বাংলায় বিভিন্ন ভাষার বানান
১৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:৪৯
॥ ওবায়েদ ইবনে গনি ॥
বাংলা বানানে সমতা আনার লক্ষ্যে ভাষাবিজ্ঞানী ও ভাষাপ্রেমিকরা অনেক চিন্তাভাবনা ও লেখালেখি করেছেন এবং করছেন। কিন্তু তারপরও বাংলা বানানে সমতা আসেনি। এটা আমরা যারা বাংলা ভাষা ব্যবহার করি, তাদেরই সচেতন না থাকার ফল। বাংলা বানানে ঐক্য আনার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে একটি নিয়মের প্রবর্তন করে। তারপর থেকে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সট বুক বোর্ড (১৯৮৮), বাংলা একাডেমি (১৯৯২) এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি (১৯৯৫) বিভিন্ন সময় বানান প্রমিতকরণের জন্য নানা উদ্যোগ নেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৩৬ সালে বানান সংস্কার থেকে টেক্সট বুক বোর্ডের ১৯৮৮ সালের বানান সংস্কারের মধ্যবর্তী সময়ে বানান সংস্কারের উদ্যোগ যে নেয়া হয়নি, তা নয়- কিন্তু সেগুলো নানা জটিলতার কারণে সফল হয়নি। বানান প্রমিতকরণের যে প্রস্তাব প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েছে, তা যে একটির সাথে অপরটি সম্পর্কহীন, তা কিন্তু নয়। এরপরও বাংলা বানানে শৃঙ্খলা আসেনি। এর কারণ হলো, আমরা মোটেও সচেতন নই।
এ অসতর্কতা বহুল পরিমাণে দেখা যায় বাংলায় ব্যবহৃত আরবি, ফারসি, উর্দু ও তুর্কি শব্দের বানানের ক্ষেত্রে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মুসলমানদের আগমনের পর থেকে আজ পর্যন্ত শত শত বছর কেটে গেলেও এ শব্দগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিন্নতা আসেনি। অবাক ব্যাপার হলো, এ শব্দগুলোর বিশৃঙ্খল বানান ব্যবহৃত হলেও এর সমতা বিধান করার তেমন একটা উদ্যোগও নিতে দেখা যায় না। এ দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল ইসলামিক ফাউন্ডেশনের, কিন্তু তারা এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলেও তা সার্থক হয়নি। ফলে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি, ফারসি, উর্দু, তুর্কি শব্দ ব্যবহারে নৈরাজ্যের অবসান ঘটেনি। আরো অবাক ব্যাপার হলো, এ সম্পর্কিত ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তার ছাপও হতাশাজনক। অথচ প্রতিদিন সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক কারণে অসংখ্য আরবি, ফারসি ও উর্দু শব্দ আমাদের ব্যবহার করতে হয়। তাই এসব শব্দের অবিকল্প বানান নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন।
কিন্তু এ কাজ করতে গেলে আমাদের কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। আরবি, ফারসি, উর্দু ও তুর্কি শব্দের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের একটি আবেগের সম্পর্ক রয়েছে। তাই বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান যখন এগুলোকে ‘বিদেশি’ শব্দ আখ্যা দিয়ে এ সম্পর্কে বিধান জারি করতে যায়, তখন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতির সাথে তা অনেক সময় সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। মুসলমানদের অনেকেই এ শব্দগুলোকে বিদেশি বলতে নারাজ। তাদের যুক্তি হলো, সংস্কৃত যদি অন্য ভাষা না হয়, তাহলে এগুলোকে বিদেশি বলার হেতু কী? বাংলা একাডেমির বাংলা বানানের নিয়ম এক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার কারণ হলো, তারা এ অনুভূতিকে উপলব্ধি করতে পারেননি। তাছাড়া এ শব্দগুলো যারা বহুল পরিমাণে ব্যবহার করেন তারা খুব একটা বেশি এর বানানরীতি সম্পর্কে সচেতন নন। এক্ষেত্রে অশিক্ষা ও সংস্কারও দায়ী। আমাদের অভিমত- এ দুটির মধ্যে সমন্বয় হওয়া দরকার, তাহলেই সফলতা আসার সম্ভাবনা। আবার ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের অতিরিক্ত ভাবাবেগও এ নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। অথচ একটু যুক্তিশীল ও সচেতন হলেই এ সমস্যা এড়ানো সম্ভব।
এ শব্দুগুলোর বানান বিভিন্নতার কারণ নিম্নোক্তভাবে নির্দেশ করা যায়- (ক) মাখরাজ (উচ্চারণ স্থান) অনুযায়ী বানান লেখার প্রবণতা, (খ) মূল ভাষার জ্ঞানের অভাব, (গ) নতুনত্বের প্রতি আকর্ষণ এবং (ঘ) বানানের দর্শনগ্রাহী রূপকে গুরুত্ব না দেয়া। এসব কারণে এ শব্দগুলোয় বানানের সমতা তো আসছেই না, বরং দিন দিন এর অনিয়ম বাড়ছেই। বিশৃঙ্খলা যে বাড়ছে, সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’ নামক বহুখণ্ডে রচিত গ্রন্থটির পাতা খুললেই। এ বইয়ের সম্পাদনা পর্ষদ আরবি, ফারসি ও উর্দু শব্দের বানান নিয়ে যে স্বেচ্ছাচারের নমুনা এখানে উপস্থিত করেছে, তা কোনোক্রমেই সমর্থন করা যায় না। তারা মূলত আসল ভাষার উচ্চারণরীতিকে অবিকৃত রাখার জন্যই এ অভিনব ঘটনার প্রকাশ ঘটিয়েছে। অথচ পৃথিবীর বহু প্রধান ভাষায় উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লেখা হয় না, এটা যে তারা জানত না, তা নয়।
প্রত্যেক শব্দের একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ আছে। এর গুরুত্ব অনেক। বাংলা ভাষায় এরকম অজস্র শব্দ আছে, যা ব্যাকরণের বিশ্লেষণে ভুল কিন্তু ভাষায় বহুল ব্যবহৃত। শুধু ব্যাকরণের ভুলের কারণেই সেসব শব্দকে বাদ দেয়া যায় না। আরবি শব্দের বানান হয়তো মূল উচ্চারণ থেকে খানিকটা বিকৃত হয়ে বাংলায় এসেছে এবং এত বেশি ব্যবহৃত যে তার মূল রূপটি আর আমাদের দরকার নেই। তা বাংলায় এসে বাঙালি হয়েই বাংলা ভাষার সাথে মিশে গেছে। বাংলা ভাষায় অনেক ধর্মীয় পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে এসব পত্রিকার আরবি, ফারসি, উর্দু ও তুর্কি শব্দের বানানে খুব একটা সাম্য নেই। হাতের কাছে এ মুহূর্তে কোনো ইসলামী পত্রিকা (পাঠককে বিশেষভাবে ‘ইসলামী’ বানানটি লক্ষ করার জন্য বলছি) না থাকায় তার দৃষ্টান্ত দেয়া গেল না। দিতে পারলে বোঝা যেত পরিস্থিতি কী নাজুক!
সচেতন ভাষাপ্রেমিকমাত্রই একমত হবেন- এ বিশৃঙ্খল অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। আর এর জন্য প্রয়োজন আমাদের সদিচ্ছা। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমির বানানরীতি সর্বান্তকরণে না হলেও মোটামুটি মেনে চলা দরকার। এ কথা ঠিক, বাংলা একাডেমি আরবি, ফারসি তথা বিদেশি শব্দের বানানের ব্যাপারে যে নিয়মাবলি বেঁধে দিয়েছে, তার সাথে সর্বক্ষেত্রে একমত হওয়া যায় না। কিন্তু বানানের নৈরাজ্য এড়ানোর জন্য আমাদের তা অনুসরণ করা ছাড়া উপায় থাকে না। আরবি, ফারসি শব্দের বানানের ক্ষেত্রে অনেক সময় আমরাও বাংলা একাডেমির সাথে একমত নই। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে ‘ইসলামী’ বানানটির কথাই ধরা যাক। সেই ছোটবেলা থেকেই শব্দটি আমরা ‘ী-কার’ দিয়ে লিখে আসছি। এ শব্দের একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে গেছে।
বাংলা একাডেমির নিয়মানুযায়ী যদি এখন তা ‘-িকার’ দিয়ে লিখতে যাই, তাহলে তার ভিজুয়াল ইমেজটি নষ্ট হয়। শুধু তাই নয়, ‘ী-কার’ দিয়ে শব্দটির যে প্রসারতা, যে বর্ণাঢ্য ও বিশালত্বের ছবি আমাদের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে, তা ‘-িকার’ দিয়ে পাওয়া যায় না। তাই ‘ইসলামী’ শব্দটি আমরা ‘ী-কার’ দিয়েই লেখার পক্ষপাতী। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা যায়। এসব প্রতিষ্ঠানের নাম এখন ‘-িকার’ দিয়ে লিখতে গেলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। একটি ‘-িকারের’ জন্য তাদের অসংখ্য শাখার সাইনবোর্ড নতুন করে তৈরি করতে হবে। একইভাবে ‘জাহাঙ্গীরনগর’ শব্দটির প্রসঙ্গ আমরা আনতে পারি। আমরা জানি, এ নামে আমাদের দেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়টির নামের ‘ী-কার’ পরিবর্তন করে ‘-িকার’ করতে হলে বহু প্রশাসনিক জটিলতা সামনে আসবে।
এক্ষেত্রে অবশ্য বিকল্পের কথা আমরা ভাবতে পারি। কিন্তু সেটাও কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আসলে তাড়াহুড়া করে বানানের সাম্য ফিরিয়ে আনাও অসম্ভব। তবে এসব ক্ষেত্রে আমরা এভাবে সিদ্ধান্তে আসতে পারিÑ পুরনো যেসব স্থায়ী বানান ‘ী-কার’ দিয়ে লেখা হয়েছে বা হচ্ছে, তা আমরা ‘ী-কার’ দিয়েই লিখব, কিন্তু নতুন করে লিখলে ‘-িকার’ ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু কিছু শব্দ আমরা কখনোই ‘-িকার’ দিয়ে লিখব না। যেমন ‘ইসলামী’ শব্দের ‘ী-কার’। ‘আরবি’ শব্দের আধুনিক বানানে ‘-িকার’ নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে, তবু ‘আরবি’ বানানে আমরা বাঙলা একাডেমির ‘-িকার মেনে নিয়েছি। কিন্তু ‘ইসলামী’র ‘ী-কারের’ যে ভিজুয়াল ইমেজ ‘-িকার’, তা একেবারে নষ্ট করে ফেলে। যেমন ফেলে চীন দেশটির বানান ‘-িকার’ দিয়ে লিখলে।
এ আলোচনায় শব্দগুলোর প্রচলিত অধিকাংশ বানান থাকবে, কিন্তু যে বানানটির প্রতি আমাদের পক্ষপাত তা ভুক্তিতে প্রথমে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্য বানানের ভুক্তিতে থাকার অর্থ এটা নয় যে, সেগুলোকে আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি; বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বিশৃঙ্খলার পরিমাণটা পাঠকদের দৃষ্টিগোচরে আনা এবং বাকি বানানগুলোকে বর্জন করে একটি বানানরীতিকে গ্রহণ করা। তবে সমতা বিধানের ক্ষেত্রে আমরা বাংলা একাডেমিকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করব। আর একাডেমির কিন্তু বানানের সাথে দ্বিমতও এখানে পোষণ করে একটি সিদ্ধান্ত দেয়া হবে। তাছাড়া অবিকল্প বানানটি কেন আমরা গ্রহণ করব তার একটি যুক্তি যাচাই করে দেখব। এসব কিছুর উদ্দেশ্য হলো, বাংলা ভাষায় প্রচলিত আরবি, ফারসি, উর্দু ও তুর্কি বানানের সমতা বিধানের জন্য পাঠক এবং ব্যবহারকারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করা। আশা করব, এ মহৎ উদ্যোগের দিকে আরো প্রাজ্ঞজনরা এগিয়ে আসবেন।
কুরআন, কোরআন, কুরান, কোরান- এর মধ্যে কুরআন ও কোরআন বানানই অধিক প্রচলিত। যারা ‘ক’তে ‘ও-কার’ দিয়ে লেখেন তাদের অভিমত হলো ‘উ-কার’ দিয়ে লিখলে ‘কু’ হয়ে যায়। বাঙলায় ‘কু’ উপসর্গটি খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হয়। আমাদের অভিমত হলো কুরআন শব্দটি আরবি। বাংলা ‘কু’ উপসর্গের কথা এখানে অবাস্তব। তাছাড়া কুরআনের ‘কু’কে কেউ খারাপ অর্থে ব্যবহার করেন বলে আমাদের জানা নেই। বরং ‘উ-কার’ দিয়ে লিখলে সেটি মূলের কাছাকাছি থাকে। তাই অন্য বিকল্প বাদ দিয়ে ‘কুরআন’ লেখাই উচিত।
ইবরাহিম, ইব্রাহিম, ইবরাহীম- এক্ষেত্রে প্রথম বানানটিই ব্যবহার করা উচতি। মুহাম্মদ, মুহম্মদ, মোহাম্মদ, মহম্মদ- এখানে প্রথম বানানটি মূলের কাছাকাছি এবং অধিক প্রচলিত, তাই এটির ব্যবহারই প্রচলন হওয়া দরকার। (সা.), (স.), (সাঃ), (সঃ), (ছাঃ), (ছঃ), (দঃ)- এগুলোর সবই সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংক্ষিপ্ত রূপ। এখানে (সা.) লেখাই উচিত। একই রীতি অনুসরণ করা উচিত আলাইহি ওয়া সাল্লাম, রাদিয়াল্লাহু আনহু ও রহমাতুল্লাহ আলাইহি লেখার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ লেখা হবে (আ.), (রা.), (রহ.)। ঈদুল ফিতর, ঈদুল ফেতর, ঈদ-উল ফিতরÑ প্রথম বানানটি ঝামেলামুক্ত। তাই এভাবেই লেখা উচিত। একই কথা প্রযোজ্য ঈদুল আজহার ক্ষেত্রেও।
এখানে আরো কিছু শব্দের কথা বলা যাক, যেগুলোর প্রথম বানানটিই অগ্রাধিকার পাবেÑ শরীফ, শরিফ; আহমদ, আহমাদ, আহমেদ; খলিফা, খলীফা; সাঈদ, সাইদ, সায়ীদ, সয়ীদ; মদিনা, মদীনা’ মাদরাসা, মাদ্রাসা; ওলি, অলি, অলী; আউলিয়া, আওলিয়া; শহীদ, শহিদ; আলী, আলি; ওমর, উমর; ইমাম, ঈমাম; সুফি, সূফী; গাজ্জালী, গাজ্জালি; ঈসা, ইসা; মূসা, মুছা; ইসমাইল, ঈসমাইল; দাউদ, দায়ুদ; ফজর, ফযর; জোহর, যোহর; আসর, আছর; আজরাইল, আযরাইল; আজাজিল, আযাযীল ইত্যাদি। আমরা সতর্ক হলেই এসব ভাষার বানানের ক্ষেত্রে যে অনৈক্য রয়েছে, তা অপনোদন হবে। এজন্য চাই সবার সচেতন প্রয়াস।
লেখক : সাংবাদিক।