সোনালি অতীত : নানা পেশায় নারী


১৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:৩২

॥ আতাউর রহমান খসরু ॥

ইসলামের সোনালি যুগ থেকেই নারীরা আর্থসামাজিক উন্নয়নের অংশীদার হয়েছেন। বিচিত্র পেশায় অংশ নিয়ে সমাজে অবদান রেখেছেন। রাসূল (সা.)-এর যুগ থেকে হাজার বছরের মুসলিম শাসনের ইতিহাসে নারীরা জ্ঞানচর্চা, সমাজসেবা ও অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা লাভ করেছেন এবং পুরুষদের মতোই যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। তবে হ্যাঁ, পর্দা-শালীনতা ও ইসলামের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি তারা অবশ্যই মান্য করেছেন।
জ্ঞানচর্চা : মহানবী (সা.) বিভিন্নভাবে নারীদের জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং সুযোগ দিয়েছেন। মদিনার নারীরা একবার রাসূলের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘পুরুষরা আপনার কাছে আমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। তাই আপনি আমাদের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করে দিন। তিনি তাদের বিশেষ একটি দিনের অঙ্গীকার করেন; সেদিন তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং দিকনির্দেশনা দিলেন।’ (সহিহ বুখারি)।
রাসূলের যুগে অনেক প্রাজ্ঞ নারী সাহাবি ছিলেন। নবীপত্নী আয়েশা (রা.)-এর জ্ঞানের কাছে তো অনেক অভিজ্ঞ সাহাবীও হার মেনেছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের অসামান্য অবদান নিয়ে ৪৩ খণ্ডের বিশাল এক বিশ্বকোষ রচনা করেছেন ক্যামব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভি। এ গ্রন্থে তিনি ১০ হাজারের বেশি নারী হাদিসবিশারদ ও শিক্ষাবিদের জীবন-কর্ম-অবদান তুলে ধরেন।
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব : ইসলামের সোনালি যুগে নারীরা রাজনীতির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে না থাকলেও তারা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং রাজনৈতিক সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আয়েশা (রা.) মুয়াবিয়া ও আলী (রা.)-এর মধ্যকার সংকট নিরসনে এগিয়ে আসেন। তেমনি সাওদা বিনতে আম্মারা বিন আশতার হামদানি তার গোত্রের প্রতিনিধি হয়ে মুয়াবিয়া (রা.)-এর কাছে যান এবং দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। মুয়াবিয়া (রা.) তাদের দাবি মেনে নেন এবং ইবনে আরতাকে বরখাস্ত করেন। (আকদুল ফারিদ, পৃষ্ঠা : ৩৪৪-৪৬)।
সমাজসেবা : সোনালি যুগে নারীরা বিভিন্ন ধরনের সমাজসেবায়ও অংশ নেন। তারা অসংখ্য শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রী জোবায়দা দীর্ঘ খাল খনন করে হাজীদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেন। সেলজুক শাসক সুলতান মালিক শাহর স্ত্রী তুরকান বিনতে তুরাজ বাগদাদে তিনটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তা পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াক্ফ করেন। (তারিখু দাওলাতুল আব্বাসিয়া, পৃষ্ঠা ৯৭)।
এ ছাড়া একাদশ শতাব্দীতে মামলুক শাসনামলে মুসলিম নারীরা দামেস্কে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১২টি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যা নারীদের দ্বারাই পরিচালিত হতো।
ব্যবসা-বাণিজ্য : রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্যও করতেন। নারী সাহাবী কায়লা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কোনো এক ওমরাহ আদায়কালে মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে আমি তার কাছে উপস্থিত হয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি একজন নারী। আমি বেচাকেনা করি। আমি কোনো জিনিস কিনতে চাইলে আমার কাক্সিক্ষত মূল্যের চেয়ে কম দাম বলি। এরপর দাম বাড়িয়ে বলতে বলতে আমার কাক্সিক্ষত মূল্যে গিয়ে পৌঁছাই। আবার আমি কোনো জিনিস বিক্রি করতে চাইলে কাক্সিক্ষত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য চাই। এরপর দাম কমাতে কমাতে অবশেষে আমার কাক্সিক্ষত মূল্যে নেমে আসি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে কায়লা, এমন করো না। তুমি কিছু কিনতে চাইলে তোমার কাক্সিক্ষত মূল্যই বলো, হয় তোমাকে দেওয়া হবে, নয় দেওয়া হবে না। তিনি আরও বলেন, তুমি কোনো কিছু বিক্রয় করতে চাইলে তোমার কাক্সিক্ষত দামই চাও, হয় তুমি দেবে অথবা দেবে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)।
চিকিৎসা : রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে নারীরা চিকিৎসক হিসেবেও দক্ষতা অর্জন করেন। যারা শৈল্যবিদ্যায়ও পারদর্শী ছিলেন। আয়েশা (রা.) নিজেও চিকিৎসাবিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করেন। উরওয়া (রহ.) বলেন, ‘আমি চিকিৎসা বিজ্ঞানে আয়েশা (রা.) অপেক্ষা দক্ষ মানুষ দেখিনি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, খালা, আপনি এই জ্ঞান কোথা থেকে অর্জন করলেন? তিনি বলেন, আমি মানুষকে রোগীর চিকিৎসা করতে দেখেছি এবং তা মনে রেখেছি।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/১৮২)। সাহাবাযুগে নারী সাহাবী উম্মে সুলাইমের নেতৃত্বে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতো। (আবু দাউদ)।
মিশরে মুসলিম শাসক কর্তৃক প্রথম আবাসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে নারীরাও চিকিৎসক ও শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পান। তাদের কেউ কেউ ‘মাশিখাতুত তিব’ তথা ‘মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান’ পদেও অধিষ্ঠিত হন। (আহমদ ইসা বেগ, তারিখুল বিমারিস্তান ফিল-ইসলাম)।
কৃষিকাজ : মহানবী (সা.)-এর যুগে নারীরা কৃষিকাজেও অংশগ্রহণ করতেন। আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) থেকে দীর্ঘ এক হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, ‘যখন জোবায়ের আমাকে বিয়ে করেন, তখন তার কোনো ধন-সম্পদ ছিল না। এমনকি কোনো স্থাবর জমিজমা, দাস-দাসীও ছিল না; শুধু কুয়া থেকে পানি উত্তোলনকারী একটি উট ও একটি ঘোড়া ছিল। আমি তার উট ও ঘোড়া চরাতাম, পানি পান করাতাম এবং পানি উত্তোলনকারী মশক ছিঁড়ে গেলে সেলাই করতাম, আটা পিষতাম, কিন্তু ভালো রুটি তৈরি করতে পারতাম না।… রাসূল (সা.) জোবায়েরকে একখণ্ড জমি দিলেন। আমি সেখান থেকে মাথায় করে খেজুরের আঁটির বোঝা বহন করে আনতাম। ওই জমির দূরত্ব ছিল প্রায় দুই মাইল।…’ (সহিহ বুখারি)।
হস্তশিল্প : মহানবী (সা.)-এর যুগে নারীরা হস্তশিল্পের কাজ করেও অর্থ উপার্জন করতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বপ্রথম সে-ই আমার সাক্ষাৎ পাবে যার হাত সর্বাধিক লম্বা’। সুতরাং তারা নিজ নিজ হাত মেপে দেখতে লাগলেন কার হাত বেশি লম্বা। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘অবশেষে আমাদের মধ্যে জয়নবের হাতই সবচেয়ে লম্বা স্থির হলো। কেননা তিনি হাতের কাজ করতেন এবং দান-খয়রাত করতেন।’ (সহিহ মুসলিম)।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী রায়িতা (রা.) হস্তশিল্পে দক্ষ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে তা বিক্রি করতেন এবং উপার্জিত অর্থ দান করে দিতেন। (মুসনাদে আহমাদ)।
অন্যান্য পেশা : স্পেনের অধিবাসী আয়েশা বিনতে আহমদ বিন কাদিম ছিলেন বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার। লুবনি ছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রে পারদর্শী। রাবিয়া কাসিসাহ প্রসিদ্ধ বক্তা ছিলেন। শিফা বিনতে আবদিল্লাহ ছিলেন প্রখ্যাত আইনজ্ঞ। ওমর (রা.) তাকে আদালতের ‘কাজাউল হাসাবাহ’ তথা ‘অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি কোর্ট এবং ও ‘কাজাউস সুক’ তথা ‘মার্কেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এর দায়িত্বে নিয়োগ দেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৫/৭৮)।
সমাজে নারীর অসামান্য ভূমিকার প্রশংসা করে তেরো শতকের প্রখ্যাত মুসলিম স্কলার আল্লামা ইবনুল কাইয়িম বলেন, ‘সমাজের অর্ধেকই নারী। বাকি অর্ধেকেরও জন্ম দেন নারী। তাই নারীরাই যেন পুরো সমাজ।’ (সংকলিত)।