কথিত হিন্দু নির্যাতনের ভারতীয় কার্ড : বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র


১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:৪৬

॥ জামশেদ মেহ্দী॥
বাংলাদেশে তথাকিথত হিন্দু নির্যাতন নিয়ে ভারতের একশ্রেণির পলিটিশিয়ান এবং মিডিয়া উন্মাদ প্রচারণা চালাতে শুরু করে। এ প্রচারণা থামেনি। বরং দিনের পর দিন তারা যে ভাষায় কথা বলছে, সেগুলোকে বলা যায়, অস্ত্রের ভাষা। আমি অত্যন্ত অবাক হয়ে যাই- যখন দেখি যে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও ইদানীং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছেন। গত ৮ ডিসেম্বর তিনি বলেন, “বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা ভারতকে হুমকি দিচ্ছেন। ভারতকে ক্ষতি করার কোনো সামর্থ্য বাংলাদেশের নাই। বাংলাদেশ ভারতের ওপর চড়াও হওয়ার দুঃসাহস দেখালে ভারত বসে বসে ললিপপ চুষবে না।”
উপরোক্ত মন্তব্য মমতা ব্যানার্জির মতো একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদের পক্ষে শোভা পায় না। আমরা তার এ বক্তব্যের তীব্র নিন্দা করি। মমতা, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি শুভেন্দু অধিকারী, কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রমুখের এ ধরনের উসকানিমূলক উক্তিতে বলীয়ান হয়ে ভারতের ইংরেজি-বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষার মিডিয়াও তাদের লেখনীতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আগুন ঝরাচ্ছে। এরা দেখছি সকলেই তাদের কল্পনার রাজ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধের কালো মেঘ দেখতে পাচ্ছে। তাই কোনো কোনো মিডিয়া এতদূরও বলছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যদি যুদ্ধ বেধে যায়, তাহলে বাংলাদেশ দখল করতে ভারতের ৩০ মিনিটের বেশি লাগবে না। এরা যে যুদ্ধের উন্মাদনা ছড়াচ্ছে, সে কথাটির প্রমাণ মেলে ওদের একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকার রিপোর্ট দেখে। এ রিপোর্টটি ভিডিওতে সম্প্রচারিত হয়েছে, আবার তাদের প্রিন্ট এডিশনেও ছাপা হয়েছে। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, যুদ্ধ লাগলে বাংলাদেশ ভারতের কাছে দাঁড়াতেই পারবে না। এ কথা প্রমাণ করার জন্য তারা ভারত ও বাংলাদেশের তুলনামূলক সামরিক শক্তি তুলে ধরেছে। তাদের রিপোর্ট মোতাবেক, এ সামরিক শক্তি নিম্নরূপ:
ভারতের রয়েছে সাড়ে ১৪ লাখ সৈন্য। সেখানে বাংলাদেশের সৈন্য সংখ্যা ১ লাখ ৬৫ হাজার। ভারতের রয়েছে ৬০৬টি জঙ্গিবিমান। সেখানে বাংলাদেশের মাত্র ৪৪টি। ভারতের রয়েছে ৪ হাজার ৬১৪টি ট্যাঙ্ক। সেখানে বাংলাদেশের মাত্র ৩২০টি। ভারতের রয়েছে ১৮টি সাবমেরিন। সেখানে বাংলাদেশের মাত্র ২টি। ভারতের রয়েছে ৪০টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার। সেখানে বাংলাদেশের একটিও নেই। ভারতের রয়েছে ১২টি ডেস্ট্রয়ার। সেখানে বাংলাদেশের একটিও নেই।
আমরা অবাক হই এই ভেবে যে, তারা তাদের সামরিক শক্তির বড়াই করছে। এগুলো স্রেফ ভয় দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ মূল ইস্যুটি হচ্ছে তাদের ভাষায় সংখ্যালঘু নির্যাতন। আর এ সংখ্যালঘু তো তাদের সংখ্যালঘু নয়। যাদের কথা বলা হচ্ছে, তারা তো বাংলাদেশের সংখ্যালঘু। যে চিন্ময় দাসকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে এসব হম্বিতম্বি করা হচ্ছে, সেই চিন্ময় দাস এবং তার অনুসারীরাও তো বাংলাদেশের নাগরিক।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছেন, বাংলাদেশে একটা ‘নেতৃত্বহীন’ অবস্থা তৈরি হয়েছে এবং এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে মাফিয়ারা সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ অন্যান্য নেতিবাচক ঘটনা ঘটাচ্ছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশ সীমান্তে আগুন জ্বললে তা থেকে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, বিহার-উড়িষ্যাও রেহাই পাবে না। ভারতীয় সম্প্রচারমাধ্যম নিউজ-১৮-এর সোজাসাপ্টা অনুষ্ঠানে গত ৬ ডিসেম্বর শুক্রবার দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মমতা এসব কথা বলেন। মমতা ব্যানার্জি কোন অর্থে বাংলাদেশ সীমান্তের আগুন বিহার ও উড়িষ্যায় ছড়িয়ে যাবে বলেছেন, সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। তবে অনুরূপ হুঁশিয়ারি ড. ইউনূসও দিয়েছেন। ৮ আগস্ট বাংলাদেশের দায়িত্বভার গ্রহণের পূর্বে ফ্রান্স থেকে যখন তিনি বাংলাদেশে ফেরার জন্য বিমানে আরোহণ করেন, তার পূর্ব মুহূর্তে তিনি অনুরূপ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদি কেউ বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে চায়, তাহলে তাদের জেনে রাখা উচিত যে, সেক্ষেত্রে ঐ অস্থিতিশীলতার আগুন পূর্ব ভারতে এবং উত্তর-পূর্ব ভারতেও ছড়িয়ে পড়বে। মমতা ব্যানার্জির উক্তিটি আমাদের বোধগম্য হয়নি। কিন্তু ড. ইউনূসের উক্তির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে কষ্ট হয় না।
এর আগে মমতা ব্যানার্জি সম্পর্কে তার সিপিএমবিরোধী সংগ্রামের জন্য বাংলাদেশের মানুষের মনে তার জন্য একটি সফট কর্নার ছিল। সেই মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের রক্ষার জন্য সে দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা প্রয়োজন। যেহেতু এটি কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়, তাই এ ব্যাপারে জাতিসংঘকে শান্তিরক্ষা বাহিনী প্রেরণে প্রয়োজনয়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি মোদি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। অবশ্য তার এ হঠকারী উক্তির জন্য বাংলাদেশ তো বটেই, ভারতের একশ্রেণির পলিটিশিয়ানের নিকট থেকেও তিনি যোগ্য জবাব পেয়েছেন। ভারতের লোকসভা সদস্য শশী থারুর একজন নামকরা কলামিস্টও বটে। তিনি জাতিসংঘে ১৩ বছর কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী কোন দেশে কীভাবে মোতায়েন করা হয়, সে বিষয়ে সম্ভবত মমতা ব্যানার্জির কোনো জ্ঞান নেই। যে দেশে শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠানো হবে, সেই দেশের সরকারকে সেই অনুরোধটি জাতিসংঘকে জানাতে হবে। এও জানাতে হবে যে, সেই দেশের সরকার ডিসফাংশনাল বা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ঐদিকে বাংলাদেশ থেকে তাকে বলা হয় যে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী যদি কোথাও পাঠাতে হয়, তাহলে সেটি পাঠাতে হবে ভারতে। ভারতের মণিপুরে এখন গৃহযুদ্ধ চলছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী সেখানে গণহত্যা করছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করতে হবে কাশ্মীরে। কাশ্মীরের ৯০ শতাংশ মানুষকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বুটের তলায় দাবিয়ে রাখা হয়েছে। শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠাতে হবে ভারতীয় পাঞ্জাবে। কারণ পাঞ্জাবের অধিবাসীদের আর্তনাদ, স্বাধীন খালিস্তানের দাবিকে বুলেটের মাধ্যমে খামোশ করা হয়েছে। শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠাতে হবে উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত ৭ রাজ্যে। কারণ এ ৭ রাজ্যের স্বাধীনতার আকুতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর উদ্যত সঙ্গীনের মুখে স্তব্ধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে হিন্দুদের নির্যাতনের অভিযোগ যে বানোয়াট এবং ডাহা মিথ্যা, সেটা বিগত কয়েকদিনের পত্রপত্রিকার রিপোর্টে পরিষ্কার হয়ে গেছে। দেশি এবং বিদেশি রিউমার স্ক্যানার তাদের ফ্যাক্ট চেকে দেখিয়েছে যে, এ সম্পর্কে ভারতীয় মিডিয়া যতগুলো অভিযোগ করেছে এবং বিজেপি নেতারা যেসব অভিযোগ করেছেন, তার মধ্যে ৪৯টি অভিযোগই অথবা যেসব ঘটনার উল্লেখ করে অভিযোগ করা হয়েছে, সেসব ঘটনা বা অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুয়া। আওয়ামী লীগ আমলে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার কতগুলো ভিডিওক্লিপ ইউনূস আমলের বলে চালানো হয়েছে। এখন সকলেই বলছেন, এগুলো ভুয়া।
কিন্তু ভুয়া হলে কি হবে, বাংলাদেশ সম্পর্কে এসব ডাহা মিথ্যা কথা নিয়েই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটা কিছু করার প্ল্যান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবার বিজেপির প্যারেন্ট সংগঠন আরএসএস। ঘটনাগুলো সকলেই জানেন। ত্রিপুরার হোটেলগুলোয় বাংলাদেশিদের থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। আসামের হোটেল-রেস্তোরাঁসহ প্রকাশ্য স্থানে গরুর গোশত খাওয়া নিষেধ করা হয়েছে। জকিগঞ্জ এবং করিমগঞ্জ থেকে আলু ও পেঁয়াজবাহী ট্রাকের বহরকে বিজেপির কর্মীরা আটকে দিয়েছিল। শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে সীমান্তে বিজেপির কর্মীরা হইচই করেছে।
এখন এ কথাটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ভারত তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং সেই সাথে বৃহত্তর জিও পলিটিক্যাল বিবেচনায় বাংলাদেশবিরোধী ক্যাম্পেইনে নেমেছে। ভারতের মতলব বাংলাদেশ সরকারের তো পরিষ্কার বোঝা উচিত। তারপরও যে আলোচনার জন্য ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রিকে কেন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। ভিডিওতে দেখলাম, বিক্রম মিশ্রি আমাদের পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিনের সাথে আলোচনার পর সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট বলেন, বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে তিনি এসেছেন। আর এসব আলোচনায় যা ঘটবার, তাই ঘটেছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবকে বাংলাদেশের তরফ থেকে বলা হয়েছে যে, ভারতে বসে শেখ হাসিনা বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালাবেন, সেটি বাংলাদেশের পছন্দনীয় নয়। এ কথাটি যেন বিক্রম মিশ্রি শেখ হাসিনাকে জানান। এর জবাবে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন যে, হাসিনাকে ভারতে রেখেই বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাবে ভারত। যে পটভূমিতে বিক্রম মিশ্রির সাথে বাংলাদেশ আলোচনা করল সেই পটভূমিতে বাংলা-ভারত আলোচনা যে সম্পূর্ণ ফ্লপ করবে, সেটি ছিল একটি ঋড়ৎবমড়হব ঈড়হপষঁংরড়হ. (পূর্ব নির্ধারিত উপসংহার)।
বাংলাদেশের বিলোনিয়া সীমান্তের ওপারে ভারতীয় বাঙালিরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। তারা হুমকি দিয়েছে যে, বাংলাদেশ যদি হিন্দুদের ওপর নির্যাতন না থামায়, তাহলে তারা বাংলাদেশের ফেনী দখল করবে। আর তাদের সুরে সুর মিলিয়ে একশ্রেণির ভারতীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের মিত্র রাষ্ট্ররা ভারতকে চিকেন নেকের ভয় দেখায়। চিকেন নেকের আরেকটি নাম হলো শিলিগুড়ি করিডোর। এটি যদি কেউ দখল করতে পারে, তাহলে পশ্চিম ভারত থেকে পূর্ব ভারত সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তারা আরো বলে, বাংলাদেশের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ফেনী হলো বাংলাদেশের চিকেন নেক। যদি ভারত ফেনী দখল করে, তাহলে শুধু ফেনী নয়, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পণ্ডিত নেহরু এবং সরদার প্যাটেলের দাবি ছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের ভাগে দেওয়া হোক। নেহরুর দাবির সাথে তাল মিলিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন শাসক স্নেহ কুমার চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতীয় পতাকা উড়িয়েছিলেন। সেই পতাকা ৭ দিন উড্ডীন ছিল। কিন্তু জনাব লিয়াকত আলী খান ও সালমান রহমানের পিতা ফজলুর রহমানের অকাট্য যুক্তির কাছে ব্রিটিশ সরকার নতি স্বীকার করেন এবং ফাইনালি পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের ভাগে দিয়ে দেন।
সেই শোক আজও ভারতীয়রা ভুলতে পারেনি। ৭৫ বছর পর সেই পুরনো স্মৃতি তাদের মনের মাঝে আবার উদিত হয়েছে। সুতরাং হিন্দু নির্যাতন বা চিন্ময় ইস্যু নিয়ে ভারত আজ যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখাচ্ছে, সেটি একেবারে তাৎক্ষণিক ব্যাপার নয়। একটি গভীর পরিকল্পনা নিয়ে তারা এগোচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে এখন থেকেই আত্মরক্ষামূলক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।