পরশ পাথরের ছোঁয়ায়


৬ মার্চ ২০২৫ ১৩:১২

॥ ইকবাল কবীর মোহন ॥
হিজরি অষ্টম সন। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ। মুসলমানরা সবেমাত্র মক্কা জয় করেছেন। আল্লাহর দীনের বিজয় সূচিত হয়েছে। মক্কায় মুসলমানরা উৎসব পালন করছেন। তবে কাফের-মুশরেক কুরাইশরা ভীতসন্ত্রস্ত। প্রাণ বাঁচানোর জন্য তারা এদিক-সেদিকে ছোটাছুটি করছে। যে যেখানে পারছে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। পালিয়ে বেড়ানোর এ দৃশ্য ছিল অভাবিত। অথচ মুসলমানরা কোনো জুলুম করছে না। তাদের মধ্য নেই প্রতিশোধ-স্পৃহা। তথাপি মনের বাঘ যেন কাফের-মুশরেকদের অবিরাম তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। পাশাপাশি দেখা গেল আরেক অপূর্ব দৃশ্য। মানুষ দলে দলে এসে মহানবী (সা.)-এর কাছে ইসলামের দীক্ষা নিচ্ছে। মহানবী (সা.) সাফা পর্বতের উপত্যকায় বসে আছেন। এক ধ্যানে তিনি পরম স্রষ্টা আল্লাহকে স্মরণ করছেন। মানুষ মিছিলের মতো ছুটে আসছে তাঁর কাছে। এ যেন এক মুক্তির মিছিল। সত্যকে গ্রহণ করতে মানুষের মধ্যে এক অভূতপূর্ব আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। মেয়েরাও বসে নেই। তারাও নবীজি (সা.)-এর কাছে ছুটে আসছে ইসলামের দীক্ষা নিতে।
এমন সময় দেখা গেল, মেয়েদের মধ্যে একজন অতি সাবধানে হেঁটে আসছে। মানুষের ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। অনেক বড় অপরাধী সে। তাই তার মনে প্রচণ্ড ভয়। সে ভাবছে অন্য কথা। নবীজি (সা.) চিনতে পারলে তার নিস্তার নেই। নির্ঘাত কঠিন সাজা হবে। সে জানে তার অপরাধের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তার মতো অত বড় অপরাধী যে আর নেই, সে তা ভালোভাবেই জানে।
তখন মহিলার মনে পড়ছিল অজস্র অপরাধের কথা। রাসূল (সা.)-এর বিরুদ্ধে কতই না ষড়যন্ত্র করেছে সে। সে অপরাধ করেছে বদরে, ওহুদে এবং আরও অনেক যুদ্ধে। বিশেষ করে ওহুদ যুদ্ধে তার অপরাধ ছিল নজিরবিহীন। এসব দুষ্কর্মের স্মৃতি তার মনকে তোলপাড় করে তুলছে। তার অবস্থা কী যে হবে, সে কল্পনাই করতে পারছে না। তাও সে বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টা করছে।
ঐতিহাসিক ওহুদ যুদ্ধের ঘটনা। কাফের কুরাইশদের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো মুসলমানদের। সেই যুদ্ধে রাসূল (সা.)-এর নির্দেশের হেরফের করায় মুসলমানরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ল। মুসলমানদের অনেক সৈন্য শাহাদাতবরণ করল। আহত হলো আরও অনেকে। অবশেষে যুদ্ধ থেমে গেল। মুসলমানরা হয়ে পড়ল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। কাফেররা বিজয়ের উল্লাসে মত্ত হলো। এমন সময় শত্রুদের এক মহিলা মাঠে নামল তার দলবল নিয়ে। তারপর শুরু করল পৈশাচিক সব কর্মকাণ্ড। যেসব মুসলমান আহত হয়ে ওহুদের ময়দানে কাতরাচ্ছিল, সে প্রথমেই দেখে দেখে তাদের ওপর তরবারি চালাল। সবাইকে সে হত্যা করল। তারপর দেখে দেখে মৃত সৈনিকের হাত কাটল, কান কাটল, নাকও কাটল। তাদের চোখও উপড়ে ফেলল।
শুধু তাই নয়, এসব কর্তিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে মালা তৈরি করল। আর মালাগুলো মহিলা নিজে পরল, সঙ্গী-সাথীদের গলায়ও পরাল। এতকিছুর পরও তার সাধ মিটল না। সে এবার গেল শহীদ হামজার লাশের পাশে। হামজা (রা.)-কে মারার জন্য সে এক হাবশি ক্রীতদাসকে নিযুক্ত করেছিল। নাম তার ওহশী। হামজা (রা.)-এর দেহ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কেটে আলাদা করল। তারপর সে আরও উম্মাদ হয়ে উঠল। হিতাহিত জ্ঞান হারাল সেই মহিলা। সহসা মহিলা চেপে বসল হামজা (রা.)-এর বুকের ওপর। হামজা (রা.)-এর বুক চিরে সে দুই ফাঁক করল। টেনে-হিঁচড়ে হামজার বুক থেকে বের করল তার কলিজা। আর উম্মাদের মতো সে কলিজা ধরে চিবাতে লাগল।
হামজা (রা.) মহানবী (সা.)-এর আপন চাচা। ছোটবেলায় রাসূল (সা.)-কে অনেক আদর করতেন তিনি। এ নরঘাতক মহিলাই মক্কা বিজয়ের শুভদিনে বাঁচার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। সে জানে আজ তার আর কোনো উপায় নেই। পালানোরও কোনো পথ খোলা নেই। এখন রাসূল (সা.)-এর কাছে মাফ চেয়ে যদি বাঁচা যায়। মনে তার সীমাহীন ভয়। তাই কাপড়ে মুখ ঢেকে নিজের পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিল মহিলা। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী এই হিন্দা। একসময় হিন্দা রাসূল (সা.)-এর প্রায় কাছাকাছি এসে পৌঁছে গেল। সে ভেবেছিল কেউ তাকে হয়তো চিনবে না। কিন্তু মুখের কাপড় খোলার আগেই মুহাম্মদ (সা.) তাকে চিনে ফেললেন। রাসূল (সা.) বললেন, ‘কে তুমি ? হিন্দা না?’
হঠাৎ চমকে উঠল হিন্দা। সে কল্পনাও করতে পারেনি যে, রাসূল (সা.) তাকে চিনে ফেলবেন। হতবাক হিন্দা মাথা নেড়ে জানাল, ‘হ্যাঁ, আমিই হিন্দা। তারপর চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। তার পা যেন নড়ছে না। ভয়ে তার বাকশক্তিও যেন লোপ পেয়েছে। ক্ষমা চাওয়ার ভাষাও যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। অনেকক্ষণ পর হিন্দা হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠল। নবীজী (সা.)-এর কাছে জীবন ভিক্ষা চাইল, তার অপরাধের জন্য মার্জনা চাইল।
একবার কথা বলেই হিন্দা যেন পাথর হয়ে গেল। আর কোনো কথাই তার মুখ থেকে বের হলো না। নবী কারীম (সা.) হিন্দার মনোভাব বুঝতে পারলেন। আজ সে অসহায়ের মতো তার জীবন ভিক্ষা চাইছে। অমার্জনীয় অপরাধ করে এখন তার বোধশক্তি জেগেছে। আল্লাহর নবী তো বিরাট মনের মানুষ। তিনি দয়াল নবী। তাই তিনি বললেন, ‘যাও হিন্দা, আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম। তোমার অপরাধ মার্জনা করলাম। তুমি এখন মুক্ত, স্বাধীন।’
মহানবী (সা.)-এর ক্ষমার ঘোষণা শুনে হিন্দা বিস্মিত হলো। এক মহা আলোড়ন সৃষ্টি হলো তার মনে। তার এখন শুধু একটাই প্রশ্ন, নবীজী (সা.) আমাকে মাফ করলেন? এত অপরাধের পরও মার্জনা করলেন? হিন্দা এ কথা ভাবছিল আর মুখ ঢেকে অনেকক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। এবার সে মুখ তুলে তাকাল নবীজি (সা.)-এর দিকে। মন ভরে দেখল শান্ত স্নিগ্ধ তাঁর মুখমণ্ডল।
আজ মক্কা বিজয়ের দিন। মক্কায় রাসূল (সা.)-এর সামনে ছিল হাজার কাফির শত্রু। তারা তাঁকে কতই না যন্ত্রণা দিয়েছে। কিন্তু আজ মহাবিজয়ের এ শুভদিনেও তাঁর মধ্যে ক্রোধের কোনো ছাপ নেই। প্রতিহিংসার আগুন নেই। বরং তাঁর মধ্যে আজ দেখা গেল ক্ষমা আর দয়ার ফল্গুধারা। অথচ এই পবিত্র মানুষটিকে এতকাল অনেক কষ্ট দিয়েছে হিন্দা। তাঁর সাথে কত শত্রুতা করে এসেছে। এসব কথা যতই ভাবতে থাকে, ততই বিগলিত হয় হিন্দার মন। তার মনে চলে অনুশোচনার ছটফটানি। নবীজি (সা.)-এর মতো মহান মানুষকে ঘৃণা করে সে যে অমার্জনীয় অন্যায় করেছে, তা সে বুঝতে পারে। কিছুক্ষণ পর হিন্দা আবারও বলে ওঠে, ‘ইয়া রাসূলুলাহ! কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত আপনার তাঁবুর চেয়ে ঘৃণ্য কোনো তাঁবু আমার কাছে ছিল না। আর এখন পৃথিবীতে কোনো তাঁবুই আপনার তাঁবুর চেয়ে আমার কাছে অধিক প্রিয় নয়।’
তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন অনেক সাহাবী (রা.)। তারা হিন্দার কথা শুনে হতবাক হলেন। একি কথা শোনাল পাপিষ্ঠ মহিলা! কিন্তু আল্লাহর নবী তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাই সাহাবীরা আর কোনো কথাই বলতে পারলেন না। অবশেষে হিন্দা নবীজি (সা.)-এর ক্ষমা পেয়ে তার ঘরে ফিরে গেল। মহানবী (সা.)-এর ক্ষমার মাধুর্য তাকে বদলে দিল। সে ঈমান গ্রহণ করে মুসলমানের খাতায় নাম লেখাল। পরশ পাথরের ছোঁয়ায় হিন্দা পরিণত হলো সোনার মানুষে।