নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

বাতিল করে কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে, সংখ্যাগুরুর বিশ্বাসের প্রতিফলন নেই


২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:৫৩

॥ এডভোকেট শাহানারা স্বপ্না॥

কয়েকজন নারী ‘নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন’ নামে প্রধান উপদেষ্টার বরাবর ৪৩৩টি প্রস্তাবনাসহ ১৫টি সুপারিশ পেশ করেছে। প্রায় দুইশ’ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে রয়েছে ১৭টি অধ্যায়। দেশের পুরো নারী সমাজকে বাদ দিয়ে স্বল্প শতাংশ নারী কি এ ধরনের সংস্কার আনতে পারে? পত্রিকায় প্রদর্শিত এসব নারীর একজনও কি বাংলাদেশের বৃহত্তর নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে? করলেও কত শতাংশ? একটি জাতীয় কমিশন গঠিত হবে সকল শ্রেণি-পেশার নারীদের অন্তর্ভুক্তি ও মতামতের ভিত্তিতে। জাতীয় নারী কমিশনের কা-ারিদের হতে হবে প্রাজ্ঞ ও বিজ্ঞজন এবং সমাজনীতি, রাজনীতি, ঐতিহ্য, ধর্ম, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ের ওপর পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানসম্পন্ন। তাদের থাকতে হবে সর্বজনগ্রাহ্য গ্রহণযোগ্যতা। সুপারিশমালায় থাকতে হবে দেশের সব নারীর বোধ-বিশ্বাস ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। কতিপয় জনবিচ্ছিন্ন নারী কি করে পুরো নারী সমাজের মুখপাত্র হতে পারে? তাদের যোগ্যতার মাপকাঠি কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে… এটি একটি জরুরি প্রশ্ন।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা আসলে পশ্চিমাদের অন্ধ অনুসারী একটি বিশেষ শ্রেণির নারীদের মতামত ও ধ্যান-ধারণা ছাড়া আর কিছু নয়; যার সাথে দেশের সাধারণ নারীদের কোনো সম্পর্ক নেই। দীর্ঘদিন ধরেই তারা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক মূল্যবোধ ও পরিবারব্যবস্থা ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বৃহত্তর নারী সমাজের সমস্যা, সুবিচার যৌতুক নিরোধ, আইনের সুফলতা প্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে তারা নীরব। শুধুমাত্র নারীর ‘শরীর’ ও ‘শাড়ি’ বাণিজ্যে তারা তৎপর!
আমাদের দেশের পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ ইসলামের অনুসারী। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বেশি নারী। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাসই নারী কমিশনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হওয়া উচিত। কিন্তু এ কমিশনের সুপারিশমালায় দেখা যাচ্ছে দেশের ৯৫ শতাংশ নারীকে অবজ্ঞা করে ক’জন ভুঁইফোঁড় নারী অন্য দেশের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও ধর্মবহির্ভূত কর্মকা- সমাজের সাধারণ নারীদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এতে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। এসব সুপারিশ শুধুমাত্র ইসলামী শরিয়াহর সঙ্গেই সাংঘর্ষিক নয়, বরং ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সাংবিধানিক অধিকারের বিরুদ্ধেও হুমকিস্বরূপ।
এ সংস্কার কমিশন ধৃষ্টতাপূর্ণভাবে পরিবারের সুদীর্ঘকালের চেইন অব কমান্ড ভেঙে ফেলতে চায়, যার ফলে সৃষ্টি হবে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। বিশৃঙ্খলার সুযোগে সমাজে অস্থির ও অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করা গোপন ষড়যন্ত্রের নীলনকশা। আল্লাহর বিধান মতে, নারী তার পিতার সম্পত্তিতে অর্ধেক সম্পত্তি পাবে। যদি সমান সম্পত্তিই পিতার সম্পত্তিতে নারী প্রাপ্য হয়, তবে পুরুষ কেন দেনমোহর আদায় করবে? ভরণপোষণ বা পারিবারিক দায়িত্ব কেন নেবে? কেন বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করবে? সমাজের স্থিতিস্থাপকতা বিনষ্টকারী এসব সুপারিশ অবশ্যই পরিত্যাজ্য। আমাদের সমাজে প্রচলিত পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সহানুভূতি, প্রীতিময় পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার এ এক সুগভীর ষড়যন্ত্র।
বাংলাদেশ এখনো ঈঊউঅড সনদের ধারা ২ ও ১৬ (১) (গ) সংরক্ষিত রেখেছে, যেখানে বিবাহ, তালাকসহ পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পূর্ণ সমতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ কমিশন সেই সংরক্ষণ বর্জন করার সুপারিশ করেছে, যা বিস্ময়কর। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের ওপর পদাঘাত হেনে এ ধরনের সুপারিশ কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন মুসলমানের পক্ষে আল্লাহর আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যেখানে দেশের অধিকাংশ নারী ধর্মপরায়ণ, সেখানে কাদের প্রতিনিধি হয়ে এ সুপারিশগুলো করা হচ্ছে? সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না করে যারা এ ধরনের সুপারিশ করছে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়া স্বাভাবিক।
আমাদের দেশে নারীরা বিভিন্ন অবহেলার শিকার হচ্ছেনÑ এটা ঠিক। তবে কমিশন এ অবহেলার জন্য দায়ী করেছে ‘ধর্মীয় আইন অনুসরণ বাধ্যতামূলক হওয়ায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হন’! কি বেকুবের মতো কথা! ধর্ম সম্পর্কে এদের ন্যূনতম জ্ঞানটুকুও নেই যে, তারা জানেই না পৃথিবীতে ইসলামই প্রথম মানবাধিকার সনদ রচনা করেছিল এবং নারীমুক্তির জন্য একটি ব্যালেন্সড রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল। ইসলাম অবশ্যই নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করে না, কিন্তু তাদের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য ও দায়িত্ব অনুযায়ী ভিন্নতা স্বীকার করে। এটাই ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।
না জেনেই কেন তারা মুসলিম পারিবারিক আইনকেই বার বার দায়ী করছে? এর পেছনে সুদূরপ্রসারী কী মতাদর্শ লুকিয়ে আছে? সংস্কার কমিশনের সদস্যরা আসলে কোন শ্রেণি বা চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করছে?
তাদের কিছু সুপারিশের বিষয়ে পর্যালোচনা করা যাক
১. ধারা ৩.২.১.১, ১২.৩.১.১ (জ) ও ১২.৩.২.৩-এ যৌনকর্মীদের সুরক্ষা ও শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে। পতিতাবৃত্তি করতে উৎসাহ দিতে পতিতাদের শ্রমিক হিসেবে সম্মান দিতে চায়? অথচ এ বিপাকের পথে আসা নারীদের পুনর্বাসন এবং অত্যাচারের ঝুঁকি সম্পর্কে কিছুই বলা নেই!
২. ধারা ৩.২.২.১.২-এ বিবাহ বলা হয়েছে বিচ্ছেদের সময় মোহরানা আদায় করতে। কি হাস্যকর! তারা এটুকু জানে না যে, মুসলিম বিয়েতে মোহরানা বিয়ের সময়ই পরিশোধ করার নিয়মÑ অজ্ঞতার চূড়ান্ত লেভেল যাকে বলে!
৩. ধারা ৩.২.২.১.১১ ও ৩.২.৩.১.১-এ সকল ধর্মের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব এসেছে, যা আমাদের সমাজের বহুধর্মীয় বাস্তবতাকে সরাসরি অস্বীকার করেছে। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সবাইকে পারিবারিক বিষয়ে ‘আইনগতভাবে ধর্মত্যাগ’ করতে উৎসাহিত করা হবে। পরবর্তীতে একে বাধ্যতামূলক বানানো হবে এবং এর মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা ভাঙা উসকে দেয়া হবে।
এভাবে তারা প্রতিটি বিষয়ে নিজেদের অজ্ঞতা, অবিমৃশ্যকারিতা, দেশ ও নারীর সম্মানবিরোধিতার পরিচয় দিয়েছে। এ কমিটিতে শিক্ষা-সাহিত্য-ধর্ম-সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে জাতীয় ব্যক্তিত্ব কতজন রয়েছেন? যদি না থাকে তবে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু প্রণয়ন করার স্পর্ধা তারা কোথায় পেলেন?
এই কমিটির অসারতা সম্পর্কে একজন অ্যাক্টিভিষ্ট চমৎকার মন্তব্য করেছেন, “এই কমিটির কেউ কি নীরা ইউভালের লেখা ‘জেন্ডার এন্ড ন্যাশন’ বইটা পড়ে নাই? পড়লে এইরকম একটা ‘মেয়েলি’ কমিটি গঠন করার প্রতিবাদ করে নাই কেন? আই মীন- একদম পদে পদে এইরকম ইম্পেরিয়ালিস্ট/ সেক্সিস্ট/ এক্সক্লুশনারি এপ্রোচ নেয়া একটা কমিটি… আমি সত্যি বাকরুদ্ধ!”
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এমন কিছু প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, যা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুকৌশলে আঁকা হয়েছে পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে উদ্দাম অশ্লীল যৌনতাকে প্রমোট করার গভীর নীলনকশা। এসব সুপারিশের মাধ্যমে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও জীবনধারার ওপর আঘাত হানবে এবং জাতীয় ঐক্য ও সামাজিক স্থিতির জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই এ সুপারিশগুলো অবিলম্বে বাতিল করতে হবে এবং নারী কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে, যেখানে সকল ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
তাই অবিলম্বে অজ্ঞতাপ্রসূত ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধবিবর্জিত এ প্রতিবেদন বাতিল করা হোক। মানহীন চরম বিতর্কিত এ কমিশনের বিলুপ্তি চাই। বাংলাদেশের মূলধারার নারী ও সকলের চিন্তা-চেতনা এবং সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষকে নিয়ে নারীবিষয়ক নতুন সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছি।