ঐতিহাসিক ‘পলায়ন’ : লক্ষণ সেন থেকে হাসিনা
৬ মার্চ ২০২৫ ১২:১৫
॥ সরদার আবদুর রহমান॥
একটি ‘পলায়ন’ ও তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব সংক্রান্ত বিষয়টি কোনো হাস্যরসাত্মক বা ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের মতো ব্যাপার নয়। কেবল বাংলার ইতিহাস নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও এটি অনন্য সাধারণ একটি ঘটনা হিসেবে উল্লিখিত থাকবে। প্রাচীন ইতিহাসে তো কিছু নজির আছে। তবে আধুনিক সময়ে এমন বিস্ময়কর ও শিহরণ সৃষ্টি করার মতো ঘটনা বুঝি এবারই ঘটল। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশের ছাত্রসমাজ শোককে শক্তিতে পরিণত করে তারুণ্যের যে বিস্ফোরণ ঘটাল তা থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে নতুন কিছু উপহার পেল বাংলাদেশের ইতিহাস। দীর্ঘ দেড় দশকের একটি রক্তাক্ত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল আরেকটি ‘ঐতিহাসিক পলায়ন’-এর মধ্য দিয়ে।
কেউ কেউ এ ঘটনার সঙ্গে ১২শ’ বছর আগের এ বাংলারই সেন রাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদ ছেড়ে পলায়নের কিছু মিল খুঁজতে চেষ্টা করেন। ইতিহাসের বিশ্লেষকরা বলছেন, ১২শ’ বছর পর বাংলায় এটি ছিল দ্বিতীয় ‘ঐতিহাসিক পলায়ন’। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে নৌকায় করেই নদীপথে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেছিলেন রাজা লক্ষণ সেন। কিন্তু শেখ হাসিনা পালালেন আকাশপথেÑ প্রথমে হেলিকপ্টারে এবং পরে বিমানযোগে। যদিও শেখ হাসিনার সবচেয়ে প্রিয় বাহন ছিল নৌকা।
কোনো সাধারণ পরিবর্তন নয়
আধুনিককালের এ পলায়নের প্রেক্ষাপট তো ছিল সরকারের পতনের এক দফার আন্দোলন। যার ফসল ছিল প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতি। কিন্তু বিষয়টি এটুকুই ছিল না। ছিল এক বিশাল-বিপুল পটভূমি। অন্য সব কারণগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতও ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পর্যালোচনায় দেখা যায়, হাসিনার পলায়নের ফলে বর্তমান বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষ দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করে। জুলুম, নির্যাতন ও নিপীড়নের কবল থেকে মুক্তির নিশ্বাস পেতে থাকে। এর ফলে মোটাদাগে মানুষ একাধারে তার হারানো গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার ফিরে পাওয়ার পথ সুগম হয়। দেশের সার্বিক শাসনব্যবস্থা বিশেষ দল তথা বিশেষ চেতনার কুক্ষিগত হওয়া থেকে পরিত্রাণ পায়। এভাবে সেই শাসনব্যবস্থার অধীনে শিক্ষা, সংস্কৃতি, মিডিয়া, বিনোদন সর্বক্ষেত্রে এমন অবস্থা তৈরি করা হয়, যাতে একটি গোলামি ও দাসত্বমূলক প্রজন্ম সৃষ্টি করা যায়। অন্যদিকে লুটপাট ও টাকা পাচারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অবসান সূচিত হয়। নির্বাচন ও ভোট ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার কবল থেকে উদ্ধার পায়। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিশেষ দেশের আনুকূল্যে গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া চলেছিল এবং একে দুর্বল করে ফেলা হয়েছিল, তার অবসান হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সর্বত্র সিন্ডিকেট করে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা লুটপাট করার কৌশল বন্ধ হওয়ার পথ খুলে যায়। বিচার বিভাগকে অনুগত করে গড়ে তুলে তাকে ইচ্ছেমত কাজে লাগানোর অপদৃষ্টান্ত থেকে পরিবর্তিত হয়ে আগামীতে হয়তো বিচার বিভাগ পৃথকীরণ বাস্তব রূপ পেতে পারবে। মানুষের স্বাধীনভাবে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে।
একটি ফ্যাসিবাদী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের শাসনের প্রধান হাতিয়ার ছিল বিভাজনের রাজনীতি। জনগণকে পরস্পরবিরোধী নানা বর্গে বিভক্ত করা ছিল এ ধরনের শাসন-প্রণালীর প্রধান কৌশল। ধর্ম বনাম প্রগতি, শাহবাগ বনাম শাপলা, সেকুলারবাদ বনাম মৌলবাদ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বনাম বিপক্ষ শক্তিÑ এমন বিভাজনমূলক চাল আওয়ামী শাসনের ভিত মজবুত করেছিল। এর প্রভাব ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্র ও শাসনযন্ত্রের সর্বত্র।
লক্ষণ সেনের তুলনা
১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সিংহাসন ছেড়ে প্রাসাদের পেছন দরোজা দিয়ে নৌকাযোগে পলায়ন করেছিলেন হিন্দু রাজা লক্ষণ সেন। তিনি ছিলেন হিন্দু ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের রাজা। তবে প্রধানত ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন। তার পলায়নের ফলে সে সময়ের বাংলার রাজনীতি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়। ঘৃণ্য শ্রেণিবৈষম্য ও জাতপাতের অবসানের সূচনা হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়ন ও নিগ্রহের কবল থেকে বৃহত্তর বাংলার মানুষ মুক্তির নিশ্বাস ফেলে।
লক্ষণ সেনের শাসনে ব্রাহ্মণতন্ত্র সমাজে এমনভাবে জেঁকে বসে যে, অন্য ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রদায়ের প্রতি অসহিষ্ণু আচরণ প্রকট হয়ে পড়ে। যার ফলে লক্ষণ সেনসহ পুরো সেনরাজত্বের কালে একদা প্রতিপত্তিশীল পালদের ওপর নিবর্তনমূলক আচরণ প্রকাশ হতে দেখা যায়। প্রজা সাধারণ যেমন সেনশাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল তেমনি শাসনক্ষমতার ভেতরেও ঘুণ ঢুকে রাজার অজ্ঞাতেই তা ধসে পড়ার অপেক্ষায় ছিল।
বাংলায় বর্ণবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব তাদের। তারা বর্ণ প্রথা চালু করে সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি করে। বৌদ্ধ ও নিম্নবর্গের মানুষদের হত্যা, নিপীড়ন ও বিতাড়িত করে বাংলায় সাম্প্রদায়িকতাকে প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়। তাদের ভূমিকায় বাংলা সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য উজ্জীবিত হয়। বলা যায়, এটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আকারে প্রকটিত হয়। সেনদের আমলে বাংলা সাহিত্যের স্থান দখল করে ‘সংস্কৃত’ সাহিত্য। এর ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অবস্থান সংকুচিত হতে থাকে। সেনবংশের কালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে চলতে থাকে বন্ধ্যাত্ব। বিপরীতে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে হতে থাকে বিকশিত। পালবংশের শাসনামলে যে সামাজিক স্থিরতা ছিল, তা সেন শাসনামলে বিনষ্ট হয়ে যায়। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে অগ্রগতি সাধিত হলেও ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিভেদ-বিচ্ছেদ, শোষণ-নির্যাতন এবং প্রবলের ওপর সবলের নিপীড়ন প্রবল আকার ধারণ করে। ধর্মীয় বিধিনিষেধের সূত্রে নানা অমানবিক ক্রিয়াকলাপও সংঘটিত হতে থাকে।
লক্ষণ সেন একজন যোগ্য ও ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হলেও বাস্তবে এ সামাজিক অনাচার-অবিচার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সমর্থ হননি। এর ফলে তাঁর সময়ে সেনবংশের যে পতন শুরু হয় তা আর রোধ করা সম্ভব হয়নি। এ প্রেক্ষাপটেই ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির অভিযান সফল হয় এবং এক নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটে।
হাসিনা-রেজিম
তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, রাজা লক্ষণ সেনের পলায়নে যেমন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন উল্লেখযোগ্যভাবে ঘটতে থাকে, তেমনি শেখ হাসিনার পলায়নেও অনুরূপ পরিবর্তনের লক্ষণ পরিস্ফুট হচ্ছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ মানুষের জীবনাচরণ পরিবর্তনে হাসিনা-রেজিমে সুস্থধারা তথা ইসলামী মূল্যবোধ বদলে দেয়ার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছিল। বিশেষ করে শিক্ষার নতুন কারিকুলামে খুব সূক্ষ্মভাবে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঘটছিল এবং ইসলাম ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছিল। শিল্প ও সংস্কৃতির নামে ইসলামী সংস্কৃতি মুছে ফেলা হচ্ছিল। একমুখী শিক্ষার নামে মাদরাসা শিক্ষাকে ধ্বংস করার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা চলছিল। শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে কোনো ধর্মীয় পরিচয় যাতে গড়ে উঠতে না পারেÑ এভাবে তাদের মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করা হচ্ছিল। মানবসভ্যতাবিধ্বংসী ও প্রকৃতিবিরুদ্ধ ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ ও যৌনাচারকে প্রমোট করা হচ্ছিল। পৌত্তলিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির আধিপত্য বিস্তারিত হচ্ছিল। মুসলিম শাসকদের অত্যাচারী শাসক হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের চরিত্র হননের চেষ্টা চলছিল। স্কুল ও মাদরাসার সব পাঠ্যপুস্তক বিজাতীয় সংস্কৃতি, অনৈসলামিক শব্দ এবং অশ্লীল চিত্রযুক্ত রাখা হচ্ছিল।
পরিবর্তনের ইঙ্গিত
ইতোমধ্যে লক্ষ করলে দেখা যাবে, পরিবর্তনের কিছু ইঙ্গিত মিলছে। আওয়ামী লীগের পতনের পর উদযাপিত বিভিন্ন দিবসগুলোয় ক্রিয়াশীল বিভিন্ন পক্ষের গৃহীত কর্মসূচিগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, গণতন্ত্রকামী জনগণ বিভাজনের পাতানো জাল ছিঁড়ে ফেলতে বদ্ধপরিকর। এসব কর্মসূচি বলতে চায়, ধর্মের সঙ্গে ভাষার আবশ্যিক কোনো বিরোধ নেই; বরং ভাষা, ধর্ম, ঐতিহ্য ও স্মৃতির বৈচিত্র্য মিলিয়েই আমরা একটি সুসংহত রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হয়ে উঠতে পারবো। মূলধারার চেতনাবাহী শক্তি আর কোণঠাসা হয়ে নেই। মুক্তভাবে গলা ছেড়ে স্বাধীনতার স্লোগান দিতে পারছে এবং মুক্তির গান গাইতে পারছে। বলাবাহুল্য, আওয়ামী আমলে দিল্লির আশীর্বাদপুষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের জীবন থেকে নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও স্বকীয়তা কেড়ে নিয়ে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানকে আত্মপরিচয়ের সংকটে নিপতিত করেছিল। এ স্বাধীন-সার্বভৌম ভূমিতে জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের সূচনা করতে হলে আমাদের একান্ত নিজস্ব পরিচয়টি স্বগর্বে ঘোষণা ও প্রকাশ করতে পারার প্রয়োজন ছিল। দিল্লির আশীর্বাদপুষ্ট ক্ষমতাসীন দালালগোষ্ঠীর বাঙালিত্ব নিয়ে অতি প্রচারের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল এদেশের নব্বই শতাংশ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে বিলীন করে দেয়া। অতি সুচারুরূপে সেই পথে যাত্রা করেছিল অপশক্তি।
বাংলাদেশের মানুষের চিরচেনা মূল্যবোধ ও চেতনা বরাবর ‘ধর্মপ্রবণ’। সেই সঙ্গে জুলুমতন্ত্রের ব্যাপারে নিরাপসকামী। এ দুই চেতনার মিশ্রণে যে বৈপ্লবিক মনোভঙ্গি তৈরি হয়, তারই প্রকাশ ঘটে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে। এ প্রকাশের প্রভাব বিস্তৃত হয় সাংস্কৃতিক চেতনার অঙ্গনজুড়ে। এটি এখন একটি সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণ জাতিসত্তা তৈরিতে অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়। এজন্য প্রয়োজন নিবিড় পরিকল্পনা ও সচেতন প্রয়াস।