আহমদ বাসির আঁধারে আলোর বিচ্ছুরণ
২৯ নভেম্বর ২০২৪ ০০:০০
॥ আবুল খায়ের বুলবুল ॥
বাংলা সাহিত্যের সুনীল আকাশে অগণিত নক্ষত্রের প্রজ্জ্বলন শিখায় ভাস্বর হয়ে আছেন মরহুম তরুণ কবি, গীতিকার, প্রাবন্ধিক আহমদ বাসির। শৈশব-কৈশোরের দুর্দান্ত সময় বেহুদা জীবন পথের আনাচে-কানাচে না হেঁটে সত্য ও সুন্দরের অমরাবতীর জলে অবগাহন করে নিজকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় বলিষ্ঠ করে জীবনকে বর্ণালী আলোয় উদ্ভাসিত করার প্রয়াসী হয়েছেন। তার লেখনীশৈলিতায় মিথ্যের আগলে সত্যের কুঠারাঘাত করে আলোড়িত হয়েছেন সাহিত্যের নানা অঙ্গনে। তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ তার্কিক, সমালোচক ও শুদ্ধ প্রাবন্ধিক। কবি ও গীতিকার হিসেবেই তিনি বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে সগৌরবে ঠাঁই করে নিয়েছেন। আহমদ বাসিরের লেখনীশৈল্পিকতা ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। শৈল্পিকতার ক্ষুরধার আখরে তিনি কবিতা গানের প্রতিটি পঙক্তিকে সৌন্দর্যের আভায় ভাস্বর করে তথায় নান্দনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে দিয়েছেন। লেখনীশৈল্পিকতায় তার প্রকাশিত সকল লেখায়ই সুপ্রাণ পেয়েছে। তার লেখনীশৈল্পিকতা যেন ইংরেজ লেখক Tolstoy-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। Tolstoy যেমন বলেছেন, “To evoke in oneself a feeling one has experienced and having evoke it in oneself then by means of movement hues, colours, sound or forms expressed in words so to transmit that feeling that others, experience the same feeling, this is the activity of art.”
কবি আহমদ বাসিরের কাব্যগাথা, ছন্দগাঁথা প্রতিটি পঙক্তিতে সেই শৈল্পিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি বিরাটকে স্বল্পতার আখরে অত্যন্ত মনোরম ভাষায় উপস্থাপন করে পাঠককূলে শ্লাঘনীয় সুশ্লাঘনীয় হয়ে উঠেছিলেন। শারীরিক গঠনে তিনি বিশাল না হলেও চিত্তবৈভবে তিনি ছিলেন বড় বিরাট ব্যক্তিত্বের অধিকারী জ্ঞানী সুপুরুষ। তাকে দৃশ্যত কেউ দেখলে বোঝার অবকাশ থাকতো না, যদি না তার সাথে কেউ বাকে অবতীর্ণ না হওয়া যেতো। কবি আহমদ বাসির একজন প্রথিতযশা বাচিক শিল্পীও ছিলেন। কবি ফররুখ আহমেদ ‘পাঞ্জেরী’ কবিতা ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার একজন সফল আবৃত্তিকারও ছিলেন। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায়ও তিনি শ্রোতামণ্ডলোর শ্লাঘার্জন করার প্রয়াসী হয়েছেন ব্যবহার। তপ্ত-দীপ্ত, সদা স্পষ্টভাষী ব্যক্তি ও কবি ছিলেন আহমদ বাসির। কবি আহমদ বাসিরের অবয়ব দেখে মনে হতো না এতো জ্ঞানী ও প্রাঞ্জল ভাষায় হৃদয় নিংড়ানো মানুষ তিনি। তাকে ইংরেজ কবি william blake এর The sick rose কবিতার মতোই প্রতীয়মান হতো। কবি blake যেমনটি বলেছেন-
“O rose thou art sick
The invisible worm
That flies in the night
In the howling storm
Has found out thy bed
Of crimson joy
And his dark secret love
does thy life destroy?
সত্যিতো কবি আহমদ বাসির বিলিয়ে দেয়া পুষ্পসৌরভে মাতানো সুবাসিত স্নিগ্ধ ফুলের সুনির্যাস ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অচলার এ জমিনে। তার লোবান সুবাস গ্রহণ করে আমাদের জীবন গলির আঁকাবাঁকা মেঠোপথে সত্য ও সুন্দরের পিচঢালায় সুপুক্ত করে দিয়ে গেছেন শকট শপথের পথ সুপথ। কবি আহমদ বাসিরের কবিতার বাণী মন্ত্রে এ দেশের মানুষের চিত্তে আশাজাগানিয়া এনে দেয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছে। তীব্র ঝড়ের মধ্যেও তিনি সুশান্ত হাওয়া প্রবাহিত করে মানুষের হতাশার বুকে সান্ত্বনার দীপ জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। জীবনকে সাজাতে ও রাঙাতে হলে যে খুন রাঙা পথেও হাঁটতে হয়, চলতে হয় তা তার কবিতায় সার্থকভাবে ফোটে উঠেছে। বাসির দেশের মানুষ ও মানুষের চিত্তকে সর্বদাই নির্ভয়ের প্রদীপ্ততার ভাস্বরে প্রজ্জ্বলন করে তথায় সাহসের সঞ্চার করার আহ্বান জানিয়েছেন। সাহসের সেই শিখায় যেন মনের শরীর জ্বলে ওঠে অধিকার-স্বাধিকার আদায়ের দীপ্ত শপথে। মানুষ যেন প্রত্যহ সংগ্রাম মুখর জীবন নিয়েই সম্মুখে উম্মিয়ে চলে তারই আহ্বান তিনি তার কবিতার পরতে পরতে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাই তো তার কবিতায় দেখি-
‘তপ্ত হয়ে যে উঠবে কবে এ
শীতল রক্তধারা
দুয়ারে দুয়ারে থাকছে আবার
উদয় অক্ত খাড়া
আসুক জীবন জোয়ারের মতো
মরণের দরজায়
আকাশ বাতাস পর্বত নদী
সময়ের গান গায়
শোনে না সে গান শোনে না আজাদ
বিলাসে মত্ত যারা’
বাসিরের কবিতায় মুসলমানের সোনালি যুগের ইতিহাস অংঙ্কিত হয়েছে শতধারে। মুসলমানদের ঐতিহ্য এবং সেই সংরক্ষিত স্থানগুলোয় যে নষ্ট শকুন ও হায়েনার আক্রমণ চলে ও নিষিদ্ধের রুদ্ধ ঘরে বন্দি তা পুনরুদ্ধার
করার তীব্র বাসনাও তার কবিতায় পরিলক্ষিত হয়। কবির ‘স্বপ্নশালায় আমার ক্যনভাস’ কবিতায়তাই শুনি-
‘ফেলে আসা অতীতের হাজার হাজার
সভ্যতার এ কঙ্কালসার অস্তিত্বের ভার
বইবার, দায় বলো কার
একটাই ক্যানভাস আমার
স্বপ্নশালায়
আশ্চর্য অহংকার।’
শুধু তাই নয়, কবি বাসির ইসলামী সঙ্গীত নিয়েও কথা বলেছেন। ইসলামী সঙ্গীতের সুর ও কথা মালায়ও মানুষের চিত্তকে সহজ সরল পথের দিকে ধাবিত করে এবং সেই কারণেই কোনো কোনো মানুষ বিপথগামী থেকে সঠিকতার দিকে চলে আসে তা তিনি তার সুলোচনে দেখার প্রয়াসী হয়েছেন। ইসলামী সঙ্গীত জগতের স্টার কবি ও গীতিকার মতিউর রহমান মল্লিককে নিয়ে তাই তার কথা মালা সাজিয়েছেন ঠিক এভাবে…
‘মল্লিক ভাই শুধু মল্লিক ভাই
তার মতো এখন তো আর কেউ নাই
জীবনের শত শত
নানা সুর রংতুলিতে
সুরে সুরে মুখরিত ওস্তাদ সাঁই’
কবি আহমদ বাসির রাজনীতি সচেতন ছিলেন। দেশের মানুষের কথা ভাবতেন। কলুষযুক্ত রাজনীতি জনগণকে একঘেঁয়েমি করে তোলে। মানুষকে আঁধার বিভরে নিমজ্জিত করে তোলে। বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করে দেয়। কবি বাসির সেই চিত্রও তার কবিতায় তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সার্থকভাবে। বাসিরের ‘অতপর এ আহ্বান’ কবিতায় তাই শুনি…
‘একগাদা অন্ধকার চোখের সামনে স্তূপ হয়ে গেছে
ক্রমে ক্রমে এ যে পর্বত হয়ে যাবে
সে আর বুঝতে বাকি নেই
ঠিক এ মুহূর্তে এ দু’চোখ থেকে যদি
আগুনের গোলক ছিটকে না বেরোয়
তবে মনে হয় এ পৃথিবীতে আর কোন দিন
ভোর আসবে না’
সত্যের মোড়ক নিয়ে যে মিথ্যে বেসাতির জগদ্দল পাথর এ জাতির বুকে বসিয়ে মসনধারীরা উন্মত্ততায় ভাষণ গিলায় তারও একটা সঠিক চিত্র তিনি তার কবিতায় তুলে ধরেছেন অত্যন্ত বিচক্ষণতায়। কবি আহমদ বাসিরের ‘অভিশপ্ত নগরীর মুখে’ কবিতায় তাই শুনি-
‘মশারীর মতো চারদিকে সতর্ক দেয়াল
অথচ মাথার ওপর অচেনা আকাশ ঝুলিয়ে
দিকভ্রান্ত পথিক, যার পায়ে প্রতি মুহূর্তে
হুমড়ি খায় পরিণতির প্রতিধ্বনি।
যার চোখ নিবন্ধ থাকতো
ঘাসের মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে মৃত্তিকার বুকজুড়ে
সে এখন ঊর্ধ্বগামী-দূরগামী চোখ তার
ঘূর্ণিবায়ুর চেয়ে দূরন্ত
পাগড়ীর বদলে সে ধারণ করছে
বহুরূপী পিশাচের ভয়ংকর দাঁত ও
শিংআলা মাথা, তার যাবতীয় বাল্য শিক্ষাতো
বহুকালের পুরোনো জং ধরা পেরেক’
কবি আহমদ বাসির কবি মতিউর রহমান মল্লিক, কবি ফররুখ আহমদ, কবি আল মাহমুদের লেখা নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং সম্পাদনাও করেছেন। তারুণ্য দীপ্ত একজন প্রগাঢ় সম্পাদকও ছিলেন কবি আহমদ বাসির। জীবদ্দশায় তিনি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় সম্পাদনার কাজেও জড়িত ছিলেন, যা তার খ্যাতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। গবেষণা ও সম্পাদনা কাজেও তিনি সিদ্ধ হস্তের অধিকারী ছিলেন। কবি আহমদ বাসির এ দেশের একজন নামকরা তরুণ ইসলামী গানের গীতিকার হিসেবেও সমধিক পরিচিত ছিলেন। তার লেখা ইসলামী গানে বিভিন্ন সুরকারের সুরে ও শিল্পীর গলায় গীত হয়েছে। প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী লিটন হাফিজ চৌধুরীও তার লেখা ইসলামী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তার লেখা লিরিক ‘খুতবায় তলোয়ার’ বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। লিরিকটিতে যেমনটি বলেছেন-
‘আয়াসুফিয়ার ভেঙেছে শিকল
শিকল ভাঙবে আল আকসার
বাবরি আবার মসজিদ হবে
করডোভা ফিরে পাবে আবার
মুসলমানের হাতে
জ্বলসে যদি ওঠে
সেই ন্যায় তলোয়ার
সেই খুতবায় তলোয়ার’
উসমানীয় খেলাফত পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ বছর রাজত্ব করে বীরদর্পে। তখন তুরুস্কে আয়াসোফিয়া পূর্বের কন্ট্যান্টিনোপেল বর্তমানে ইস্তাম্বুলে অবস্থিত পবিত্র জ্ঞান ঘর আয়াসোফিয়া ৫৩৭ সালে নির্মিত হয় মসজিদ হিসেবে। নাস্তিক স্বৈরশাসক আতাতুর্ক কামাল পাশার শাসনামল ১৯৩৪ সালে এটি বন্ধ করে দেয়া হয়। তুরুস্কে নবশাসক রজব তৈয়ব এরদোগানের সময় তা খুলে দেয়া হয় এবং এটিকে মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেখানে বসেই মুসলিমরা হাতে তলোয়ার নিয়ে জুমার ও ঈদের নামাজের খুতবা দিতেন বাতিলকে তার আঘাতের ভয় দেখানো এবং কুকর্মের অপরাধে গর্দান যাওয়ার নিমিত্ত তা দেখানো হতো। এটি দ্বারা মিথ্যের পতন বোঝানোর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতেন। স্পেনের করডোভা মসজিদটিও স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট সরকার বন্ধ করে দিয়েছিলো অন্যদিকে বাবরি মজিদটিও স্বৈরাচার হিন্দু সরকার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এগুলো মুসলমানদের পুরোনো ঐতিহ্য তা পুনরায় পাওয়ার সাহসে উদ্দীপ্ত হওয়ার জন্য মুসলমানদের কবি আহমদ বাসির তার গানের পঙক্তিতে পঙক্তিতে তুলে ধরার প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি একাধারে কবি, ছড়াকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও গীতিকার ছিলেন। এতো অল্প বয়সে বাংলা সাহিত্যে সব্যসাচী হওয়া লেখক খুব কমই পাওয়া যায়। তার সমগ্র জীবন ও সাহিত্য ইসলামিক ভাবধারায়ই চলমান ছিল। দেশ ও জাতির কুসংস্কারের কঠিন গৃহের আগলে তিনি তার লেখায় কুঠারাঘাত করেছেন। তার লেখা প্রকাশিত বই ‘দীনেশের কালো রাত’ ও ‘অথৈ জলে জাগবে চর’ পাঠক নন্দিত হয়েছে। উক্ত বই দুটিতে তিনি বর্তমান সমাজের বয়ে যাওয়া অসঙ্গতির চিত্র পাঠকের সম্মুখে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সাবলিল ভাষায়। সুমিষ্টি ব্যবহারে কবি আহমদ বাসির মানুষের আঁধার মনের রুদ্ধ আগল ভেঙে দিয়ে তথায় আলোর বিচ্ছুরণ বইয়ে দিতে বড্ড কৌশলী ছিলেন। নির্ঘুম চোখের ঘাম শুকোবার আগেই ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন কবি আহমদ বাসির। আল্লাহ পাক তার দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন।
ইমেইল: [email protected]