কমাতে হবে সরকারি ব্যয়, রাজস্ব বাড়াতে করজাল সম্প্রসারণ করতে হবে

সাহসী নেতৃত্বেই ঘুরবে অর্থনীতি


৩১ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০০

॥ উসমান ফারুক॥
এক দশক ধরে সরকারে এক পরিবার ক্ষমতায় থাকায় অর্থ পাচার, ভুল নীতি ও আর্থিক অব্যবস্থাপনায় বিপর্যস্ত হয়ে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির শিখরে চলে যায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে একটানা ২৬ বছর গৃহযুদ্ধের ধকল সামলে ওঠা দেশটি সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ২০২২ সালে। সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকটে কাগজের অভাবে ছাত্রদের পরীক্ষা পর্যন্ত বাতিল করতে হয়। জ্বালানির অভাবে দীর্ঘসময় চলেনি গাড়ি। গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন সরকারের নেতৃত্বে সেই শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে ছয় মাসের ব্যবধানে। দুই বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখা দেয় ৬ শতাংশ। অর্থ পাচার বন্ধ, সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনা, করের আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব সংগ্রহ জোরদার করা, প্রবাসে কর্মী পাঠিয়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও পর্যটন খাত সমৃদ্ধ করে রিজার্ভ বাড়াতে সক্ষম হয় দেশটি। এতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশে নামিয়ে আনে, বর্তমানে তা আড়াই শতাংশ। অন্যদিকে একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের নতুন সরকারকে ছয় মাসেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে। ডলার সংকটের বিষয়টি এখনো রয়ে গেছে।
বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, বাংলাদেশ অর্থ পাচার বন্ধ করায় সফল হলেও সরকারি ব্যয় সেভাবে কমিয়ে না আনায় ডলার সংকট কাটেনি। বাজেটে ভর্তুকি কমিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়াতে করজাল বাড়ানোর যে পদক্ষেপ নিয়ে সফলতা পেয়েছে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এখনো সেই নীতি গ্রহণ করেনি। এখনো বাজেট ঘাটতি ধরে রেখেছে। ঘাটতি মেটাতে ভ্যাট বাড়ানোর পথে হাঁটছে সরকার। সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনা, রাজস্ব সংগ্রহে করজাল বৃদ্ধি, ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারলে সরবরাহ ব্যবস্থায় উন্নতি করে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সবকিছু উপেক্ষা করে প্রকৃত অবস্থা বিশ্লেষণ করে সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার। সরকারের নেতৃত্বে থাকা উপদেষ্টাদের সেই সক্ষমতা রয়েছে। প্রয়োজন প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন। তাহলেই আর্থিক স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব অল্প সময়ের মধ্যে।
বাংলাদেশেও দেড় দশক ক্ষমতায় থেকে রেকর্ড অর্থ পাচার, ব্যাংক ঋণের সুদহার নিয়ে নয়-ছয়, দুর্নীতি, অপচয়, উচ্চ সুদের বিদেশি ঋণে অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প নেওয়া, জ্বালানি তেলের দর একবারেই ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি, বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, গুম-খুন, ঋণ কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত হয়ে পড়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার ও শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যরা।
মূল্যস্ফীতি বাস্তবে ২৫ শতাংশের ঘর অতিক্রম করে। এরকম পরিস্থিতি খাদের কিনারায় চলে যায় বাংলাদেশের অর্থনীতি। টাকার মান ডলারের বিপরীতে ৮০ টাকা থেকে নেমে চলে যায় ১২৫ টাকায়। সবপর্যায়ে দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে দেশের সবপর্যায়ের জনগণ। ছাত্র-জনতার বিপ্লবে শ্রীলঙ্কার মতো গত বছরের ৫ আগস্ট উৎখাত হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে থাকা ফ্যাসিস্ট সরকার। ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতে ঠাঁই নেন শেখ হাসিনা। সঙ্গে যায় তার অনুসারী ও নেতাকর্মীরা। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার ছয় মাস হতে চললেও শ্রীলঙ্কার মতো একই ধরনের সমস্যায় ভোগা বাংলাদেশের অর্থনীতি থেকে মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকটের বিষয়টি এখনো রয়ে গেছে।
যেভাবে ঘুরে দাঁড়ায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি
২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহ দমনের সাফল্যে শ্রীলঙ্কায় মহানায়ক হয়ে উঠছিল ২০২২ সালে গণআন্দোলনে দেশ ছেড়ে পালানো প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে। তখন প্রতিরক্ষা সচিব ছিলেন তার ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর তারা দুই ভাই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হন। পরিবার থেকেই আরও মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
এভাবে এক দশক ধরেই সরকরের ক্ষমতা একটি পরিবারের মধ্যে ছিল। আকুণ্ঠ ক্ষমতায় ধীরে ধীরে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয় দেশটির সরকার। রাজাপাকসে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনারও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন ২০২১ সালে। শেখ হাসিনাকে সমর্থনের ফল স্বরূপ অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কাকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয় কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, খাদ্য ঘাটতি ও শ্রীলঙ্কার মুদ্রার কয়েক গুণ অবমূল্যায়ন হয়ে যায়।
সরকারি দলের নেতা ও আমলাদের অর্থ পাচার এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় যে, দেশটি বিদেশি ঋণের খেলাপি হয়ে যায়। বাকিতে আমদানি দায় মেটানোর সংগঠন এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (আকু) সদস্যপদ হারায়। এভাবে পারিবারকেন্দ্রিক ক্ষমতায়নের কারণে রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানই দাঁড়াতে পারেনি। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ছেয়ে গিয়েছিল দেশটিতে। অর্থনৈতিক সংকটে অচল হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম তখন আকাশ ছুঁয়ে জ্বালানি সংকট চরমে পৌঁছায়। পেট্রল পাম্পগুলোয় অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। জন-অসন্তোষ চরমে ওঠে। এমন অবস্থায় দেশটির জনগণের আন্দোলন তীব্র হলে তা দমনের চেষ্টায় ব্যর্থ হয় সরকার। গণরোষে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার ভাই প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসে। দেশ ছেড়ে গোপনে চলে যান সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও সরকারের সুবিধাভোগীরা।
এরপর দায়িত্ব নেন রনিল বিক্রমাসিংহে। ক্ষমতায় এসেই দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার বিশেষজ্ঞ ব্যাংকার নন্দনাল ওয়ারাসিংহাকে। তাকে দেওয়া হয় স্বাধীনতা। সরকারের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে তিনি কয়েকটি সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করেন। অর্থ পাচার পুরোপুরি বন্ধ ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার একটি জায়গায় স্থির করার মতো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। এতে জাদুকরী ফল পাওয়ায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
ছয় মাসে মূল্যস্ফীতি নেমে আসে ৬ শতাংশে, বর্তমানে তা আড়াই শতাংশের ঘরে। চরম সংকটের সময়ে ২০২২ সালের জুলাই মাসে যা ছিল সর্বোচ্চ ৬৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে প্রবাসী শ্রমবাজার উলম্ফন করেন তিনি। এতে এক বছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে ৭৬ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স আসে। শ্রীলঙ্কা প্রথম ধাপে সরকারি ব্যয় কমিয়ে এনে ভর্তুকি সুবিধা বাতিল করে ধীরে ধীরে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে পর্যটন খাত চাঙা করেন। রেমিট্যান্স ও পর্যটনের আয় দিয়ে রিজার্ভ বাড়তে শুরু করলে ঘুরতে শুরু করে অর্থনীতির চাকা। যার ফলে দীর্ঘ মেয়াদে ডলারের বিপরীতে শ্রীলঙ্কান রুপি ৩৬৩ থেকে ২৯৭ রুপিতে নেমে আসে।
এভাবে সংকট মোকাবিলা করে নায়কের ভূমিকায় নাম লিখিয়েছেন দেশটির গভর্নর। এসব করতে বড় ধরনের আর্থিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে দেশটি। দুই বছরের মধ্যে বিদেশি ঋণের খেলাপি তালিকামুক্ত হয় শ্রীলঙ্কা।
আর্থিক সংস্কারে গিয়ে দেশটি অর্থনীতিকে পুরোটাই ঠিক করে ফেলে দুই বছরের মধ্যে। দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদে বেশকিছু নীতিগত পদক্ষেপ নেয় জনগণের সমর্থনে ক্ষমতায় যাওযা নতুন সরকার। এক বছরের মধ্যে এর ফল পেতে শুরু করে দেশটি। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, শ্রীলঙ্কা সরকার সব ধরনের সরকারি ব্যয় কমিয়ে নেয়। সর্বশেষ বছরেও বাজেট কমিয়েছে ৬ শতাংশ। অন্যদিকে বাজেট ঘাটতি কমাতে ভর্তুকি কমিয়ে এনেছে। রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে করজাল বিস্তৃত করেছে। মূলত এ নীতিপদক্ষেপের ফলেই ঘুরতে শুরু করে দেশটির অর্থনীতির চাকা।
কী করছে বাংলাদেশ
ভুল নীতি, আর্থিক অব্যবস্থাপনা ও অর্থ পাচারের মতো সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হলে নেতৃত্বের পরিবর্তন আনে শ্রীলঙ্কার জনগণ। আর্থিক খাতে নতুন নেতৃত্ব আসার পরই ছয় মাসের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। বাংলাদেশের চেয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকা দেশটির জনগণও ছয় মাসের মধ্যে মুক্তি পায়। এরপরই অর্থনীতির অন্যান্য সূচক ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও একই অবস্থা নিয়ে খুব একটা এগোতে পারছে না বাংলাদেশ। এর পেছনের কারণ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও নানারকম বিশ্লেষণ চলছে। অবশ্য সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কিছুটা সুফল পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থ পাচার বন্ধ হওয়ায় রেমিট্যান্স বেড়েছে। বিনিময় হার উচ্চ দরে স্থিতিশীল রয়েছে অর্থাৎ আর বাড়েনি। আর্থিক খাত সংস্কারে শ্বেতপত্র প্রকাশ। রাষ্ট্রযন্ত্র ও আর্থিক খাত সংস্কারে একাধিক টাক্সফোর্স গঠন করা। এর মধ্যে ৫টি টাক্সফোর্স ও কমিশনের রিপোর্ট জমা হয়েছে। অবশ্য আর্থিক খাতের কোনো সংস্কারের সুপারিশ এখনো আসেনি।
অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বিশ্লেষকরা বলেছেন, শ্রীলঙ্কার মতো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ বাংলাদেশও নিয়েছে। তারপরও এখনো বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট যায়নি। যার কারণে সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি রয়েই গেছে। অর্থনীতির রক্তক্ষরণ হওয়া অর্থ পাচার ও ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাটের মতো বিষয়গুলো অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। এ কারণে রেমিট্যান্সপ্রবাহ দিন দিন বাড়ছে। অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্যে থাকা বাংলাদেশকে অতিদ্রুত বাজেট ঘাটতি শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রকল্পে আরো কাটছাঁট ও সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। এতে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার মান শক্তিশালী হবে। আমদানি খরচ মেটানোর জন্য ডলারের দাম একপর্যায় থাকবে। প্রবাসে কর্মী পঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করে জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে হবে। তাহলে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। নীতি-সুদহার আর না বাড়িয়ে বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দেয়া, সিন্ডিকেট দূর করা ও সঠিক তথ্য উন্মুক্ত করতে পারলে স্থিতিশীল হবে অর্থনীতি। ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বাংলাদেশ।