বাংলাদেশপন্থিদের মধ্যে বোঝাপড়া জরুরি


৬ মার্চ ২০২৫ ১২:১৭

॥ মুজতাহিদ ফারুকী ॥
জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নামে দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে গত সপ্তাহে। দলটির প্রধান বা আহ্বায়ক পদে আছেন জুলাই বিপ্লবের অন্যতম শীর্ষনেতা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম। সদস্য সচিব হয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তাদের নেতৃত্বে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোড়ন তুলেছে। সাধারণ মানুষ আগ্রহ নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড লক্ষ করছে। তারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। বলেছেন, ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা এ দলের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। এটা তো স্পষ্ট যে, আমাদের সংবিধান পুরোপুরি নতুন করে প্রণয়নের অথবা পুনর্লিখনের প্রয়োজন আছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে বলেছেন, ১৯৭২ সালে প্রণীত ও পরে বার বার সংশোধিত বর্তমান সংবিধান স্বৈরাতান্ত্রিক উপাদানে ভরপুর।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো নতুন দলের প্রকাশ কখনোই নেতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ নেই। নতুন একটি দল গঠনের অর্থ হলো, দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, দেশ গঠনের সম্মিলিত কর্মকাণ্ডে আরও একটি সহযোগী শক্তির সংযোজন। সেজন্যেই নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দেন পুরনো দলগুলোর নেতা ও প্রতিনিধিরাও। এটাই গণতান্ত্রিক চেতনার দাবি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। সাধারণ সৌজন্য প্রকাশের উপায়ও বটে। সেটির যথাযথ প্রতিফলন দেখা গেল এনসিপির অনুষ্ঠানে। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে।
কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছে নতুন দলের প্রাথমিক লক্ষ্য ঘোষণা নিয়ে। নাহিদ ইসলাম ঘোষণাপত্রে বলেছেন, তারা দেশে একটি ‘সেকেন্ডে রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা ও গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান রচনা করবেন। এ সেকেন্ড রিপাবলিক বা দ্বিতীয় গণপ্রজাতন্ত্র নিয়েই কথা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে কৌতূহল তৈরি করেছে। রাজনীতিতেও বেশ খানিকটা নিম্নচাপ ঘটিয়েছে। সেকেন্ড রিপাবলিক বলতে কী বোঝায় এবং গণপরিষদ নির্বাচন কী, সে বিষয়ে রাজনীতির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তাত্ত্বিকরাই করুন। আমরা সাধারণ জনগণ সাধারণভাবে যা বুঝি, সেটুকু জেনে নিতে পারি। যখন কোনো দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে ভিন্নতর কোনো ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন আর সে দেশটি গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ বা রিপাবলিক থাকে না। অর্থাৎ যে রাষ্ট্রে নেতা নির্বাচনের অধিকার জনগণের হাত থেকে কেড়ে নেয়া হয় এবং নিছক দলীয় নেতৃত্বের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভিত্তিতে সরকার ও সংসদ গঠিত হয়। এ ধরনের ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র বা একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র আসলে রিপাবলিক নয়। যদিও অনেক একনায়কতান্ত্রিক দেশের নামের সঙ্গে ডেমোক্রেটিক এবং রিপাবলিক শব্দ দুটি আছে। যেমন ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কোরিয়া।
আর গণপরিষদ নির্বাচন হলো এমন একটি নির্বাচন, যা মূলত সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠন করা হয়, যারা সংবিধান প্রণয়ন করেন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার গঠন করা হবে না। নাহিদ বলেছেন, সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা ও গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে তাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার।
গত শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিশাল জমায়েতের মাধ্যমে নতুন এ রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সমাবেশে বক্তৃতায় নাহিদ বলেছেন, বাংলাদেশকে আর কখনোই বিভাজিত করা যাবে না। বাংলাদেশে ভারতপন্থি, পাকিস্তানপন্থি কোনো রাজনীতির ঠাঁই হবে না। পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি সম্পর্কিত বক্তব্য নিয়ে আমাদের কিঞ্চিত আপত্তি আছে। কারণ বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি বলে আদৌ কিছু নেই। যে মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিল, সেই মৃত দলটির নেতারাও; ঘুমের ঘোরেও বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর কথা ভাবেন না। যে দলটি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় একাত্তর সালে যুদ্ধ করেছিল, তারাও এটি সম্পূর্ণরূপে একটি আওয়ামী প্রচারণা। তথাকথিত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে জাতিকে বিভক্ত রেখে তাদের ভারতপন্থি ফ্যাসিবাদী শাসন চিরস্থায়ী করাই ছিল এ প্রচারণার একমাত্র উদ্দেশ্য। সেটি বাংলাদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে; বিশেষ করে গত ১৫ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনের জঘন্য স্বরূপ দেখার পর।
প্রসঙ্গত, বলা দরকার, আওয়ামী ও বাম রাজনীতিকরা কোনো কোনো দলকে পাকিস্তানপন্থি বলে চিহ্নিত করার মাধ্যমে বস্তুত এদেশ থেকে ইসলামের মূলোৎপাটনের লক্ষ বাস্তবায়নের পাঁয়তারা করেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে ফাঁস করেন স্বয়ং ঘাদানি কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবির। বর্তমান প্রজন্ম তো নয়ই, বয়বৃদ্ধরাও কেউ মনে করতে পারবেন কিনা, জানি না। বেশ কয়েক বছর আগে শাহরিয়ার কবির এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, যারা ইসলামের কথা বলেন তারা যদি ইসলাম ছেড়ে দেন, তাহলে আমরাও ভারতকে ছেড়ে দেব। বিবৃতিটি অন্য পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কিনা, জানা নেই। তবে দৈনিক সংগ্রামের পুরনো কপি খুলে নিঃসন্দেহে সেই বিবৃতি পাওয়া যাবে। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি বলে আদপে কিছু নেই। ইসলাম যাদের কাছে অসহ্য, তাদের ভণ্ডামি ছাড়া এটার কোনো অস্তিত্ব নেই। যাই হোক প্রসঙ্গে ফিরি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা ভুঁইফোঁড় নন। ফ্যাসিবাদী হাসিনার নৃশংস গুম, খুন, হত্যার ধারাবাহিকতার মধ্যে সব ধরনের নিপীড়ন সহ্য করে জীবনের মায়া উপেক্ষা করে তারা জুলাই গণঅভ্যুত্থান সফল করেছেন এবং ফ্যাসিবাদ উৎখাত করেছেন, যা গত ১৫ বছরে কেউ পারেনি। শুধু তাই নয়, দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দিয়েছেন নাহিদ। তার বয়সে দূরের কথা এ পর্যন্ত আর কোনো বাংলাদেশি এ ধরনের ত্যাগের দৃষ্টান্ত তো সৃষ্টি করতে পারেননি। একমাত্র অধ্যাপক গোলাম আযম তার দলের নেতৃত্ব স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু সেটি কোনো রাষ্ট্রীয় পদ ছিল না।
যাই হোক, নতুন দলের নেতাদের ঘোষণা নিয়ে এরই মধ্যে যে আলোড়ন শুরু হয়েছে, তা দলটির জন্য শুভ না বিপজ্জনক হবে, সেটি পরের প্রসঙ্গ। তবে এ মুহূর্তে তারা যে রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর হতে যাচ্ছেন, সেটি প্রমাণ করছে।
দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠন, গণপরিষদ নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করেছে বিএনপিকে। অথচ বিএনপি গত জুলাই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দানকারী দল। দলটি অনেক আগেই রাষ্ট্র মেরামতের সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরও তারা সার্বিক সংস্কারের পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু যত দিন গেছে, তাদের অবস্থান শিথিল হয়েছে। এখন তারা কোনোরকম মৌলিক সংস্কার ছাড়া শুধু যেটুকু না হলে নয়, সেটুকু সম্পন্ন করেই নির্বাচন চান। দলের একেবারে শীর্ষস্থানীয় নেতা, যারা জাতীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য, তারা বলছেন, দ্বিতীয় রিপাবলিক কী জিনিস তারা বুঝতে পারেন না। তারা নতুন দলকে তাদের বৈরী বলেও চিহ্নিত করছেন। বলছেন, গণপরিষদের প্রস্তাবনা, সেকেন্ড রিপাবলিকের ধারণা এগুলো বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও দীর্ঘায়িত-অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র। প্রশ্ন তুলছেন, আমাদের রিপাবলিক কি অসুস্থ?
আমরা বিতর্কে না গিয়ে শুধু ভাবি, যে মানুষটি হঠাৎ একদিন নিজের দেশেই গুম হয়ে গেলেন এবং বহুদিন পর নিজেকে খুঁজে পেলেন ভিন্ন একটি দেশের অজানা ভূখণ্ডে, তিনি যদি বুঝতে অক্ষম হন তার রিপাবলিক অসুস্থ না সুস্থ, তাহলে তাকে কে তাকে বোঝাতে পারে!
শুধু ষড়যন্ত্র অবিষ্কারেই শেষ নয়, বিএনপি এখন রীতিমতো হুমকিও দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। বলেছে, চলতি মাসের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা না হলে তারা কোন প্রক্রিয়ায় এগোবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
এর আগে সেনাপ্রধানও প্রায় একইরকম সংকেত দিয়েছেন। স্পষ্ট করেই বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে।
বিষয়গুলো অনেক বিশ্লেষকের কাছেই ঠিক স্বাভাবিক মনে হয়নি। কারণ এর সাথে একটি প্রতিবেশী দেশের সরকার, মিডিয়া; এমনকি সেনাপ্রধানের আকাক্সক্ষার সাজুয্য খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। অথচ এই প্রতিবেশী দেশটিই আমাদের রিপাবলিকের চরিত্রহানির জন্য দায়ী বলে জনগণ জানে।
যাই হোক, আমরা নতুন দলটির আবির্ভাব ইতিবাচকভাইে দেখতে চাই। আশা করি, তারা সব গণতান্ত্রিক দলের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ গঠনের কাজে শরিক হবে। তবে তাদের সম্ভাবনার বিষয়ে এখনো বলার সময় আসেনি। শুধু এটুকু বলা যায়, দলের দর্শন, ইশতেহার, সাংগঠনিক কাঠামো, গঠনতন্ত্র সম্পর্কে এবং সর্বোপরি তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার পরই বোঝা যাবে তারা কতটা কী করতে পারবেন। বিশ্লেষকরাও বলছেন, দলটি সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা এখনো পাওয়া যায়নি। রাজনীতির ময়দানে তাদের কর্মকাণ্ডই বলে দেবে কতটা টেকসই দল তারা হয়ে উঠবে।
এ মুহূর্তে গণমানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে তারা রয়েছেন। স্খলন বা আদর্শবিচ্যুত না হলে তাদের চলার পথে সহযোগীর অভাব হবে না বলেই মনে হয়। সম্ভাব্য সমস্যার কথা বলাই যায়। পতিত স্বৈরাচারের সর্বস্তরের মদদগার এবং দোসররা এদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কায়েমি স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী সামাজিক রাজনৈতিক অংশীজনও প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে নিশ্চিত। আর কারা বাধা হতে পারে তা মনে হয় কারো কাছে অস্পষ্ট নেই।
এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে উপস্থিত হয়েও আমাদের বিশ্বাস গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো দেশের ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের অনুকূলে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা ও বোঝাপড়ার পথ ধরে এগোবেন। কারণ বাইরের কোনো শক্তির ইশারায় তারা দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেবেন এবং নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিসংবাদে লিপ্ত হবেন- এমনটা কেউই আশা করে না।