জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মার্কিন প্রভাবের অভিযোগ, ওয়াশিংটনের অস্বীকার
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:৪৬
॥ ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া ॥
বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি ও সরকার পরিবর্তনে বিদেশি শক্তির প্রভাব নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন আলোচনা হয়, তা মাঝে মাঝে সংবাদমাধ্যমেও এক্সক্লুসিভ খবর হয়ে থাকে। উন্নত বিশ্বে সরকার পরিবর্তন হয়ে থাকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতি শক্তিশালী না হওয়ায় অন্য প্রক্রিয়ায় সরকার পরিবর্তন হয়ে থাকে। যেমন সামরিক ক্যু, গণঅভ্যুত্থান বা সর্বাত্মক বিপ্লব। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে শেখ মুজিব সরকার থেকে শুরু করে ড. ইউনূস সরকার পর্যন্ত অনেকগুলো সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সবগুলো সরকার গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিবর্তন বা ক্ষমতা গ্রহণ হয়নি। ড. ইউনূসের যে সরকার, তা গঠিত হয়েছে একটি সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এ গণঅভ্যুত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘটিয়েছে এমন অভিযোগ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই করে আসছেন। সর্বশেষ গত ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থাও বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার পরিবর্তনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার বিষয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মাত্র ছয় দিন পর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের উদ্দেশে এক বার্তায় বলেছেন, তাকে উৎখাতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিদেশি শক্তির হাত আছে। ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট তার এ বক্তব্য দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে। দ্য প্রিন্টের বরাতে বাংলাদেশের অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ‘সরকার উৎখাতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র, শিগগিরই ফিরব : শেখ হাসিনা’- এ শিরোনামে ১১ আগস্ট এ খবরটি প্রকাশ করে। বিডিনিউজের খবরটিতে লেখা হয়েছে, ‘প্রবল গণআন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অবশেষে নীরবতা ভেঙেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, তাকে উৎখাতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিদেশি শক্তির হাত আছে। হাসিনা আরো বলেন, ‘সেন্টমার্টিন আর বঙ্গোপসাগর আমেরিকার হাতে ছেড়ে দিলে আমি ঠিকই ক্ষমতায় থাকতে পারতাম।’
দ্য প্রিন্ট লিখেছে, দেশে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের উদ্দেশে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন শেখ হাসিনা। সেখানেই তিনি ওই অভিযোগ করেছেন। ১৫ বছর বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকাকালে একই ধরনের অভিযোগ বহুবার করেছেন শেখ হাসিনা। ২০২৩ সালের মে মাসে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
গত বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এক ‘শ্বেতাঙ্গ’ ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি একটি প্রস্তাব পেয়েছেন। তাকে বলা হয়েছিল, বিমানঘাঁটি করতে দিলে তিনি সহজে ক্ষমতায় আসতে পারবেন।
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন আগস্টের শুরুতে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। জেলায় জেলায় সহিংসতায় মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রায় তিনশ মানুষের প্রাণ যায়।
৫ আগস্ট আন্দোলনকারীদের ঢাকামুখী লংমার্চের মধ্যে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর আসে। সেদিন বিকালে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সাংবাদিকদের বলেন, পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রথমে হেলিকপ্টর ও পরে সামরিক বিমানে চড়ে আগরতলা হয়ে সেদিন রাতেই দিল্লি পৌঁছান বাংলাদেশের টানা ১৫ বছরের প্রধানমন্ত্রী। এখনো তিনি সেখানেই আছেন।
প্রিন্ট লিখেছে, ভারত সরকারও ইতোমধ্যে বলেছে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের পেছনে ‘বিদেশি হাত’ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাঠানো বার্তায় শেখ হাসিনা এ ধরনের বিদেশি শক্তির দ্বারা ‘ব্যবহৃত’ না হওয়ার জন্য নতুন অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘লাশের মিছিল যাতে দেখতে না হয়, সেজন্য আমি পদত্যাগ করেছি। তোমাদের (শিক্ষার্থী) লাশের ওপর দিয়ে তারা ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। আমি তা হতে দিইনি।’
সমর্থকদের উদ্দেশে পাঠানো বার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, হয়তো তাকে হার মেনে নিতে হয়েছে, কিন্তু তিনি অচিরেই দেশে ফিরবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। আপনাদের বিজয়ে আমি (ক্ষমতায়) এসেছিলাম, আপনারা ছিলেন আমার শক্তি। আপনারা যখন আমাকে চাননি, আমি তখন নিজে থেকে সরে গেছি, পদত্যাগ করেছি।’
‘আমার যারা কর্মী দেশে আছেন, তারা কেউ মনোবল হারাবেন না। আওয়ামী লীগ বার বার ওঠে দাঁড়িয়েছে।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে শেখ হাসিনার যে বক্তব্য ক্ষোভ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই বক্তব্য বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছে বলে আবারও অভিযোগ করেছেন শেখ হাসিনা।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমার তরুণ ছাত্রদের আমি আবারও বলতে চাই, তোমাদের আমি কখনোই রাজাকার বলিনি। আমার কথা বিকৃত করা হয়েছে। তোমাদের বিপদে ফেলে একটি চক্র ফায়দা নিয়েছে।’ দ্য প্রিন্টের খবরটি প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনার এ ধরনের অভিযোগকে ওয়াশিংটন বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। এ বিষয়ে হোয়াইট হাউস গত ১২ আগস্ট এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছে, শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতিতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয়। প্রথম আলো পত্রিকা ১৩ আগস্ট ‘শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতিতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয় : হোয়াইট হাউস’ এক খবর প্রকাশ করে বলেছে, ‘শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে, এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে ওয়াশিংটন। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি কারিন জ্যঁ-পিয়েরে গত ১২ আগস্ট সোমবার ওয়াশিংটনে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, এমন অভিযোগ ডাহা মিথ্যা।
ব্রিফিংয়ে কারিন জ্যঁ-পিয়েরেকে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন, তাকে ক্ষমতা থেকে সরতে বাধ্য করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আছে। বাংলাদেশের একটি দ্বীপ ওয়াশিংটনের হাতে তুলে না দেওয়ার কারণে তার (শেখ হাসিনা) এমন পরিণতি। দ্বীপটি দিতে রাজি হলে তিনি হয়তো ক্ষমতায় টিকে যেতেন। এমন অভিযোগের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া কী?
জবাবে কারিন জ্যঁ-পিয়েরে বলেন, ‘এসবের পেছনে আমরা জড়িত নই। মার্কিন প্রশাসনের জড়িত থাকা নিয়ে যেকোনো প্রতিবেদন বা গুঞ্জন ডাহা মিথ্যা, একদমই সত্য নয়।’
কারিন জ্যঁ-পিয়েরে আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের জন্য এ পছন্দ বেছে নিয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে সরকারের ভবিষ্যৎ দেশের মানুষই নির্ধারণ করবেন। এটাই আমাদের অবস্থান। তাই এমন কোনো অভিযোগ করা হলে আমি এখানে যা বলেছি, সবসময়ই তা বলব, এটা একদমই সত্য নয়।’
এদিকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদলু এজেন্সি USAID alleged to have fueled regime change in Bangladesh অর্থাৎ ‘বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনে ইউএসএইডের সহায়তার অভিযোগ’- এ শিরোনামে এক রিপোর্টে লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেছেন, গত বছর ২০২৪-এ বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএইড)-র আর্থিক সহায়তা করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা মাইক বেঞ্জ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনেই গত জুলাই মাসে ব্যাপক প্রতিবাদ ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন ঘটে এবং শেখ হাসিনাকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়।
মি. মাইক বেঞ্জ এক্স প্ল্যাটফর্মের ডানপন্থি কলামিস্ট মি. টাকর কার্লসনের সাথে আলাপকালে দাবি করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ইউএসএইড সমর্থিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) পরিকল্পনামাফিক বাংলাদেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে তোলা হয়।
আনাদলু ঐ কর্মকর্তার বরাতে লিখেছে, আইআরআই এ রাজনৈতিক প্রতিবাদ বিক্ষোভে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংখ্যালঘু গ্রুপ, ছাত্র ও যুবকদের সহায়তা করে যারা ইতোপূর্বে স্থানীয় রাজনৈতিক ইস্যুতে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছিল। অপরদিকে এ কাজে তারা ১৭০ গণতন্ত্রপন্থি অ্যাক্টিভিস্ট ও ৩০৪ ইনফরমারের সহযোগিতা নিয়েছে। তিনি জানান, এ আন্দোলনে অনেকগুলা র্যাপ গ্রুপ নাচ-গান ও ভিডিও তৈরি করে সাধারণ জনগণকে রাস্তায় আন্দোলন-সংগ্রাম করতে উদ্ধুদ্ধ করে।
তিনি জানান, আন্দোলনকারীরা ইউএসএইডের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে এবং তারা মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শতভাগ আর্থিক সহায়তা পেয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত বিশ্বের বড় পরাশক্তিগুলো তৃতীয় বিশ্বে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনে অতি সংগোপনে সরকারবিরোধী শক্তিগুলোকে সহায়তা অনেক ক্ষেত্রে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য সহায়কও হয়ে থাকে। যখন কোনো দেশে ক্ষমতাসীন দল স্বৈরাচার তথা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে, তখন বিদেশি শক্তির সহায়তায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সহায়তা নেয়াটা বৃহত্তর স্বার্থে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। তবে তা হতে হবে দেশ জাতির উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে।