কত অবৈধ বিদেশি, তথ্য নেই সরকারি ভাণ্ডারে
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:৪৮
# পাচার হচ্ছে অর্থ কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে বাংলাদেশ
স্টাফ রিপোর্টার: অবৈধভাবে কোনো বিদেশিকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে এ বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, কোনো বিদেশিকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশ সরকার এমন এক মুহূর্তে এ সিদ্ধান্ত নিল যখন ভারতের সঙ্গে নানা বিষয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ চলছে। গত ৮ ডিসেম্বর রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অবৈধ বিদেশি নিয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। এতে অবৈধভাবে যারা বাংলাদেশে রয়েছেন, তাদের দ্রুত বৈধতার কাগজপত্র সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে সিনিয়র স্বরাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের পাশাপাশি স্বাক্ষর রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) খোদা বক্স চৌধুরীর। এতে বলা হয়, যেসব বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন বা কর্মরত আছেন, তাদের অবিলম্বে বাংলাদেশে অবস্থানের বা কর্মরত থাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের জন্য অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশি নাগরিকদের ওপর নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। সূত্রের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ৯৭টি দেশের ১৩ হাজার ৫৭১ জন নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করেন। তাদের পাসপোর্ট বা ভিসার মেয়াদ অনেক আগে ফুরিয়ে গেছে। আত্মগোপনে থেকে তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে কাজও করেন। কাগজে-কলমে তাদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা ৭ হাজার ৪৭২ জন। তবে কাগজপত্রের বাইরে অবৈধভাবে কয়েক লাখ বিদেশি বাংলাদেশে অবস্থান করছেন বলে তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। যাদের সিংহভাগই ভারতীয়। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত ৮ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, কতজন অবৈধ নাগরিক আছেন, সেই পরিসংখ্যান নেই।
এসবি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত দেশে অবৈধভাবে বসবাস করা বিদেশিদের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ১ হাজার ১৭ জন, চীনের ৯৮১, শ্রীলঙ্কার ১৮৭, যুক্তরাজ্যের ২৩১, কানাডার ৯৭, নাইজেরিয়ার ৪৬১ জন রয়েছেন। বাংলাদেশে বৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশিদের মধ্যেও শীর্ষে ভারতীয়রা। তথ্যানুযায়ী, দেশে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বৈধভাবে অবস্থান করা বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজার ৫৪৭ জন। তাদের মধ্যে ভারতীয় ৩৫ হাজার ৩২৭ জন, চীনের ১৩ হাজার ৪০৪, দক্ষিণ কোরিয়ার ৫ হাজার ৫৫, শ্রীলঙ্কার ৩ হাজার ৭৮৫ জন নাগরিক রয়েছেন।
এর আগে গত ২৮ মে দেশে অবস্থানরত বৈধ ও অবৈধ বিদেশি কর্মীদের প্রকৃত সংখ্যা অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিরূপণ করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এসব বিদেশি কর্মী কীভাবে, কোন চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের অর্থ দেশের বাইরে পাঠান, তা-ও অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘অবৈধ বিদেশি খেদাও আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে এর সাধারণ সম্পাদক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন দাবি করেন, বাংলাদেশে ১০ লক্ষাধিক অবৈধ বিদেশি শ্রমিক বসবাস করছেন।
গত ২৪ জুন পতিত সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সংসদে জানান, বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের বছরে আয়ের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষিত নেই। তবে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশিরা তাদের আয় থেকে ১৩০.৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজ নিজ দেশে নিয়ে গেছেন। তার মধ্যে শীর্ষ তিন দেশÑ ভারত ৫০.৬০ মিলিয়ন ডলার, চীন ১৪.৫৬ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কা ১২.৭১ মিলিয়ন ডলার নিয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০২০ সালে তাদের এক জরিপে জানিয়েছিল, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি কর্মীর সংখ্যা কমপক্ষে দুই লাখ ৫০ হাজার। এ সংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৩.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায়। তাদের কর ফাঁকির ফলে বছরে ন্যূনতম প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। টিআইবি গবেষণায় দেখেছে, বাংলাদেশে ৪৪টির বেশি দেশের নাগরিক বিভিন্ন খাতে কর্মরত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশসমূহ হচ্ছেÑ ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস, নরওয়ে ও নাইজেরিয়া। তাদের তথ্যানুযায়ী এদের মধ্যে ভারতের নাগরিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি কর্মী কাজ করছে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইলসংশ্লিষ্ট খাতসমূহে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, চামড়াশিল্প, চিকিৎসাসেবা এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি কাজ করছেন।
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭ জন। যদিও অবৈধসহ এ সংখ্যা ৪ থেকে ৫ লাখ হবে। এদের অনেকে বাংলাদেশে থেকে আয়রোজগার করলেও ঠিকমতো করও দেন না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি নাগরিকদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশে অবস্থান করছেন ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও। কারণ ধরা পড়লে জরিমানার অঙ্ক খুবই কম, মাত্র ৩০ হাজার টাকা। আবার অনেকে ভিসার শ্রেণি পরিবর্তন করেও বেশি দিন অবস্থানের সুযোগ নিচ্ছেন।