গড়াই নদীর নাব্য ফেরানোর চেষ্টা প-শ্রম
১ মে ২০২৫ ২২:৫৪
কুষ্টিয়া সংবাদদাতা : কুষ্টিয়া শহরের কোলঘেঁষে বয়ে গেছে গড়াই নদী। এটি পদ্মার অন্যতম শাখা নদী। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া ও সদর উপজেলার হরিপুরে এ নদীর উৎসমুখ। পাশ্ববর্তী ঝিনাইদহ ছাড়াও মাগুরা, যশোরসহ কয়েকটি জেলা হয়ে সুন্দরবন, দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে নদীটি। বনে মিঠাপানি সরবরাহ, লবণাক্ততা কমানো, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নদীটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গেও এর সম্পর্ক অনেক গভীর। কিন্তু দখল, দূষণ আর ভরাটে নাব্য হারিয়ে অনেক স্থানে পড়েছে চর। কিছু স্থানে সরু খালের মতো পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
একসময়ের প্রমত্ত নদীটির নাব্য ফেরাতে টানা সাত বছর ধরে খননকাজ চলছে। এরপরও শুষ্ক মৌসুমে অনেক স্থানে গড়াই নদীতে পানি নেই। বর্ষায় উজান থেকে আসা পলি জমে পানিপ্রবাহ নেই কুষ্টিয়ার অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ এ নদীটিতে। খননের পরও উৎসমুখ থেকে শুরু করে পাঁচটি স্থানে জেগে উঠেছে চর। সুন্দরবনে মিঠাপানির সরবরাহ বাড়ানো ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নদীটি বাঁচাতে নতুন পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে মত গবেষকের।
সরেজমিন নদীর হরিপুর সেতুর পূর্ব পাশের এলাকায় দেখা গেছে, বড় অংশজুড়ে চর পড়েছে। মানুষ হেঁটেই পার হচ্ছেন। অনেকে গোসলসহ কাপড় ধোয়ার কাজ করছেন জমে থাকা অল্প পানিতে।
স্থানীয় বাঁধ এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলামের ভাষ্য, এবার বেশি চর পড়েছে, পানি কমেছে। কোনোরকমে গোসল করা যাচ্ছে।
শেফালী খাতুন নামে এক গৃহবধূ বলেন, আমরা বাঁধে থাকি। নদীর পানি দিয়ে সব কাজ করি। পানি একেবারে কমে গেছে। আগে বড় নৌকা ও ট্রলার চললেও এখন ছোট নৌকা চলে। মাছও পাওয়া যায় না।
নদী সারা বছর সচল রাখা ও পানিপ্রবাহ বাড়াতে টানা কয়েক বছর ধরে চলছে খননকাজ। এরপরও চর জেগে ওঠায় স্বাভাবিক গতি ফেরেনি। এতে নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবিকায় টান পড়েছে। বড় চর পড়েছে তালবাড়িয়া-হরিপুর উৎসমুখ, রেনউইক বাঁধ, ঘোড়াইঘাট, মাসউদ রুমী সেতু ও কুমারখালী এলাকায়। এরই মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীন গড়াই খনন প্রকল্পের কাজও চলমান।
পাউবো জানিয়েছে, চলতি বছর নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকা খনন করে ৪৪ দশমিক ৫৮ লাখ ঘন কিউসেক বালু অপসারণ করা হবে। ২০১৮ সালে শুরু হয় খননকাজ। সাত বছর মেয়াদি প্রকল্প শেষ হবে চলতি বছরের জুনে। এতে খরচ হচ্ছে প্রায় ২৩২ কোটি টাকা।
প্রকল্পের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শুরু হয় প্রকল্পের কাজ। ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ছিল এটির মেয়াদ। এরপর দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৪-২৫ পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রায় ৪ কোটি ১৬ লাখ কিউসেক ঘনমিটার বালু উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। এ পর্যন্ত ৩ কোটি ৯২ লাখ কিউসেক ঘনমিটার উত্তোলন করা হয়েছে। প্রকল্পের শুরুর দিকে বালু ব্যবস্থাপনা, খননে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরপর নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।
খননের পরও পানিপ্রবাহ না বাড়া, ড্রেজিংয়ের বালু ব্যবস্থাপনায় সঠিক পরিকল্পনা না থাকাসহ নানা অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সে সময় পাউবো নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে। উৎসমুখে ৩৫০ মিটার চওড়া ও পানির উপরিভাগ থেকে পাঁচ মিটার গভীর করে খনন শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে তা কমে ১২০ মিটার চওড়া ও তিন মিটার পর্যন্ত গভীর করে খননকাজ চলছে। এতে নদীতে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকলেও সরু খালে পরিণত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নদীতে যাত্রী পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করেন জসিম উদ্দিন। খননের পরও গরমের সময়ে এসে খুব একটা সুবিধা মিলছে না বলে অভিযোগ তার। তিনি বলেন, আমরা কষ্টে আছি। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা থেকে ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পানি নদীতে পড়ছে। এতে দূষণ বাড়ছে। এ পানিতে গোসল করে শরীরে ঘা, পাঁচড়া হচ্ছে অনেকের।
গড়াই নদীর সঙ্গে কুষ্টিয়াসহ আশপাশের জেলার মানুষের গভীর সম্পর্ক। এ নদী বাঁচাতে নতুন পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষকরা। আগের ভুলত্রুটি ও অনিয়ম-দুর্নীতি শুধরে নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল কুষ্টিয়ার সভাপতি খলিলুর রহমান মজু। তিনি বলেন, গড়াই খনন করেও শুষ্ক মৌসুমে তেমন সুবিধা মিলছে না। এর সঙ্গে সুন্দরবনের সম্পর্ক আছে, নদীটি বাঁচিয়ে রাখতে হবে। পদ্মায় পানি কমায় গড়াইয়ে প্রভাব পড়ছে। দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পাওয়া যায়, এমন প্রকল্প হাতে নিলে সুন্দরবনসহ এ অঞ্চলের মানুষের জন্য ভালো হবে।
চলতি বছর নদী ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গড়াই খনন প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈকত বিশ্বাস। তিনি বলেন, বর্ষায় কয়েকটি পয়েন্টে লাখ লাখ কিউসেক ঘনমিটার বালু পড়ে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।