ফেরা
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:০০
সৈয়দ আখতার সিরাজী : দেশ স্বাধীনের আগেই আমার জন্ম। আমার পিতা সরকারি চাকরি করতেন। তিনি করাচির সুইডেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চাকরির সুবাদে সেখানেই এক মাটির ঘরে আমার জন্ম। দেশের মাটিতে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে ১৯৬৫ সালে যখন আমাদের বহনকারী বিমান ঢাকার তেজগাঁও এয়ারপোর্টের মাটি ছুঁয়েছে, তখন প্লেন থেকে নামতে গিয়ে আমার মা প্লেনের সিঁড়িতে পা ফসকে পড়ে যাচ্ছিলেন। আমি মায়ের কোলে। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে মা কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা পান। আমার মাথায় সামান্য আঘাত লাগে। কিন্তু মা কোমরের ব্যথা নিয়ে দীর্ঘ দু’বছর ভোগান্তির পর পরপারে চলে গেছেন। মামার বাড়িতে থেকে বড় হয়েছি ঠিকই, কিন্তু হারিয়েছি মা। ৬৬’তে নতুন মা পেয়েছি। ৭০-এর নির্বাচন দেখেছি। ১৯৭১ সালে আমি ২য় শ্রেণির ছাত্র। কাপ্তাই চৌধুরীছড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারেক স্যার আমাকে ১টি বাংলা ও ১টি ইংরেজি বই দিয়েছিলেন জানুয়ারিতে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ক্লাস করেছি। মার্চের শুরুতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের বাসার পাশে ছিল কাপ্তাই সুইডেন ইনস্টিটিউট বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। স্বাধীনের পূর্বেই এটিতে বিএসসি কোর্স চালু করার কথা। কিন্তু পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুইডেন ইনস্টিটিউট কলেজকে ইঞ্জিনিয়ারিং মানে উত্তীর্ণে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মফিজ উদ্দিনকে পরামর্শ দেন। সে পরামর্শে ৩ বছরের কোর্স থেকে ৪ বছরের বিএসসি চালু হয়নি। ১৯৭৯ সালে এ কলেজকে পলিটেকনিক ঘোষণা করা হয়। ছাত্রসমাজ তার প্রতিবাদ করলেও লাভ হয়নি। ১৯৭১ সালে ছোট এক বোনকে হারিয়েছি।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার করেছি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকৃত ও উন্নত শিক্ষা থেকে আমরা বঞ্চিত। আমি যদিও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। কিন্তু আমাদের সন্তানরা কর্মসংস্থানের জন্য ঘুরেফিরে অবশেষে বেসরকারি চাকরি নিয়ে জীবনের শুরুটা করেছে তিক্ততা নিয়ে। আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর পূর্ণ হয়ে ৫৪তে পদার্পণ করছে দেশ। কিন্তু এখনো আমার আব্বা বলেন, কী পেয়েছি আমরা? তোমরা কী পেয়েছ? হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখি ৭১-এ হারিয়েছি অনেক। পেয়েছি অনেক কম। তুলনায় সিকি ভাগও নয়। দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় নির্বাচনের নামে চর দখলের লড়াই দেখে মনে হয়, আমরা লাল-সবুজের পতাকার দেশে রাজনৈতিক বিভেদ ক্ষমতার জন্য মারামারি ছাড়া আর কিছু পাইনি। আমার আব্বা সৈয়দ আব্দুছ ছাদেক ১৯৭১ সালের আগেও কাপ্তাই সুইডেন ইনস্টিটিউট বা কলেজে চাকরি করতেন। স্বাধীনের পর ৯০ সালে অবসর জীবন শুরু করেন। বর্তমানে বয়স প্রায় ৯২ বছর। ১৯৮০ সালে আমার আব্বা যান্ত্রিক বিভাগের সি. ইনস্টাক্টর ছিলেন। সে বছর হানিফ সংকেত, আমাদের মেজো ভাই তমজিদ হোসাইন, ভাইয়ার বন্ধু নন্দী পান্না লাল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছেন মাত্র। হানিফ সংকেত পরে সুইডেন থেকে কম্পিউটারে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমানে আবহাওয়া অধিদপ্তরে কর্মরত ও বিটিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদির উপস্থাপক। নন্দী পান্না লাল একসময় ব্রাদার্স ক্লাবে ফুটবল খেলতেন। ছিলেন অধিনায়কও। মেজো ভাই তমজিদ এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ঢাকায় একটা কোম্পানির জিএম হিসেবে চাকরি করছেন গুলশান বাড্ডায়। একসময় শান্ত মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী পরিচালক ছিলেন। আমি হয়েছি ক্রীড়া লেখক ও সাংবাদিক।
তাই বলতে হয় আমরা হয়েছি বাংলাদেশি, পেয়েছি পতাকা। বাংলাদেশি হিসেবে দেশে বাস করেও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্ন এখনো দেখতে হচ্ছে। দেশকে প্রকৃত সোনার বাংলা রূপে আমরা গড়তে পারিনি। পাইনি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। দেশের ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারী, কালো টাকার অর্ধশতাধিক মালিক ও ধনিকশ্রেণি। এখনো আগের মতোই আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ২০২৪ আমাদের নতুন করে দেশ সংস্কারের পথ করে দিয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সংবিধান সংস্কারসহ পুরো দেশকে আটআনা/দশ আনায় নিয়ে যেতে পারবেন বলে প্রত্যাশা করছি। ১৯৭১ সালের অনেক কিছুই স্মরণে আসে। তবে আমি যেহেতু একটু-আধটু ফুটবল খেলতাম। তাই ১৯৭৪ সালের পর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের নাম শুনে ঢাকায় আসার চেষ্টা করি। তবে সফল হইনি। ১৯৯৬ সালে যখন সাংবাদিক হিসেবে আবারও ঢাকায় আসি, তখন আবাহনীর কাজী সালাহউদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ফুটবলার জাকারিয়া পিন্টুসহ অনেকের সাথে পরিচয়ের সুবাদে অনেক কিছুই জেনেছি। পিন্টু বলেন, স্বাধীন দেশ পেয়েছি, পতাকা পেয়েছি, কিন্তু দুর্নীতিমুক্ত দেশ পাইনি। কাজী সালাহউদ্দিন জাতীয় ফুটবল দলে খেলেছেন। ৭৫-পরবর্তী সময়ে আবাহনী ও জাতীয় দলে খেলার সুবাদে বিদেশের একটি ক্লাবেও খেলেছিলেন কাজী সালাহউদ্দিন।
পরে তিনি আবাহনীর কোচ হিসেবে বছর দায়িত্ব পালন (১৯৮৫) করেছিলেন। বর্তমানে সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (ঝঅঋঋ) ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারিশনের (বাফুফে) সভাপতি। পদাধিকারবলে অঋঈ’র সদস্য। যাতে তৃপ্ত হবার কোনো সুযোগ নেই। হাসিনার দুঃশাসন ও করোনার করাল থাবায় আক্রান্ত জাতি এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চরম নৈরাজ্য, উন্নত চিকিৎসাসেবা না পেয়ে গরিব মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরণপথের যাত্রী, সরকারি হাসপাতালে তাই নেই ভালো কোনো ধাত্রী বা উচ্চ শিক্ষিত কোনো মহিলা ডাক্তার। আছে দুর্নীতিপরায়ণ চিকিৎসক-নার্স। পেয়েছি অর্থলিপ্সু ডাক্তার।
লেখক : সাংবাদিক