জ্ঞান ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে চলছে বইমেলা


২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:২৮

॥ আব্দুল ওয়াদুদ সরদার ॥
অমর একুশে বইমেলা অনন্য বর্ণিলে সুসজ্জিত হয়ে নতুন আঙ্গিকে আবির্ভূত হয়েছে। ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান : নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য ধারণ করে ২০০২৫-এর বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১ ফেব্রুয়ারি এবারের বইমেলার উদ্বোধন করেন। মেলায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২৪-এর শহীদসহ সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অনন্য উপস্থিতি, যা সত্যিই খুব আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী।
বইমেলা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা ধারণ করে এ বইমেলা আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমৃদ্ধিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এবারের বইমেলা অতীতের তুলনায় আরও বর্ণিল এবং আকর্ষণীয় আয়োজনের মাধ্যমে সাহিত্যপ্রেমী মানুষের মন জয় করেছে।
এবারের মেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাজসজ্জায় আনা হয়েছে নতুনত্ব। প্রবেশপথ থেকে শুরু করে মেলা প্রাঙ্গণজুড়ে রয়েছে মনোমুগ্ধকর আলোকসজ্জা। প্রতিটি স্টল এবং প্যাভিলিয়ন শিল্পসম্মতভাবে সাজানো। স্টলগুলোর ডিজাইনে ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিকতার মিশেল দেখা যায়।
মেলার বিন্যাস গতবারের মতো অক্ষুণ্ন রাখে কিছু আঙ্গিকগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। মেলার বাহিরপথ মন্দির গেটের কাছাকাছি স্থানান্তর করা হয়েছে।
এছাড়া টিএসসি, দোয়েল চত্বর, এমআরটি বেসিং প্ল্যান্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অংশে মোট চারটি প্রবেশ ও বাহিরপথ রয়েছে। খাবারের স্টলগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনের সীমানা-ঘেঁষে বিন্যস্ত করা হয়েছে। খাবারের স্টলগুলো বিশেষভাবে সুবিন্যস্ত। নামাজের স্থান, ওয়াশরুমসহ অন্যান্য পরিষেবার সুব্যবস্থা রয়েছে। শিশু চত্বর মন্দির-গেটে প্রবেশের ঠিক ডান দিকে বড় পরিসরে রাখা হয়েছে, যেন শিশুরা অবাধে বিচরণ করতে পারে এবং তাদের কাক্সিক্ষত বই সহজে সংগ্রহ করতে পারে। বইমেলায় বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করছে। প্রতিদিন বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার এবং সন্ধ্যায় থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বাংলা একাডেমির তিনটি প্যাভিলিয়ন এবং শিশু-কিশোর উপযোগী প্রকাশনার বিপণনের জন্য একটি সুবিন্যস্ত স্টল। অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি এবং সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা আছে।
মেলার সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে প্রবেশ ও বাহিরপথে পর্যাপ্ত আর্চওয়ে নিরাপত্তা জোরদারে করে দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। নিñিদ্র নিরাপত্তার জন্য মেলার এলাকাজুড়ে তিন শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা রয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নিয়মিত ধুলা নিবারণের জন্য পানি ছিটানো এবং মশকনিধনের সার্বিক ব্যবস্থা রয়েছে।
এবারের বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ৪৩টি নতুন ও পুনর্মুদ্রিত করেছে ৪১টি বই। বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেডের প্রকাশিত নতুন বই সংখ্যা ১৫ এবং সর্বমোট বই সংখ্যা ৩২৮। তাদের নতুন প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘পঙ্কিলতার অবগাহন’, ‘অমর কাহিনী’, ‘ছোটদের আবু হানিফা’ ‘অমর কাহিনী’ সাবেক জজ, বিশিষ্ট কলামিস্ট ইকতেদার আহমেদ, ‘পঙ্কিলতা অবগাহন’ বইয়ের লেখক, ‘ছোটদের আবু হানিফা’ বইয়ের লেখক অধ্যাপক শাহেদ আলী।
দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার সাবেক সম্পাদক আবুল আসাদের লেখা ‘আমার দেখা একশ বছরের রাজনীতি’ নতুন মোড়কে প্রকাশ করা হয়েছে এ মেলায়। নতুন নতুন বইগুলো হাতের নাগালে পেয়ে বইপ্রেমিক পাঠক লুফে নিচ্ছে বিভিন্ন স্টল থেকে। বইপ্রেমী মানুষের ভিড় দেখে সকল প্রকাশক, লেখক ও পাঠক সন্তোষ প্রকাশ করছেন। পাঠকরা মেলায় এসে ঘুরে ঘুরে তাদের পছন্দের বই সহজে সংগ্রহ করতে পারছেন।
বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মো. হাবিবুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এবার অন্যবারের চেয়ে অধিক বই সম্মানিত পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারব, ইনশাআল্লাহ ।
বইমেলার সময়সূচি
গত ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলায় সকল স্টল খোলা থাকবে। রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না। ছুটির দিন বইমেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা শুরু হবে সকাল ৮টা রাত ৯টা পর্যন্ত।
নতুন বই এসেছে ১৫৩১টি
বাংলা একাডেমির উপপরিচালক কাজী রেহানা বেগম এবং তথ্যকেন্দ্রের প্রদত্ত তথ্যমতে জানা যায়, ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নতুন বই এসেছে ১৫৩১টি।
তথ্যকেন্দ্রের তথ্যমতে, বইমেলায় মোট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ৭০৮টি, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১৯৯টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৬০৯টি; মোট ইউনিট ১০৮৪টি (গত বছর প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৪২টি এবং ইউনিট ছিল ১৯৪৬টি)।
এবার মোট প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৭টি, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬টি; (গত বছর প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ছিল ৩৭টি)।
লিটল ম্যাগাজিন চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায় প্রায় ১৩০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়।
বিদেশি প্রকাশকদের অংশগ্রহণ
বইমেলা ২০২৫-এ দেশি প্রকাশকদের পাশাপাশি বিদেশি প্রকাশকরাও অংশগ্রহণ করেন। দেশের প্রায় ৭০০ প্রকাশনা সংস্থা তাদের নতুন বই ও প্রকাশনা নিয়ে মেলায় অংশ নেয়। এ বছর নতুন প্রকাশিত বই মেলার আকর্ষণকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক বইয়ের মধ্যে উপন্যাস, কবিতা, গল্পগ্রন্থ, প্রবন্ধ, গবেষণা, শিশুতোষ বই এবং সায়েন্স ফিকশন উল্লেখযোগ্য।
নতুন প্রকাশিত বই ও আলোচিত লেখক
এবারের মেলায় দেশের খ্যাতিমান লেখকদের পাশাপাশি নবীন লেখকদের বইও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে তার ওপর প্রকাশিত বিশেষ স্মারক বই পাঠকদের মাঝে দারুণ সাড়া জাগিয়েছে। এছাড়া সেলিনা হোসেন, আনিসুল হকসহ আরো অনেকের নতুন গ্রন্থ মেলায় ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। রিন্টুর প্রকাশিত ‘আমার ফাঁসি চাই’ বইটি পাঠকের কাছে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
এবারের বইমেলায় ইসলামিক বইপুস্তক প্রকাশক পাঠকদের সুবিধার্থে অধিক ছাড়ে তাদের প্রকাশিত বই বিক্রি করছে। যারা বিক্রি করছে তাদের মধ্যে আধুনিক প্রকাশনী, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার ও কো-অপারেটিব বুক সোসাইটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
ডিজিটাল বই ও প্রযুক্তির সংযোগ
বইমেলা ২০২৫-এর আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ডিজিটাল বইয়ের সংযোজন। অনেক প্রকাশক তাদের বইয়ের ই-বুক ভার্সন উন্মুক্ত করেছে। এছাড়া মেলায় বিশেষ অ্যাপস চালু করা হয়েছে, যেখানে বইয়ের নাম অনুসন্ধান করে সহজে স্টল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রযুক্তির এ ব্যবহার মেলায় তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে।
প্রতিদিনের কার্যক্রম ও সাংস্কৃতিক আয়োজন
মেলায় প্রতিদিন লেখক-পাঠক মতবিনিময়, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, সাহিত্য আলোচনা, কবিতা পাঠ এবং সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। শিশু-কিশোরদের জন্য আলাদা কর্নার রয়েছে যেখানে তারা গল্প শুনতে, বই পড়তে এবং চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পেরেছে।
পাঠকের উচ্ছ্বাস ও বই বিক্রি
এবারের মেলায় পাঠকদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বই কেনার প্রতি পাঠকদের আগ্রহে স্টলগুলো ছিল ব্যস্ত। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোয় মেলায় উপচেপড়া ভিড় ছিল। বই বিক্রির দিক থেকে এবার রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
অমর একুশে বইমেলা ২০২৫-এ তরুণ লেখক ও সাংবাদিক সাজ্জাদুর রহমান শুভর ক্যারিয়ারভিত্তিক বই ‘ব্র্যান্ড কারিগর-আধুনিক ব্র্যান্ডিং কৌশল’ প্রকাশিত হয়েছে। লেখক ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে এ বইটি রচনা করেছেন, যেখানে ব্র্যান্ডিংয়ের সমন্বিত বিষয় এবং আধুনিক কৌশলগুলো সহজ ভাষায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। বইটি পাঠকদের ক্যারিয়ার এবং ব্যবসাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বইমেলা ২০২৫ এক অনন্য আয়োজন, যা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। এটি শুধুমাত্র বই কেনাবেচার একটি স্থান নয়, বরং জ্ঞানচর্চার একটি কেন্দ্র, যা তরুণ প্রজন্মকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করছে। প্রতিবারের মতোই এ বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনে। রাজনৈতিক ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।