল না। বলা হয়, কারসাজির নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি। আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে সবসময়ই থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ১৯৯৬ সালে শাইনপুকুর সিরামিক ও দোহা সিকিউরিটিজের কেলেঙ্কারিতে নাম আসে সালমান রহমানের। সেই মামলায় এখনো আসামি তিনি। মামলাটি উচ্চ আদালতে চলমান। তার কয়েক বছর পর সৌদি যুবরাজের রূপালী ব্যাংকের শেয়ার কেনার নাটক সাজিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির শেয়ার থেকে ৯০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। গত তিন বছরে পুঁজিবাজার থেকে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা প্রকাশ্যেই নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বেক্সিমকো সুকুক বন্ড ৩ হাজার কোটি টাকার, আইএফআইসি আমার বন্ড ১ হাজার কোটি টাকার এবং বেক্সিমকো জিরো কুপন বন্ড ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার।
পুঁজিবাজারে কারসাজি নিয়ে ২০১১ সালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনেও এসেছিল সালমান রহমানের নাম। ওইসময় প্রভাব খাটিয়ে বেক্সিমকো ফার্মার প্রেফারেন্স শেয়ার পাস করিয়ে নেন তিনি। এ শেয়ারের মাধ্যমে প্রিমিয়ামসহ ৪১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। একই সময়ে শাইনপুকুর সিরামিকের মাধ্যমে ২৮৬ কোটি এবং বেক্সিমকো টেক্সটাইলের মাধ্যমে ৬৩৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। পুঁজিবাজারে দরবেশের সঙ্গে তার ‘মুরীদ’ হিসাবে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতও ছিলেন আলোচনায়। অচেনা নাফিজ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী। নাফিজ সরাফাত চেয়েছেন, কিন্তু হয়নি, পুঁজিবাজারে এমন ঘটনা ঘটেনি ১৫ বছরে।
মানুষের কাছে কানাঘুষাও শোনা যাচ্ছে। পুঁজিবাজারে নাকি নতুন ‘দরবেশ’ এর আগমন ঘটেছে। তবে কে সেই নতুন ‘দরবেশ’ সেই নাম জানা যায়নি। দুই-তিন জনের নাম বলাবলি হচ্ছে। তারাই নাকি চালাচ্ছেন এখন পুঁজিবাজার। তাহলে কি বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কখনোই ‘দরবেশ’মুক্ত হবে না? বাজার তার স্বাভাবিক গতিতে ফিরবে না? লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর মধ্যে স্বস্তি ফিরবে না?