ন্যূনতম সংস্কার করেই নির্বাচন
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৬:১৫
॥ মুজতাহিদ ফারুকী ॥
দেশের চলমান রাজনীতির একজন ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল গত ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিকেলে। তার সাথে নিয়মিতই কথাবার্তা হয়। রাজনীতিক সাংবাদিকসহ সমাজের নানা মহলের যারা প্রতিদিনের ঘটনাবলির খোঁজখবর রাখেন, তাদের সঙ্গে তার ভালো রকমের যোগাযোগ আছে। তো সোমবারই কথা হচ্ছিল আগামী নির্বাচন কতদিনের মধ্যে হতে পারে, সে প্রসঙ্গে। পর্যবেক্ষক সাহেব চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে এককথায় বললেন, বেশি দেরি নেই। ইউনূস সাহেব তো এখনই নির্বাচন দিয়ে সটকে পড়তে চান। সটকে পড়া শব্দটা খট করে কানে লাগে। এড়িয়ে গিয়ে বললাম, সেটা হতে পারে বিএনপির চাপের কারণে। কিন্তু ময়দানে তো একা বিএনপি নেই। আরও দল আছে। তারা তো সংস্কার এবং গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদী দলের বিচার সম্পন্ন না করে নির্বাচন চাচ্ছে না। তাহলে?
পর্যবেক্ষক বললেন, রাজনীতির মাঠে অনেককে অনেক কথা বলতে হয়। এগুলো রাজনৈতিক বক্তৃতা। বাইরের কথা আর ভেতরের চাওয়া সবসময় মিলবে এমন কি হয়? ঘাড় নেড়ে তার মন্তব্যে সায় দিই। ওই সোমবারই বিএনপি বৈঠক করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে। সন্ধ্যায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ নিয়ে কাজ করছে সরকার। তিনি খানিকটা নিশ্চিত করেই বললেন, আগামী ১৫ তারিখের মধ্যে সরকার কিছু একটা ঘোষণা দিতে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের তফসিল বিষয়ে কোনো একটা ঘোষণা দেয়ার আশ্বাস বিএনপিকে দিয়েছেন।
এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি শনিবার আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই, এ সরকারের অযথা সময়ক্ষেপণ বা ক্ষমতায় থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রের মেরামতের ফান্ডামেন্টাল শর্ত পূরণের জন্য অতি জরুরি সংস্কারগুলো রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্পন্ন করার সাথে সাথে আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় চলে যেতে চাই। এখানে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোনো অবকাশ নেই।
অতএব দুয়ে দুয়ে চার মিলেছে। আশা করা যায়, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দেশে নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। যারা সংস্কারের পক্ষে এবং যারা খুনি, তস্কর, অর্থ পাচারকারী, নিপীড়ক স্বৈরাচারের বিচারের আগে নির্বাচন নয় বলছিলেন, তাদের এখন পুরো বিষয়ে নতুন বয়ান নিয়ে মাঠে দাঁড়াতে হবে।
২০০৬ সালের পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং ২০০৮ সালে প্রতিবেশী দেশের প্রভাবে-প্রশ্রয়ে পাতানো নির্বাচনে ক্ষমতা দখলকারী অবৈধ ফ্যাসিবাদী সরকারের দুঃশাসনমুক্ত বাংলাদেশে দীর্ঘ ১৭ বছর পর একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন অনেকটাই রাজনৈতিক চাপমুক্ত থাকবেÑ এমনটা আশা করাই যায়। তবে এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাবে না। আগামী মাসগুলোয় পরিস্থিতি কোনদিকে যায় তার ওপরই নির্ভর করবে নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ ও অবাধ হচ্ছে। কারণ নির্বাচন সম্পর্কিত সব আইনি বিধিবিধান উল্টেপাল্টে দিয়েছে পতিত স্বৈরাচার। সেসব মৌলিক বিধি-ব্যবস্থা সংস্কার না করে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে কিনা, সন্দেহ। তাই এ ন্যূনতম পর্যায়ের কিছু সংস্কার করতে হবে।
এরই মধ্যে গত ৯ ফেব্রুয়ারি রোববার বিএনপির একটি প্রতিদিধিদল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তারা ইসির নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইসির পক্ষ থেকে নির্বাচনী প্রস্তুতি চলছে জানিয়ে বলা হয়, তারা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিয়ে কাজ করতে চান না।
পর্যবেক্ষক সাহেবের সঙ্গে কথা এগোয়। তিনি ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর মন্তব্য করেছিলেন, এ সরকারকে কমপক্ষে তিন বছর সময় দিতে হবে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে সব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা এ দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য। কথাটা মনে করিয়ে দিলে তার মুখের ওপর কিঞ্চিত মেঘের ছায়া পড়ে। ম্লানমুখে বলেন, সরকার সংস্কারের জন্য এক ডজনেরও বেশি কমিশন গঠন করেছে। মাত্র ছয়টি কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্টে দুই হাজারের বেশি সুপারিশ এসেছে। বাকি কমিশনগুলোও যদি একইসংখ্যক সুপারিশ করে, তাহলে এগুলো যাচাই-বাছাই, চুলচেরা বিশ্লেষণ, অংশীজনদের সঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রশ্ন আছে। সেগুলো বাস্তবায়নেও যথেষ্ট সময় লাগবে। সুতরাং কতটা সময় লাগতে পারে, অনুমান করা একেবারে দুরূহ নয়। কিন্তু বিএনপি সেদিকে যায়নি। তারা ‘যৌক্তিক সময়ের’ মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার দাবিতে অনড়। সেই যৌক্তিক সময় কতদিন বা কত মাস, তা তারা নিজেরাও জানে না। তাদের অন্যতম সক্রিয় নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খানও এ কথা স্বীকার করেছেন।
বললাম, বিএনপির তাগিদে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন দিয়ে দায় সারতে চাইলে সেটা অন্য দলগুলো মেনে নেবে? বিশেষ করে ড. ইউনূসের ভাষায়, যে ছাত্ররা তাকে দায়িত্বে বসিয়েছে, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ বা তাদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটি? কী মনে হয়? তিনি হাসেন। শুধু তো নাগরিক কমিটি নয়, ছাত্রদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন হতে যাচ্ছে। তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সেটির প্রধান হতে যাচ্ছেন। ইসলামী দলগুলোও আছে। আছে গণফোরাম, গণঅধিকার ফোরাম বা অন্যসব ছোট দলও।
হ্যাঁ, তো তারা কি ছাড়বে প্রধান উপদেষ্টাকে? বিশেষত বৃহত্তম ও আন্দোলন-সংগ্রামের সুসংগঠিত শক্তি জামায়াতে ইসলামী?
পর্যবেক্ষক সাহেব উত্তর দেয়ার আগে আমি তাকে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমানের সাম্প্রতিক কয়েকটি মন্তব্য শোনাই। যদিও তিনি সবই জানেন। আমি বলি, ডা. শফিক বলেছেন, অবিচারের শিকার হয়ে আমাদের ১১ জন কলিজার টুকরা শীর্ষনেতা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাদের বিচারের নামে ঠাণ্ডামাথায় হত্যা করা হয়েছে। আমরা প্রতিশোধে বিশ্বাস করি না, তবে আমাদের কথা স্পষ্ট। সবগুলো খুনের বিচার হতে হবে। বিশেষ করে ২৪-এর গণহত্যার বিচার অবশ্যই হতে হবে। আগে বিচার, তারপর অন্য কাজ।
আমি তাকে জামায়াতের অন্য কজন নেতার বক্তব্যও শোনাই। দলের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একসাথে চালাতে হবে। নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার করতে হবে।’
নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেছেন, আওয়ামী লীগের বিগত ১৭ বছরের জঞ্জালমুক্ত না করে জাতি নির্বাচন চায় না। জঞ্জালমুক্ত না করে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারের আগেই নির্বাচন দিলে, সেটি বিতর্কিত হবে।
একই ধরনের বক্তব্য আরও কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। পর্যবেক্ষক সাহেব বলেন, তাতে সমস্যা কি? দেখেননি, বিএনপির নেতারা কী বলেছেন!
কোন নেতারা?
শুনুুন, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গত ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার সারা দেশে কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে বলছেন, সহস্রাধিক মানুষ হত্যা, হাজার হাজার পঙ্গু ও আহত হওয়ার বর্বরোচিত ঘটনা এবং ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার সঠিক বিচার না হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়বে অনিশ্চিত। আরও বলেছেন, সচিবালয়ে গিজগিজ করছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার প্রেতাত্মারা। পুলিশ-প্রশাসন-আদালতে তারাই সবকিছু করছে। অবিলম্বে ফ্যাসিস্টদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে আবারো হাসিনার দোসরদের পরাস্ত করা কঠিন হবে।
হ্যাঁ, এ কথাটা তো ঠিকই বলেছেন। স্বৈরাচারী শাসনে তারা আন্দোলনের মাঠে কোনো সভা-সমাবেশ করতে পারেননি। এখন মুক্ত পরিবেশে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা করবেনÑ এটাই স্বাভাবিক নয় কি? আর গণতান্ত্রিক দল হিসেবে তারা সবার আগে নির্বাচনের দাবি তোলার পাশাপাশি স্বৈরাচারের বিচারের দাবি তুলতেই পারেন। তারা জানেন, এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিএনপির নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত। কিন্তু সরকারের ভেতর থেকে নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় তারা উদ্বিগ্ন। সেটি তারা গোপনও করেননি। এটিকে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘতর করার প্রক্রিয়া বলে সন্দেহ করছেন। সেই ভীতি থেকেই তারা যদি চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে দেশজুড়ে জনসভার কর্মসূচি দেন, সে তো অন্যায় কিছু নয়।
তা নয়, তবে দলের নেতাদের বক্তব্যে ভিন্নতা দেখা গেলে এবং দলের অবস্থান গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়লে তা দলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। দলটির নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে এরই মধ্যে নানা কথা উঠতে শুরু করেছে। মেলার আয়োজনে প্রভাব বিস্তার নিয়ে বগুড়ায় একজন নিহতও হয়েছে। এসব বিষয় জনগণের রাডারের বাইরে থাকছেÑ এমন ভাবার কারণ নেই।
কিন্তু তারা তো মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ঐতিহ্য ও ’৭১-এর চেতনা নিয়ে এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ও ঘোষণা করেছেন। অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের কথা বলছেন। এসব কি নির্বাচনে তেমন কোনো সুবিধা দেবে না দলটিকে।
দেবে। আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনের মাঠে না থাকে, তাহলে আওয়ামী ও বামদের বেশকিছু ভোট বিএনপির পক্ষে আসতে পারে। আবার কিছু ভোট কমতেও পারে। যারা শহীদ জিয়ার সমন্বয়ের রাজনীতি এবং সংবিধানে আল্লাহর প্রতি আস্থার সংযোজনের কারণে দীর্ঘসময় ধরে দলকে ভোট দিয়েছেন তারা সরে যেতে পারেন। এদের সংখ্যা সম্ভবত খুব কম নয়।
তো আপনি বলছেন, সংস্কার ইত্যাদি আর কার্যত হচ্ছে না?
হচ্ছে, যতটুকু না হলে নয়। এটাকে সংস্কার না বলে ফুটো কাপড়ে তালি মারা বলতে পারেন।
কিন্তু বেশিরভাগ দল যদি সংস্কারের পক্ষে মত দেয়, তাহলে প্রধান উপদেষ্টা কি এককভাবে বৃহত্তম দল হিসেবে বিএনপির ইচ্ছা পূরণ করতে পারবেন?
পর্যবেক্ষক সাহেব ভিন্ন দিকে আমার নজর ফিরিয়ে দেন। জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি জানেন, জামায়াত কতগুলো আসনে নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই শুরু করেছে? বললাম, কত আসনে জানি না, তবে পত্রিকায় খবর দেখেছি, দলটি প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে এবং খুব একটা পিছিয়ে নেই। বিএনপিও শুনেছি পুরোদমেই কাজ করছে।
হ্যাঁ, নির্বাচনী ডামাডোল শুরু হলে বৃহত্তর বোঝাপড়ার দরকার হবে। কার সাথে কার ঐক্য জরুরি, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ দলগুলো নিজের গরজেই করবে।
বিএনপি আওয়ামী ভোট টানার জন্য তাদের চেতনা ধারণ করছেÑ এমন একটা কথা হাওয়ায় ভাসছে।
সেটা হাওয়ায় ভাসুক। বাস্তবের কথা হলো, বৃহত্তম এ দলটিকে ক্ষমতায় যেতে ও টিকে থাকতে হলে বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে ন্যূনতম বোঝাপড়ায় যেতে হবে, সেটা সবাই বোঝে। আবার উত্তরের বৃহৎ মিত্রকেও ছাড়লে চলবে না। একই কথা জামায়াত বা সম্ভাব্য বিরোধীদলগুলোর ক্ষেত্রেও। তবে দেশের জনগণের চিন্তা-চেতনাকে যারা সত্যিকার অর্থে ধারণ করবে, জনগণের অন্তরের চাওয়া বুঝতে পারবে, তারাই হবে বিজয়ী। সেটা শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয় নয়। গত আগস্টে পতিত সরকার সেটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে এবং অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, শক্তিমত্তা সবকিছু ব্যবহার করেও নিজের মহাপতন ঠেকাতে পারেনি। এর চেয়ে বড় এবং তাৎক্ষণিক শিক্ষা এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আর কী হতে পারে?