অর্থনীতিতে গতি ফিরছে
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:৪৫
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বন্ধু বিনিয়োগ করছেন ৭ বিলিয়ন ডলার
॥ উসমান ফারুক॥
জাতীয় রফতানি ট্রফি পাওয়া তৈরি পোশাক খাতের রফতানিমুখী কোম্পানি শাশা ডেনিমস নতুন কারখানা খোলার পাশাপাশি ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাড়ছে সরকারি-বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ, বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি আসছে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের। গণআন্দোলনে ফ্যাসিস্ট উৎখাতের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে দেশ গোছানোর কাজে সহযোগিতা বাড়িয়ে চলেছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন বা প্রাণভোমরা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া রেমিট্যান্স প্রায় ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে গত ৭ মাস ধরে। একইভাবে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক আয়ের আরেক উৎস রফতানি খাত ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। দুই বছর আগেও এ সময়ে যা ছিল প্রায় দেড় শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। নতুন নতুন বিনিয়োগ শুরু করেছেন দেশীয় ব্যবসায়ীরা। ফ্যাসিস্ট সরকারের রেখে যাওয়া অর্থনীতির বড় মাথাব্যথার কারণ উচ্চহারের মূল্যস্ফীতি প্রথমবারের মতো লাগাম টেনে দুই অঙ্কের নিচে নেমেছে। সাধারণ ও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে সাত মাসে এসে। সর্বশেষ গত জুনে আওয়ামী লীগ সরকার যখন নতুন অর্থবছরের বাজেট দিল, তখনো অর্থনীতি ভালো অবস্থায় ছিল না। গত জুুলাই-আগস্টের আন্দোলন, নজিরবিহীন অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের দেশ থেকে পলায়ন ও ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর তাদের রেখে যাওয়া দুরবস্থার অর্থনীতি গত ৭ মাসে ধীরে ধীরে সামলে উঠতে শুরু করেছে।
সামষ্টিক অর্থনীতির ২২টি সূচকের প্রায় পুরোটাই ইতিবাচক হয়েছে নানা উদ্যোগে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নানামুখী উদ্যোগে অর্থনীতির ব্লাড সাপ্লাইখ্যাত ব্যাংকে টাকার প্রবাহ বাড়তে শুরু করার সুফল আগামী কয়েক মাসে আরো দৃশ্যমান হবে। লুটপাট, অর্থ পাচার ও অনিয়মে ডুবতে থাকা আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে। আর্থিক খাত ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে গত ১৫ বছরের জঞ্জাল সাফ করে।
অর্থনীতিতে সম্পৃক্ততা বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের
১৯৮৯ সালে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুরুর পর থেকে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। সেই সাথে রফতানির ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। বাংলাদেশের মোট রফতানির ১৭ থেকে ২০ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বড় ক্রেতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের ২০ শতাংশ। সেই দেশ থেকে এবার একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মাধ্যমে আসছে সাত বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ।
সরকার গঠন করার পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও হাইগ্রাউন্ড হোল্ডিংসের প্রধান নির্বাহী ব্যবসায়ী জেনট্রি বিচ বাংলাদেশ সফর করেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিশেষ বৈঠকও করেছেন গত ৩০ জানুয়ারি। বাংলাদেশের জ্বালানি, গ্যাস, প্রতিরক্ষা, আবাসন ও চিকিৎসা খাতসহ বিভিন্ন খাতে সাত বিলিয়ন ডলার বা ৭০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ হবে- ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও ফ্যাসিস্টদের দোসরদের এমন প্রচারণার মধ্যেই সাত বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের খবর এলো।
বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন দেশীয় ব্যবসায়ীরা
গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকার ও আওয়ামী দুঃশাসনকে উৎখাত করে বাংলাদেশের সর্বস্তরের ও পেশার মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ থেকে গোপনে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে। এ দেশটি বরাবরই আওয়ামী লীগকে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। বাংলাদেশের গত সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসন, লুটপাট, অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, রাষ্ট্রযন্ত্রকে দুর্বল করার আওয়ামী সব প্রচেষ্টার একক মদদদাতা দেশ হচ্ছে ভারত। ভারতীয় দালাল হিসেবে রাজনীতিতে পরিচিতি পাওয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত তা প্রমাণও করলেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের কর্মী এখন ভারতে অবস্থান করছে।
এখন ওই দেশে বসেই ফেসবুক ও বিভিন্নভাবে পরিচয় গোপন করে ভুয়া নামে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিরূপ প্রচারণা শুরু করেছে। এতে উৎসাহ দিচ্ছে এদেশীয় ভারতীয় দালাল ও আওয়ামীপন্থী তথাকথিত সুশীলরা। অথচ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ গঠনে এগিয়ে এসেছেন সর্বস্তরের ব্যবসায়ীরা। নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি পেয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে শুরু করেছেন তারা।
জাতীয় রফতানি ট্রফি পাওয়া তৈরি পোশাক খাতের রফতানিমুখী কোম্পানি শাশা ডেনিমস নতুন কারখানা খোলার পাশাপাশি ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন, ব্যবসা বাড়াতে ঢাকা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে ২১০টি নতুন লুমের একটি কারখানা তৈরি করা হবে। এ বিনিয়োগে প্রায় সোয়া কোটি ডলারের আয় বাড়বে তাদের। পাশাপাশি আরও একটি পোশাক কারখানায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
শাশা ডেনিমসের তিনটি ডাইং ইউনিটে বর্তমানে ১ হাজার ৬০০ কর্মী কাজ করছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ কোম্পানির বার্ষিক আয় ছিল ৭৮৮ কোটি টাকা। নতুন বিনিয়োগে বছর শেষে ৪০০ কোটি টাকার টার্নওভার বাড়বে এবং দুই হাজার ব্যক্তির নতুন কর্মসংস্থান হবে। ইতোমধ্যে ১৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ শুরু করেছে কোম্পানিটি। ধীরে ধীরে পুরোটা বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে কোম্পানিটি।
একইভাবে ব্যবসা বাড়াতে নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রি। প্রতিষ্ঠানটি গার্মেন্টস ও উৎপাদন খাতের কারখানা স্থাপনে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ৩১৮ শতাংশ জমি লিজ নিয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় তা বিনিয়োগকারীদের জানিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে।
এজন্য আমদানি চিত্রও বদলে যেতে শুরু করেছে। গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দুই দশমিক ৬৫ শতাংশ বেড়েছে সার্বিক আমদানি চিত্র। দেশ শিল্পায়নের দিকে যাচ্ছে কিনা, তার সবচেয়ে বড় মানদণ্ড হচ্ছে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি চিত্র। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, দেশ থেকে রফতানি কেমন হবে। এ এলসি বৃদ্ধি পাওয়া মানে তৈরি পোশাক খাতে রফতানি আদেশ যথেষ্ট আছে। গত ছয় মাসে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির পরিমাণ হচ্ছে ৫১ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। এটি গত অর্থবছরের ছয় মাসের তুলনায় ২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত নভেম্বর মাসেও অভ্যন্তরীণ খাতে ঋণপ্রবাহে প্রবৃদ্ধি রয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত বছরের এই সময়ে যা ছিল মাত্র ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। শুধু বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ, গত অর্থবছরের এ সময়ে ছিল মাত্র তিন দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর মানে হচ্ছে, আওয়ামী দুঃশাসনের সময়ে লোকদেখানো-বানোয়াট তথ্যের চেয়েও বিনিয়োগ বাড়ছে দেশে। গত ৫ মাসে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়েছে ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা। অথচ গত কয়েক মাসেও এখাতে বিনিয়োগ ঋণাত্মক ছিল।
দেশের রফতানি খাতের সর্বশেষ তথ্য দিয়ে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বলেছে, দেশের রফতানি আয়ে ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। গত সাত মাসে তৈরি পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি রয়েছে ১২ শতাংশ। এ সময়ে দেশ থেকে তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে ২৩ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসেও পোশাক খাতে রফতানি প্রবৃদ্ধি দেখা দেয় ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে উন্নীত হয়েছে। গ্রস হিসাবে তা এখন ২৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্সের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের গত ৭ মাসে প্রবাসীরা দেশে মোট ১৫ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। গত ছয়-সাত মাস ধরে গড়ে প্রতি মাসে দুই বিলিয়ন ডলার বা ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন তারা। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশে এসেছিল ১২ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স।
অর্থনীতির সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় যাওয়ায় চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও উন্নতি হচ্ছে। চলতি হিসাবে গত বছরের জুনেও ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৬০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সেই ঘাটতি কমে এখন মাত্র ২২ কোটি ৬০ লাখ ডলারে নেমেছে। চলতি হিসাবে ঘাটতি শূন্যতে নামলে টাকার মান বাড়বে। বৈদেশিক বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশকে আর ডলার ধার করতে হবে না।
বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত জুলাই-আগস্টের ধাক্কায় অর্থনীতি একটু হোঁচট খেয়েছিল। তার প্রভাব এখনো আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আদায়ে। বরাবরের মতো এবারো লক্ষ্যমাত্রার পেছনে রয়েছে। তবে অর্থনীতি সুুশৃঙ্খলতার দিকে যাওয়ায় আওয়ামী সরকারের মতো ব্যাংক থেকে তত বেশি ধার করতে হচ্ছে না বর্তমান সরকারকে। বৈদেশিক বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হারও একটু কমেছিল ঠিকাদারদের পলায়ন করায়। এখন সব সামলে অর্থনীতির ২২টি সূচকের অধিকাংশই ভালোর দিকে রয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে রফতানি আয় ও কর্মসংস্থানেও। আওয়ামী মদদপুষ্ট কয়েকটি গণমাধ্যম অর্থনীতির ছন্দ ফেরার গল্পগুলো বিকৃতভাবে প্রকাশ করছে। তাতে সমর্থন জোগাচ্ছে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হওয়া ব্যবসায়ীরা। ষড়যন্ত্র সামাল দিতে সরকারের উচিত হবে, অর্থনীতির সার্বিক চিত্র নিয়ে প্রতি মাসে একবার করে আনুষ্ঠানিকভাবে জনগণকে জানানো। এতে সরকারের উদ্যোগের সফলতা জানতে পারবে দেশবাসী।