উন্নতি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির

ঢেলে সাজানো হচ্ছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা


৬ মার্চ ২০২৫ ১২:২৪

স্টাফ রিপোর্টার : দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি গত সপ্তাহের চাইতে উন্নতি হচ্ছে, তবে এখনো স্বাভাবিক নয়। নাগরিকদের অনেকেই আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনী এখনো পুরো উদ্যোমে দায়িত্ব পালন করছে বলে মনে করছেন না দেশের নাগরিকরা। অনেকটা গা-ছাড়া ভাব লক্ষণীয়। কেউ কেউ বলছেন, গণঅভ্যুত্থানে পতন হওয়া সরকারের যেসব পুলিশ যেসব দলীয় পদধারী লোক নিয়োগ পেয়েছেন তারা নিষ্ক্রিয় থাকার কৌশল নিয়েছেন। ফলে অনেক সময় পুলিশের নাকের ডগায় অপরাধ হলেও তারা থাকছেন অনেকটাই নিশ্চুপ। গত ৪ মার্চ দিবাগত রাতে গুলশান দুই নম্বরে একজন সাবেক এমপির বাড়িতে তল্লাশি চালাতে যান স্থানীয় কিছু মানুষ, যা কখনো স্থানীয়দের কাজ হতে পারে না। এলাকাবাসী যদি মনে করেন যে, কারো বাসায় তল্লাশি চালানো প্রয়োজন, তাহলে তারা ওই এলাকায় দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলতে পারেন। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, কিন্তু নিজেরা সেটি কখনোই করবেন না।
এদিকে গত ৩ মার্চ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে ডাকাত সন্দেহে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কোনো এলাকায় ডাকাত বা কোনো দুষ্কৃতকারী প্রবেশ করলে তা দেখবেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু এলাকাবাসী আইন হাতে তুলে নিচ্ছেন। যেটিকে কখনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি বলতে চাচ্ছেন সচেতন মহল।
এদিকে রোজা ও ঈদের কেনাকাটা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ঘিরে সক্রিয় হচ্ছে পেশাদার ও মৌসুমি অপরাধীরা। জাল টাকার কারবার, ছিনতাই, ডাকাতি, গাড়ি চুরি, অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির কিছু তৎপরতা ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। এ অবস্থায় রমজান মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযান আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে অভিযানের নাম ‘ডেভিল হান্ট’ আর থাকছে না বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। রমজান মাসে বিশেষ কিছু অপরাধ বৃদ্ধির আশঙ্কার কথা একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এমন আশঙ্কা সামনে রেখে সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা প্রস্তুতি জোরদার করতে বলা হয়েছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোও রাজধানীসহ সারা দেশে নিরাপত্তাব্যবস্থা নতুনভাবে সাজিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গত ২ মার্চ রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে কোর কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য চলমান বিশেষ অভিযান রমজান মাসে আরও জোরদার করা হবে। মহাসড়কে ডাকাতি ও চাঁদাবাজি ঠেকাতে এবং ব্যাংকে বড় অঙ্কের টাকা জমা ও উত্তোলনের সময় ডাকাতি বন্ধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে শুরু হয় অপারেশন ডেভিল হান্ট। ১ মার্চ পর্যন্ত যৌথবাহিনীর এ অভিযানে ১১ হাজার ৮৮২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপরও ৫ মার্চ সকালে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত আরও বেশকিছু অপরাধীকে গ্রেফতার করার হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুরসহ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলার শিকার হন ১৫-১৬ জন শিক্ষার্থী। তাদের একজন মারা যান। এর পর থেকে চলতে থাকে বিশেষ অভিযান। গত ২ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোর কমিটির বৈঠকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নিয়েও আলোচনা হয়। বৈঠকে বলা হয়, অপরাধ দমনে যৌথবাহিনীর অভিযান চলবে, তবে অপারেশন ডেভিল হান্ট নাম থাকবে না। বিশেষ অভিযানে যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা না ঘটে, কোর কমিটির বৈঠকে এ বিষয় নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
এদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা, প্রকাশ্য হত্যা, গণপিটুনিও হচ্ছে কোনো কোনো এলাকায়। এসব বিষয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এরই প্রেক্ষিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সেগুলো বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।
গত ২ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ফয়সল হাসান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ নিম্নরূপ- ১. চিহ্নিত অপরাধী, সন্ত্রাসী এবং মাদক ও চোরা কারবারিদের ধরতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে বিশেষ অপারেশন শুরু হয়েছে। ২. পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল বাড়ানো ও দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ ও পাবলিক প্রসিকিউটরদের অংশগ্রহণে সারা দেশে ‘দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও পরিবেশের ওপর গুরুত্বসহ আইন প্রয়োগ’ বিষয়ে ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৩. পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট প্রধান, উপপুলিশ কমিশনার, সেনাবাহিনীর মাঠে নিয়োজিত ব্রিগেড প্রধান ও অন্যান্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা প্রতিটি ঘটনার বিষয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে গণমাধ্যমে ব্রিফ করা। ৪. রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে তল্লাশিচৌকি বা চেকপোস্ট ও অপরাধপ্রবণ এলাকায় টহলসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথবাহিনী টার্গেট এলাকাগুলোয় জোরদার অপারেশন পরিচালনা করছে। ৫. রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে নিয়মিত পেট্রোলের পাশাপাশি নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের অতিরিক্ত পেট্রোল নিয়োজিত করা হয়েছে। ৬. ছিনতাইকারী, ডাকাত, কিশোর গ্যাং ও অন্যান্য অপরাধপ্রবণ স্থানগুলোয় কম্বাইন্ড অভিযান পরিচালনা করে অপরাধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। ৭. থানাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের তালিকা হালনাগাদ করে তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৮. ঢাকা শহরের আশপাশে; বিশেষ করে টঙ্গী, বছিলা, কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল বাড়ানো হয়েছে। ৯. ডিএমপির পুলিশ সদস্য, বিজিবি, আনসার ও বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের সদস্যদের জন্য মোটরসাইকেল ক্রয়ের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছেÑ যাতে করে তাৎক্ষণিকভাবে অলিগলিতে টহল দিয়ে অপরাধীদের ধরা সম্ভব হয়। ১০. মিথ্যা, গুজব ও প্রোপাগান্ডার বিপরীতে সত্য তথ্য প্রচারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ১১. স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজি, ডিএমপি কমিশনারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভোর ও গভীর রাতে ঝটিকা সফরে থানা, চেকপোস্ট ও টহল কার্যক্রম পরিদর্শন ও মনিটরিং করছেন। ১২. স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ইতোমধ্যে দেশের সব প্রশাসনিক বিভাগে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। ১৩. ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কার্যকর উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত বিভিন্ন চেকপোস্ট এবং টহল দলের রাত্রিকালীন কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়মিত দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। ১৪. মামলা যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্তকরণে জেলা ও মেট্রোপলিটন পর্যায়ে মামলা মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে করে নিরপরাধ ব্যক্তিরা মামলার হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছেন। ১৫. জুলাই বিপ্লবের শহীদ পরিবারের মামলাগুলো নিয়মিতভাবে গুরুত্বের সঙ্গে মনিটরিং করা হচ্ছে যাতে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্তপূর্বক আইনের আওতায় নিয়ে আসা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়। ১৬. আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত প্রতিটি ঘটনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।