স্বৈরাচার দেশে দেশে শেখ হাসিনা ছিল বাংলাদেশে
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:৩৩
॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রধান হিসেবে। মানুষকে আল্লাহ দিয়েছেন জ্ঞান-বুদ্ধি, বোঝার ক্ষমতা। ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা মেনে চলে সমাজকে ভালো পথে চালানোর কাজ মানুষের। যারা আল্লাহর কথা-কাজ মানবে না, তাদের পরিণতি যুগে যুগে মর্মান্তিক হয়েছে। পানিতে ডুবে মরেছে। ঝড়-বাতাসে গোটা জনপদ ধ্বংস হয়েছে। তাই যারাই আল্লাহর পথে চলবে, তাদের দুনিয়ায় চলার সার্বিক সহযোগিতা আল্লাহ করবেন। আর বিরোধীরা আল্লাহর রোষানলে পড়বেই, কোনো ছাড় নেই। সময়ের ব্যবধান মাত্র।
তাই দেশে দেশে যারাই আল্লাহর বিরোধিতায় মগ্ন ছিল, আল্লাহ তাদের দুনিয়ায়ই অপমানিত করেছেন, দেশছাড়া করেছেন। আমাদের আলোচনা এবার দেশে দেশে স্বৈরাচারদের অপমানের কাহিনী। শক্তিধর ইরানের মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজতন্ত্র কায়েম করেছিল। আমেরিকার ধাঁচে একটি মুসলিম দেশের কৃষ্টি-কালচার সব মুছে ফেলে দিয়েছিল। হাফপ্যান্ট কালচার, ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। মহান আল্লাহ তায়ালা ইরানের মুসলিম নেতৃবৃন্দদের সঠিক বুঝ দিয়ে ইরানের এ অনৈসলামী কালচার ধ্বংসের উদ্যোগে সাহায্য করেন। শক্তিধর ইরানে শাহ পাহলভী ১৯৭৯ সালে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়। তার কবরও ইরানে হয়নি।
মুসলিম দেশ সুদানও স্বৈরাচারের আরেক ঘাঁটি ছিল। স্বৈরশাসক সাদিক আল মাহদী তার দেশের জনগণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেশটাকে তার করায়ত্ত্ব করে জনগণকে মূল্যায়ন না করে নিজের ইচ্ছামতো স্বৈরাচারী কায়দায় শাসন চালানোর কারণে জনগণ ফুঁসে ওঠে। সে বাধ্য হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে জীবন রক্ষা করে ১৯৮৯ সালে। এখন তুলনামূলকভাবে দেশ ভালো চলছে। আমরা আসি হাইতির কথায়। অ্যারিস্টাইড আফ্রিকার এদেশে স্বৈর কায়দায় দেশ চালাতে গিয়ে জনগণের রোষানলে পড়ে। অত্যাচার-অবিচারের ক্ষোভে মানুষ তাকে দেশছাড়া করে। এভাবে হাইতির স্বৈরশাসকের পতন হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় সর্বোচ্চ মুসলিম জনগণ বাস করে। সেখানে সুহার্তো দেশ চালাতে গিয়ে মানুষের অধিকার হরণ করে স্বৈরাচারী কায়দায় চলতে থাকে। সেখানেও জনগণ তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য মাঠে নামে। স্বৈরশাসক সুহার্তো দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়। আল্লাহ তায়ালা স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে ভূমিকা নেন।
আমরা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতাও ভালো নয়। পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই সামরিক শাসকের জাঁতাকলে পড়ে, যা আজ পর্যন্ত সিলসিলা চলে আসছে। মুসলিমপ্রধান দেশ হয়েও তারা দুনিয়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না শুধুমাত্র জগণের বিরুদ্ধে দেশ চালানোর কারণে। ৫৭টি মুসলিম দেশের মধ্যে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়েও জনগণকে সাথে নিয়ে চলতে পারছে না। সেখানেও ১৯৯৮ সালে পারভেজ মোশাররফ জনগণের তোপের মুখে প্রথমে পদত্যাগ করেন এবং দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়।
এই কিছুদিন পূর্বে আফগানিস্তানের স্বৈরশাসক আশরাফ ঘানি জনতার ক্ষোভে পড়ে। আদিকাল থেকেই স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব হিসেবে পাহাড়ি দেশ হয়েও আলখেল্লাহ পরে রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, আমেরিকার কবল থেকে দেশ মুক্ত করেই আজ তাদের অর্থনীতি দুনিয়ার সবচেয়ে দামি পর্যায়ে উঠেছে। সেখানে এ আশরাফ ঘানি দেশটাকে স্বৈরাচারী কায়দায় চালাতে গিয়ে জনগণের ক্ষোভে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত তল্পিতল্পা নিয়ে পালাতে বাধ্য হয় ২০২১ সালে।
রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কা থেকে জনগণের রোষে পালাতে বাধ্য হয় ২০২২ সালে। জনগণ তার বাড়িঘর দখল করে নেয়। এখন শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি অনেক ভালো।
আমাদের দেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ব্যাপারে আলোচনার পূর্বেই সিরিয়ার বাশার আল আসাদের কথা আলোকপাত করতে চাই। সিরিয়ার ব্যাপারে মুসলিম ঐতিহ্যের বর্ণনা নবী মুহাম্মদ সা.-এর সময় থেকেই। অনেক মুসলিম কৃষ্টি-কালচার এ সিরিয়ায় রয়েছে। কিন্তু স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদ দেশটাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমেরিকার ধাঁচে চালাতে গিয়ে জনগণের ক্ষোভের মধ্যে পড়ে। বার বার উৎখাতের পথে সে বাধা সৃষ্টি করে জনগণকে হত্যা-নির্যাতন চালিয়ে বিদ্রোহ দমন করে। কিন্তু ২০২৪ সালে মাত্র ১২ দিনের বিক্ষোভে বাশার আল আসাদ পালাতে বাধ্য হয়। এভাবেই স্বৈরশাসকদের পরিণতি হয়ে থাকে।
এবার আসি আমাদের এ ছোট দেশ বাংলাদেশের কথায়। গত ৫৪ বছরে আমরা শুধু আন্দোলনে রক্তই দিয়েছি। নির্যাতন ভোগ করেছি। জেল-জরিমানা ছাড়াও বাকশালের একনায়ক শেখ মুজিবের শাসন দেখেছি। লাল ঘোড়া দাবড়ানোর হুঙ্কার শুনেছি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সংসদে গর্বের সাথে বলতে শুনেছি, সিরাজ শিকদার আজ কোথায়। সিরাজ শিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপরের ইতিহাস সুখকর নয়। শেখ মুজিবকে ভোগ করতে হয় করুণ পরিণতি। দেশে চলে অরাজকতা। তখনকার মেজর জিয়ার নেতৃত্বে দেশে শান্তি ফিরে আসে। মেজর জিয়া দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশ দরদিদের নিয়ে দল গঠন করেন, যা আজকের বিএনপি। যদিও এখন জিয়ার আদর্শের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে পতিত আওয়ামীদের সাথে তাল মিলিয়ে ভারতের দালালি করার কাজ এক গ্রুপ চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেশ দরদি জিয়ার অনুসারীদের সতর্ক করতে চাই, জিয়ার আদর্শে দল চালালেই দল ও দেশের জন্য ভালো।
আমরা জানি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ স্বৈরশাসক ‘লেডি হিটলার’ নামে খ্যাত শেখ হাসিনার শাসনামলের কথা। শেখ হাসিনা তার শাসনামলে গোটা দেশ তার নিজের লোকদের দিয়ে অন্যায়-অবিচার, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ভূমিদস্যুতা, ব্যাংক লুটকারী, দেশের টাকা বিদেশে পাঠানোর এক উৎসবে পরিণত করেছিল। নিজে, বোন, ছেলে, মেয়েসহ তার নিজস্ব পারিবারিক গোষ্ঠীদের কাউকেই টাকা কামাই থেকে বাদ রাখেনি। ধরলেই শতকোটি টাকা। আপনারা আগেই জেনেছেন, তার বাড়ির পিয়নেরও ৪০০ কোটি টাকার খবর গর্বের সাথে জানান দিয়েছিল, তার চাকরও হেলিকপ্টারে ঘুরে বেড়ায়। লজ্জাজনক পরিবেশ কায়েম করেছিল।
দেশের মানুষ দীর্ঘদিন হাসিনার এ স্বৈরশাসকের ভূমিকা মেনে নিতে পারেনি। আস্তে আস্তে ছাত্র-জনতা আপামর সবাই সুযোগ খুঁজছিল হাসিনার পতনের। জুলাই-আস্ট ২০২৪ সালের পূর্বেই কোটা আন্দোলনে হাসিনা বিরূপ মন্তব্য করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা মিটিং-মিছিল বিক্ষোভ করতে থাকে, হাসিনাও স্বৈরশাসকের ভূমিকায় তার দল ও পুলিশ বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করতে থাকে। আকাশ থেকে গুলি করেও মানুষ মারতে থাকে। এখন জানা যাচ্ছে, তার নির্দেশ ছিল যে কিছুর বিনিময়েই হোক, ক্ষমতা তাকে ধরে রাখতে হবে।
মহান আল্লাহর অসীম ধৈর্যশীল। স্বৈরাচার হাসিনার দেড় দশকের দুঃশসন অবসান তখনই হয়েছে যখন আল্লাহ চেয়েছেন, তখনই শুরু হয় পতনের পালা। সেনাবাহিনী নড়েচড়ে বসে। প্রশাসনের অন্য বিভাগের লোকেরাও হাসিনার ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ মেনে নিতে পারছিল না।
শেষ পর্যন্ত ঘটে যায় ঐতিহাসিক বিপ্লব। আগস্টের ৫ তারিখের পূর্বেই হাসিনা টের পেয়ে যায়, তার স্বৈরশাসনের মেয়াদ শেষ। কোনোভাবেই আর প্রাণে বাঁচার উপায় নেই। তার প্রিয় মোদিও তার পক্ষে কোনো পদক্ষেপ নিতে সাহস পায়নি। গোটা দেশের ছাত্র-জনতা, শিশু-কিশোর, ছেলে-মেয়ে এক আওয়াজ তুলে মাঠে নেমে যায় হাসিনার পতনের জন্য। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী প্রধান হাসিনাকে ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দিয়ে দেশ থেকে প্রাণ নিয়ে পালানোর জন্য বলতে থাকে। দিগি¦দিক চিন্তার ইতি ঘটিয়ে দুপুরের খাবার টেবিলে রেখেই বোনকে সাথে নিয়ে সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে তার প্রিয় মোদির কাছে আশ্রয় নেয়।
দুঃখের খবর হলো, তার পালানোর ৬ মাস হলো, কিন্তু এখনো তার দোসররা টাকার পাহাড়ে বসে ফুঁসফাঁস করছে। এ ফুঁসফাঁসের কারণে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আবার ছাত্র-জনতা তাদের ক্ষোভ ঝাড়তে মাঠে নেমে পড়ে। ৩২ নম্বরের নিশানা গুড়িয়ে দেয়। গোটা দেশে হাসিনার দোসরদের মূলোৎপাটনের পদক্ষেপ নেয়।
সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় অপারেশন ডেভিল হান্ট- শয়তান শিকারের অভিযান। এ পর্যন্ত কয়েক হাজার শয়তান ধরা পড়েছে। ঘোষণা এসেছে এবার চুনোপুঁটি থেকে রাঘব-বোয়াল সব ধরা পড়বে এ শয়তান শিকারের জালে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে এ সময় প্রকাশ পায় খুন-গুমের প্রকৃত ঘটনা জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার বাস্তব রিপোর্টে। বলতে পারেন হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়ার অবস্থা। স্বৈরশাসক হাসিনার গোটা সময়েই জনগণের প্রাপ্য না দিয়ে তার দোসরদের অর্থকড়ি কামাইয়ের সুযোগ দিয়ে দেশ বিক্রয় করে দিয়েছিল।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেশে ও বিদেশে প্রচুর জনপ্রিয়তার কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক ডেকে সাফ বলে দিয়েছেন, সবাই ঠিক হয়ে যান। আগামীতে বিচারের ধারা অব্যাহত রেখেই সংস্কার হবে এবং সময়মতো নির্বাচন হবে। তিনি ডিসিদের বলে দিলেন, কোনো চাপের কাছে মাথানত করা যাবে না। স্বাধীনভাবে সত্যের সাথে যার যার জেলা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তিনি আরো বলে দিয়েছেন, প্রত্যেক জেলায় প্রতিযোগিতা করে এলাকার আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। চাঁদাবাজ যে দলেরই হোক না কেন ছাড় দেয়া যাবে না।
এদেশের মানুষ সহজ-সরল। মুহাম্মদ ইউনূস ও তার উপদেষ্টাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। তাদের যোগ্যতার ঘাটতি থাকলেও যেহেতু দুর্নীতি তাদের ধরতে পারবে না। তাই আমরা মনে করি, প্রধান উপদেষ্টার অধীনে উপদেষ্টারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করে সংস্কার দ্রুত সেরে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারবেন। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করেই পর্যায়ক্রমে স্থানীয় নির্বাচন দিতে হবে। কারণ স্থানীয় সরকারের লোকজন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই আইনশৃঙ্খলা উত্তরণের জন্য ধাপে ধাপে স্থানীয় নির্বাচন করতে পারলে নির্বাচন কমিশনেরও পরীক্ষা হয়ে যাবে। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে আমরা দেশটা জনগণের দেশ বানাতে চাই।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।