পাঠকের লেখা

দশটি ভয়াবহ কবীরা গুনাহ


৮ মে ২০২৫ ১৪:৫৩

আকতার কামাল মহসিন

ইসলামী জীবনবোধের মৌলিক ভিত্তির অন্যতম হলো- পাপ ও পুণ্য, হালাল ও হারামের সুস্পষ্ট বিভাজন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন ইবাদতের জন্য, আর সেই ইবাদতের পথনির্দেশনা দিয়েছেন কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে। ইসলাম পাপকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে- সগীরা (ছোট পাপ) এবং কবীরা (মহাপাপ)। সগীরা গুনাহ বার বার ইস্তিগফার ও তাওবার মাধ্যমে মাফ হয়ে যেতে পারে, তবে কবীরা গুনাহ ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনে- যদি না তা আন্তরিকভাবে তাওবার মাধ্যমে পরিত্যাগ করা হয়।
কবীরা গুনাহ এমন কিছু অপরাধ, যা কেবল ব্যক্তি জীবনের ক্ষতি করে না; বরং সমাজ, রাষ্ট্র এবং মানবসভ্যতার জন্যও হয়ে ওঠে এক বিষাক্ত ধ্বংসযজ্ঞ। আজ আমরা এমন দশটি কবীরা গুনাহ নিয়ে আলোচনা করবো, যেগুলো বর্তমানে আমাদের সমাজে ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। সচেতনতা, আত্মসমালোচনা এবং সংশোধনের জন্য এ বিষয়গুলো জানা ও উপলব্ধি করা আবশ্যক।
১. জোরপূর্বক চাঁদা আদায়
ক্ষমতার অপব্যবহার করে বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে কারো কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা এক নির্লজ্জ জুলুম। এটি শুধু অবিচারই নয়, বরং তা ইসলামের নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিমদের ভালোবাসেন না।” (আলে ইমরান: ১৪০)।
হাদীস: “সেই মুসলিমই উত্তম, যার হাত ও জিহ্বা থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।” (সহীহ বুখারী)।
২. বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি
বিচারের নামে পক্ষপাতিত্ব করা, মিথ্যা সাক্ষ্যে রায় দেওয়া বা ঘুষের বিনিময়ে সত্যকে চাপা দেওয়াÑ এ এক ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি, যা সমাজকে ন্যায়ের বদলে অবিচারের পথে ধাবিত করে। আল-কুরআন: “তোমরা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করো না এবং বিচারকদের ঘুষ দিয়ে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করো না।” (বাকারা: ১৮৮)।
৩. ঘুষ লেনদেন
ইসলামী শরিয়তে ঘুষ শুধু হারামই নয়, বরং ঘুষদাতা, গ্রহণকারী ও মধ্যস্থতাকারীÑ তিনজনই অভিশপ্ত ঘোষিত। হাদীস: “আল্লাহর রাসূল (সা.) ঘুষদাতা, ঘুষগ্রহীতা এবং উভয়ের মধ্যস্থতাকারীর প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন।” (আবু দাউদ)।
৪. রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ
জনগণের আমানত হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের হেফাজত করা প্রত্যেক দায়িত্বশীলের কর্তব্য। অথচ কেউ তা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করলে তা কিয়ামতের দিনে ভয়াবহ শাস্তির কারণ হবে। হাদীস: “যে ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করবে, সে কিয়ামতের দিন তা নিজের পিঠে বহন করে আসবে।” (সহীহ মুসলিম)।
৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা
রক্তের সম্পর্ক বজায় রাখা ইসলামের একটি মৌলিক আদেশ। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হন। আল-কুরআন: “আল্লাহ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের প্রতি তত্ত্বাবধানকারী।” (নিসা: ১)।
“যে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (সহীহ মুসলিম)।
৬. জুলুম ও নির্যাতন
অন্যায়ভাবে কারো ওপর জুলুম করা বা কাউকে কষ্ট দেওয়া আল্লাহর দরবারে এক চরম অপরাধ। জুলুম এক অন্ধকার, যার পরিণাম কিয়ামতের দিনে হবে ভয়াবহ। “জুলুম কিয়ামতের দিন ঘোর অন্ধকার হিসেবে প্রতিভাত হবে।” (সহীহ বুখারী)।
৭. অহংকার ও আত্মগরিমা
আল্লাহ তায়ালা অহংকারকে শুধুমাত্র নিজের গুণ হিসেবে রেখেছেন। কোনো বান্দার মধ্যে অহংকার দেখা দিলে, তা তার ঈমানের সর্বনাশ ডেকে আনে। “যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (সহীহ মুসলিম)।
৮. মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া
মিথ্যা সাক্ষ্য সমাজে অন্যায় প্রতিষ্ঠা করে, নিরপরাধকে অপরাধী বানায় এবং অপরাধীকে নির্দোষ প্রমাণ করেÑ যার ফলে মানুষের হক নষ্ট হয়। আল-কুরআন: “মিথ্যা সাক্ষ্য থেকে দূরে থাক।” (হজ: ৩০)।
হাদীস: “মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা অন্যতম কবীরা গুনাহ।” (সহীহ বুখারী)।
৯. মদ্যপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ
মদ ও মাদকদ্রব্য মানুষের বিবেক, বুদ্ধি ও আত্মাকে ধ্বংস করে দেয়। এটি শুধু শরীরেরই নয়, আত্মারও ক্ষতিসাধন করে। আল-কুরআন: “হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ধারণের তীরÑ এগুলো শয়তানের অপবিত্র কাজ; সুতরাং এগুলো থেকে দূরে থাকো।” (মায়েদা: ৯০)।
হাদীস: “যে ব্যক্তি মদ পান করে, তার চল্লিশ দিনের নামাজ কবুল হবে না।” (সহীহ মুসলিম)।
১০. ডিজিটাল জুয়া ও গেমিং অ্যাপস
আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যুগে মোবাইল ও কম্পিউটারে টাকা-পয়সা লেনদেন করে জুয়াভিত্তিক গেম খেলা এক নতুন রূপে গুনাহের বিস্তার। এটি তরুণ সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আল-কুরআন: “এসব শয়তানের কাজ; সুতরাং এগুলো থেকে দূরে থাকো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।” (মায়েদা: ৯০)।
এ ভয়াবহ কবীরা গুনাহসমূহ আজ আমাদের সমাজে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। এগুলো কেবল ব্যক্তি চরিত্রের ক্ষয় সাধন করে না, বরং সমাজকে করে তোলে অশান্তির আঁতুড়ঘর, অন্যায়ের অভয়ারণ্য। এ অবস্থায় প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব- আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে কলুষমুক্ত রাখা, পরিবারে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা এবং সমাজে সত্য ও ন্যায়ের পতাকা উড্ডীন রাখা।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবীরা গুনাহ থেকে রক্ষা করুন, হৃদয়ে ঈমানের আলো জ্বালিয়ে দিন এবং হালাল-হারামের পার্থক্য বুঝে জীবন পরিচালনার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : স্টাফ, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম।