স্বস্তির দিকে অর্থনীতি
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:৫১
॥ উসমান ফারুক ॥
আর্থিক খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি ও লুটপাটে ক্ষুব্ধ সাধারণ জনগণ যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, ঠিক তখনই ছাত্রদের ডাক পেয়ে সরকারের পটপরিবর্তনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যে সরকার গত দেড় দশক জনগণের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপেছিল। সেজন্য ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পরই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও প্রথম উদ্যোগ ছিল আর্থিক খাতের সংস্কার। সংস্কারের আগে নেওয়া নানামুখী উদ্যোগে অনেকটা স্বস্তির দিকে যাচ্ছে অর্থনীতি। মূল্যস্ফীতি, চলতি হিসাব ইতিবাচক হওয়া, আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত, রেমিট্যান্স, রপ্তানির মতো প্রবৃদ্ধি আশা জাগাচ্ছে। আমদানি দায় মেটাতে কোনো সমস্যা না হওয়ায় নিত্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। এখন তা স্থায়ী করতে প্রয়োজন সংস্কার সুপারিশের বাস্তবায়ন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচন দাবি করায় সংস্কারের সুপারিশ নেওয়া হচ্ছে তড়িঘড়ি করে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী দাবির কাছে আর্থিক খাতের সংস্কারের উদ্যোগগুলোতে গতি কমেছে। সংস্কারের সুপারিশ তৈরির দায়িত্বে থাকা বিশেষজ্ঞদের মনেও প্রশ্ন উঠেছেÑ উদ্যোগ কতটুকু আলোর মুখ দেখবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, সংস্কার বাস্তবায়ন না করে নির্বাচনের দিকে গেলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের চেয়ে নাজুক হয়ে যাবে। অর্থপাচার বন্ধে উদ্যোগ যে আলোর মুখ দেখেছে, তা রাজনৈতিক দলের কাছে চাপা পড়ে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো জনগণের কাছে জবাবদিহির চর্চা শুরু করেনি। তারা আগে নিজেদের কর্মসূচি পরিষ্কার করুক, তারপর নির্বাচনের আলোচনাটি শুরু হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক খাতের সুপারিশ বাস্তবায়ন এখনই শুরু করা উচিত। তার বাস্তবায়ন ও ফলাফল দেখেই নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আসতে পারে। ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে তৈরি হওয়া মাফিয়াদের হাতে ধ্বংস হওয়া গত দেড় দশকের আর্থিক ক্ষত এত অল্প সময়ের মধ্যে মেরামত হবে না। আপাতত লুটপাটের ছিদ্রগুলো বন্ধ করা গেছে। ফ্যাসিস্টদের দোসররা এখনো রাষ্ট্রযন্ত্রে আছে। সংস্কার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তাদেরও চাকরি থেকে বরখাস্ত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জোরালো হচ্ছে। সংস্কার বাদ দিয়ে নির্বাচনের দিকে মনোযোগী হলে আর্থিক খাত দুর্বলই থেকেই যাবে। সেই দুর্বল অর্থনীতিকে টেনে তোলার মতো সক্ষমতা ও সুযোগ দলীয় সরকারের থাকবে না।
তিন বছর নেগেটিভ ছিল চলতি হিসাব
করোনা মহামারির সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়নে উঠেছিল। মহামারি শেষে অর্থনীতি সাজানোর কাজটি শুরু করার সময়ে বিশাল এ রিজার্ভে লোভ পড়ে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের, পতনের পর শেখ হাসিনা তার প্রভু দেশ ভারতে গিয়ে ওঠে। রিজার্ভ চুরি করতে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার লোলুপ দৃষ্টির সহযোগী হন সালমান এফ রহমান, বিদ্যুৎ ব্যবসায়ী সামিট গ্রুপসহ আর্থিক খাতের মাফিয়ারা।
রিজার্ভ থেকে ব্যবসা উন্নয়নের নামে ঋণ নিয়ে অর্থ পাচার করে ধীরে ধীরে খালি করে ফেলে। এতে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নের নিচে নেমে যায়। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ১২ বিলিয়নের মতো। অবশিষ্ট টাকা ছিল বিভিন্ন খাতে ঋণ হিসেবে দেওয়া। তখনই বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য লেনদেনে ব্যবহৃত চলতি হিসাব (কারেন্ট একাউন্ট) নেগেটিভ হয় অর্থাৎ ঘাটতিতে পড়ে যায় বাংলাদেশ।
চলতি হিসাব নিকট অতীতে কখনোই নেগেটিভ হয়নি। চলতি হিসাব নেগেটিভ অর্থাৎ ঘাটতিতে পড়লে পণ্য আমদানি করার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অন্য দেশ গ্যারান্টার হলে পণ্য আমদানি করা সম্ভব হয়। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সরকারকেও আরেক দেশের সরকারের কাছ থেকে গ্যারান্টি নিয়ে পণ্য আমদানি করতে হয়। গ্যারান্টি নিলে তার বিপরীতে ফি দিতে হয় বলে খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সেই সুযোগও ছিল না।
চলতি হিসাব নেগেটিভ হওয়া মানেই দেশটিকে বৈদেশিক মুদ্রা ধার করতে হবে। তখন স্থানীয় মুদ্রা অর্থাৎ টাকার মান পড়ে যাবে। অর্থনৈতিক অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার পর্যায়ে গেলে আওয়ামী লীগ সরকার গোপনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে যায়। সরকারের ঋণের এ ধরনা দেওয়া বেশিদিন গোপন থাকেনি। সাংবাদিকরা জেনে যাওয়ায় আইএমএফ আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় বাংলাদেশ সরকার ঋণ চেয়েছে। সদস্য দেশ হিসেবে আইএমএফও বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা হওয়া থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে।
কিন্তু ঋণ নিয়ে দেড় বছরের বেশি সময় অর্থাৎ ২০ মাস পার করলেও অর্থনীতির মন্দাকে আটকাতে পারেনি। মূল্যস্ফীতির লাগামহীন পাগলা ঘোড়াকে থামাতে পারেনি। এর নেপথ্য কারণ ছিল, নতুন করে বৈদেশিক মুদ্রা ধার পেলেও অর্থ পাচার বন্ধ হয়নি। নিত্যনতুন উপায়ে অর্থ পাচার চলছিল। সে কারণে টাকার মান ডলারের বিপরীতে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ৮৪ টাকা থেকে নেমে ১২০ টাকায় চলে যায়। খোলাবাজারে তা ১২৫ টাকায় নেমে যায়।
সেরকম একটা অগোছালো অবস্থায় বাংলাদেশে বিপ্লব হলে বেরিয়ে আসে সালমান এফ রহমান ও আর্থিক খাতের মাফিয়া হওয়া ২০টি গ্রুপ অর্থ পাচার করার বিস্তারিত তথ্য। কোথায় কোন কোন দেশে কে কত টাকা বিনিয়োগ করেছে, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইউ) বিভিন্ন দেশ থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে। যার ওপর ভিত্তি করে পুলিশ ও সিআইডি তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
চলতি হিসাবের সেই নেগেটিভ অবস্থা থেকে বাংলাদেশ বের হয়েছে গত অক্টোবর মাসে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বের মাত্র চার মাসের ব্যবধানে চলতি হিসাব ইতিবাচক হয়। যেটি গত তিন বছরেও পারেনি ফ্যাসিস্ট সরকার। শুধু চলতি নয়, গত ডিসেম্বর মাসে আর্থিক হিসাব (ফিন্যান্সিয়াল একাউন্ট) ইতিবাচক হয়। এর আগে গত তিন বছরই নেগেটিভ ছিল। চলতি ও আর্থিক হিসাব ইতিবাচক হওয়ায় গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে টাকার মান ডলারের বিপরীতে একই জায়গায় ১২২ টাকায় ধরে রাখতে পেরেছে। নইলে পরিস্থিতি আরো অবনতি হতো। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ায় লাগাম এসেছে তিন বছর পর। সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ৫ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কে নেমে আসে। সরকার আশা করছে, আগামী জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ থেকে কমে ৭ শতাংশে নেমে আসবে।
অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকের এমন উন্নতির জন্য গত বছরের তুলনায় রিজার্ভ পরিস্থিতি আরো বেড়েছে। প্রকৃত রিজার্ভ এখন ২১ বিলিয়ন ডলার। ফলে এবার রমজানের পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের কোনো কষ্ট হয়নি। সব ধরনের পণ্যে এখন বাজার সয়লাব। দামও আগের বছরের চেয়ে কমেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে দাম কমে আসার ঘটনা বিরল। একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে বাংলাদেশে তা আর কমেনি। এবারই প্রথম আলু, শিম, ফুলকপি, বেগুন, খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কমেছে।
চূড়ান্ত হয়নি সুপারিশ
ব্যাংক, পুঁজিবাজার ও আর্থিকসহ ১১টি খাত সংস্কারের জন্য যে সুপারিশমালা জমা পড়েছে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সব রাজনৈতিক দল ও আমলাদের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে এটি চূড়ান্ত হওয়ার কথা। সেটি এখনো হয়নি। তার আগেই নির্বাচনের দিকে যাওয়া মানেই সংস্কার ইস্যুটি আর অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে না। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আমলারা তখন রাজনৈতিক দলের মর্জির ওপর ছেড়ে দিবে সংস্কারের পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে। তারা আর সংস্কারের দিকে যাবে না। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা আনতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাও মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। সেই অবস্থা অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে। তখন সংস্কার বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার মতো যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাও ভেস্তে যেতে পারে। লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার করার যে তথ্য রাষ্ট্রের কাছে রয়েছে, তা হয়তো কোনো কাজেই আসবে না। উল্টো অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা আরো বিপাকে পড়বেন। চাকরি ও জীবনের শঙ্কা নিয়ে তাদের দিনযাপন করতে হবে উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে।
অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশের শুভাকাক্সক্ষী রাষ্ট্রগুলোর কূটনীতিকরা বলছেন, আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো পাক। তা করতে হলে সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। তার প্রভাব দেখা ও বিশ্লেষণ করে হয়তো নতুন নতুন আরো নীতিমালা করার প্রয়োজন হবে। সেই নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরই নির্বাচনের প্রসঙ্গটি আসতে পারে। এ সময়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের দমন-নিপীড়নে আত্মগোপনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীরা জনগণের কাছে যেতে পারবে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের যে ইচ্ছে জনগণ লালন করছে, তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারবে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের কর্মসূচি ও আর্থিক সংস্কারের সুপারিশগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, তা জনগণকে জানাতে পারবে। তার ওপরই নির্ভর করবে আগামীর বাংলাদেশ কেমন হতে পারে।