দুর্জয় কাফেলার এক অপূর্ব মিলনমেলা


৮ নভেম্বর ২০২৪ ১১:১৬

॥ এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী ॥
মেলা মানে হাজারো প্রাণের মিলিত সম্মেলন,
অপূর্ব এক মজবুত মিলন সেতু।
এটি ছিল আমাদের হাজার প্রাণের দুর্ভেদ্য কাফেলা,
শত শত প্রাণের অনন্য মিলিত উৎসব।
দুর্জয় কাফেলার শপথবদ্ধ আদর্শিক স্পন্দন।
ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের রুকন সম্মেলন ২০২৪। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় অবরুদ্ধ থাকার পর বৃহৎ পরিসরে প্রকাশ্য এই প্রথম একটি অনন্য আয়োজন। বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল যেন দুর্জয় কাফেলার এক অপূর্ব মিলনমেলা। কত বছর পর এভাবে একত্রিত হতে পারলাম। সুবহানাল্লাহ! সিজদায় কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে পড়ে। আঁখিযুগল সিঞ্চিত হয়ে ওঠে, হৃদয় যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বলে ওঠে- আলহামদুলিল্লাহ। সকল প্রশংসা শুধু মহান প্রভু তোমারই জন্য।
গত ১৩ অক্টোবর নারায়ে তাকবীর স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল এ প্রাঙ্গণ। প্রায় ১০ হাজার সদস্যের উপস্থিতি নিয়ে ঢাকা মহানগরী উত্তর চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজন করেছিল এমনই এক মিলনমেলার। দ্বিতীয় স্বাধীনতা-পরবর্তী এ অনুকূল পরিবেশ পেয়ে নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে প্রায় ১০০০ নতুন প্রজন্মও মায়েদের সাথে শামিল হয়েছিল। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে আমরাও আমন্ত্রিত ছিলাম, যদিও ঢাকার বাইরে সফরে থাকায় উপস্থিত থাকতে পারিনি, তবে মনপ্রাণ দিয়ে যেন এ মিলনমেলার সাথেই একাত্ম হয়েছিলাম। শুনেছি, খুবই প্রেরণাদীপ্ত হয়ে সবাই সেখানে অংশ নিয়েছিল এবং সফলতার সাথে তার পরিসমাপ্তিও হয়েছিল! মহান রবের কাছে দোয়া করছি-
হে আল্লাহ! উত্তরের এ সম্মেলনের মিলনমেলাকে আগামী দিনের জন্য বরকতময় করে দাও, মজবুত ভিত্তির মাইলফলক হিসেবে কবুল কর।
১৮ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণের এ মিলনমেলায় আমন্ত্রিত মেহমান হিসেবে আমরা কেন্দ্রীয় মহিলা বিভাগীয় সেক্রেটারিসহ কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের অধিকাংশ সদস্য উপস্থিত ছিলাম, আলহামদুলিল্লাহ্।
ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের কর্মপরিষদ, শহীদ পরিবারের সদস্যা, ছাত্রী অঙ্গনের কেন্দ্র ও ঢাকাসহ দুই মহানগরীর দায়িত্বশীলা, সাবেক ছাত্রী দায়িত্বশীলাসহ বিশিষ্ট সুধী ও শুভাকাক্সক্ষীদের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল সেলিব্রেটি হলরুমটি।
বিভিন্ন কারণে মুরুব্বি রাহবার যারা আসতে পারেনি, তাদেরও আমরা সবাই খুব মিস করছিলাম। অতীতের স্মৃতিগুলোর কথা মনের মুকুরে বার বার দোলা দিয়ে যাচ্ছিল, কিছু সময়ের জন্য নষ্টালজিক হয়ে পড়ছিলাম।
সকাল ৮টা বাজার আগেই দ্বিতল বিশিষ্ট সম্মেলন স্থলটির প্রতিটি কক্ষই যেন কানায় কানায় ভরে উঠেছিল দীনের পথে নারী সৈনিকের মতবিনিময়ের কলরবে। মহিলাদের জন্য বরাদ্দকৃত সাদা সবুজের কম্বিনেশনের ডেকোরেশনে তিনটি বিশাল হলরুম (সেলিব্রেটি, কার্নিভাল ও হারমোনি) কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
ভাই-বোনদের পৃথক অবস্থান নিয়ে ভাইদের পরিচালনায় যথাসময়ে সম্মেলন শুরু হয় এক জান্নাতি আবেশ নিয়ে। স্বেচ্ছাসেবী বোনেরা বিভাগ অনুযায়ী বিভিন্ন কালারের স্কার্ফ, ব্যাজ পড়ে তাদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। হলরুমজুড়ে চমৎকার কুরআন ও হাদিসের আয়াতসংবলিত প্লাকার্ড, ফেস্টুন, বেলুনের সাজসজ্জায় এক আকর্ষণীয় রুহানী পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। বোনদের সুশৃঙ্খল আসন গ্রহণ, নির্দেশনা অনুসরণ, প্রোগ্রামের প্রতিটি আয়োজন মনোযোগ দিয়ে শোনা ও গিফট পাওয়া ডায়রি কলম নিয়ে নোট করার কাজগুলো চলছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক গতিতে।
“হাজার প্রাণে ভরা কাফেলা
নইগো বন্ধু মোরা নই একেলা…
শাহাদাত মনে-প্রাণে চাইযে মোরা
সংগ্রাম বারণ মানে না না না…
এই অনুভূতিতে শিহরিত হচ্ছিল প্রতিটি হৃদয়, প্রতিটি প্রাণ।
আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল যেন এক অস্ফুট স্লোগান-
‘দিন যাবে না অবহেলায়
এসো আজ প্রাণের মেলায়’।
সম্মেলন উদ্বোধন ও স্বাগত ভাষণের পরপর
বেজে উঠলো সম্মেলন সংগীত…
‘ঘন কালো আঁধারের বুকচিরে
শত শত শহীদের পথ ধরে
আমরা ছিলাম, আছি, রবো
কুরআনের ময়দানে, বিজয়ের এই ক্ষণে,
সবুজের এ নীড়ে…।’
চমৎকার এ পরিবেশনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করছিল সবাই।
একে একে সম্মানিত মেহমান, প্রধান অতিথি ও দায়িত্বশীলদের অসাধারণ দিকনির্দেশনাপূর্ণ বক্তব্য, প্রতিটি অন্তরকে আলোড়িত করছিল, ঈমানী শক্তিকে আরো শানিত করছে। বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে মহানগর দক্ষিণ শিল্পী গোষ্ঠীর আকর্ষণীয় উপস্থপনায় ইসলামী সংগীত, গীতি আলেখ্য ও আবৃত্তি, সম্মেলনে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল। অসাধারণ আবৃত্তি ও মনোমুগ্ধকর ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী নতুন এক শপথে উজ্জীবিত করেছে সবাইকে।
ডকুমেন্টারির শেষের উৎসাহমূলক ও করণীয় সম্পর্কে সমবেত সঙ্গীত-
‘এখনো অনেক ধৈর্য ধরতে
হবে, এখনো অনেক কষ্ট করতে হবে,
বিরামবিরতি হীন অবিরত,
আসহাবে রাসূলের ত্যাগের মতো,
জীবনও সম্পদ সবকিছু দিয়ে
আমরণ লড়তে হবে…।’
গানের প্রতিটি কথা ও সুরব্যঞ্জনা যেন নবজাগরণের দীপ্তি ছড়িয়েছিল চতুর্দিকে।
করোনা পরিস্থিতিসহ ১৫ বছরের স্বৈরাচারের দুঃশাসনে অবরুদ্ধ আর অফুটন্ত কলিগুলো যেন অনুকূল পরিবেশ পেয়ে হঠাৎ করেই ফুটন্ত একেকটা গোলাপে পরিণত হয়েছে, মোহিত করেছে, সুশোভিত করে তুলেছিল চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের বিশাল হলরুমগুলোকে, যা ছাপিয়ে বহিরাঙ্গনেও বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল- আলহামদুলিল্লাহ্।
আয়োজক ও স্বেচ্ছাসেবক ভাই-বোনদের অক্লান্ত পরিশ্রমে, এত বিশাল আয়েজনকেও শৃঙ্খলার সুনিপুণ ফিতায় যেন সুন্দরভাবে বেঁধে রেখেছিল প্রতিক্ষণ, সুবহানাল্লাহ্।
এক সময কবি আর শিল্পীর সুরমূর্ছনায় ঝংকৃত হতো যে আশাজাগানিয়ার গান, কবিতা-
‘একদিন জনতা জাগবেই
অলিতে গলিতে,
প্রাণের এ দাবিতে…।’
ইসলাম প্রিয় নির্ভীক জনতা সত্যি সত্যিই আজ জেগে উঠেছে।
হ্যাঁ, তাই তো প্রলয় ঝঞ্ঝা মাড়িয়ে,
সকল অসম্ভবকে সম্ভব করে
স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে
জনতার প্রতিরোধের মিছিলে রাজপথ কাঁপিয়ে,
ঢুকে পড়েছিল নগরীর অলিতে গলিতে!
সত্যের সুমহান মুক্তির লক্ষ্যে
এই বীর জনতা শুধু জেগে ওঠেনি,
বুকের তপ্ত রক্ত ঢেলে
৩৬ জুলাইয়ের প্রদীপ্ত দ্বিপ্রহরে
দ্বিতীয় স্বাধীনতার বিজয় কেতন
ছিনিয়ে এনেছিল।
তারই পথ ধরে সত্যের পতাকাবাহী
আগুনের ফুলকি সম নারী-পুরুষ জড়ো হয়েছিল প্রায়
দশ হাজার সর্বোচ্চমানের জনশক্তি!
একই স্থানে অথচ পৃথক ব্যবস্থপনায়,
কি অপূর্ব শৃঙ্খলা আর সুব্যস্থাপনা!
“আগুনের ফুলকিরা
এসো জড়ো হই দাবানল জ্বালবার মন্ত্রে, বজ্রের আক্রোশে আঘাত হানি, মানুষের মনগড়া তন্ত্রে ॥”
প্রবেশমুখে অভ্যর্থনায় নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবী বোনদের আন্তরিক অভিবাদনের সাথে ডেলিগেট কার্ড গলায় পরিয়ে দেয়। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বৃষ্টিস্নাত ঠাণ্ডা পরিবেশেও তাদের ঘর্মাক্ত মুখের মিষ্টি হাসিতে মন জুড়িয়ে গিয়েছিল। দায়িত্বশীলা থেকে শুরু করে, ৮-১০টি বিভাগ, ৩০০ শত ভলান্টিয়ারের নিরবচ্ছিন্ন কর্মতৎপরতায় গোটা হলরুমগুলো ছিল কঠোর শৃঙ্খলাপূর্ণ। মহিলাদের অংশ শুধুমাত্র নারীদের ব্যবস্থপনায় ও পরিচালনায় প্রায় তিনহাজার মহিলা ও প্রায় ৭০০ শত শিশুদের মাঝে সকালের নাস্তা বা দুপুরের খাবার বিতরণে কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা চোখে পড়েনি। এখানে খাবার নিয়ে কোনো হইচই ছিল না। কে পেল আর পেল না- এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।
শিশুদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখার জন্য ছিল আকর্ষণীয় শিশু কর্নার। সত্যিই চমৎকার ব্যবস্থপনায় সকল বিভাগগুলো পরিচালিত হয়েছে।
বের হবার পথে আরেকটি টুকরো চিত্র-
শহীদ জায়া তামান্না আপা ও কামারুজ্জামান ভাবীকে সাথে নিয়ে আমরা যখন গেটের কাছে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, গাড়ি আসতে দেরি দেখে গেটে স্বেচ্ছাসেবক ভাইদের কাছে ভাবীদের বসার জন্য চেয়ার চাইবার সাথে সাথে সবাই নিজেদের চেয়ার ছেড়ে উঠে যান!
আমাদের সকলের জন্য চেয়ারগুলো খালি করে দিলেন। নারীদের প্রতি এমন সম্মান, শ্রদ্ধা আর বিনয় দেখে আগামীর ব্যাপারে অনেক আশান্বিত হলাম! আলহামদুলিল্লাহ্!
বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে সর্বোচ্চ মানের সদস্যদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি যেন নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসের হৃদয় জুড়ানো, নয়ন জুড়ানো আগামীর এক টুকরো নিরাপদ বাংলাদেশের ছবি। যেখানে নারী, পুরুষ যে যার অবস্থানে থেকে স্বাধীনভাবে তাদের সর্বোচ্চটা করে যাবার অবারিত সুযোগ পাবেন। কেউ কারো জন্য বাঁধাতো হবেনই না, বরং নেগেটিভ-পজিটিভ তারের মতো পাশাপাশি থেকে দায়িত্ব পালন করে যাবেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এমন একটি নারীবান্ধব আগামীর বাংলাদেশ দেখার প্রত্যাশায় আমরা সবাই।
বৃষ্টিস্নাত সেদিন ভোরের প্রকৃতি যেন স্বৈরাচারের বিষবাষ্প ও পঙকিলতাকে ধুয়েমুছে সাফ করে নতুন চলার পথকে করেছে পবিত্র, আরো পরিচ্ছন্ন ও উর্বর! পবিত্র কুরআনে ইসলামী আন্দোলনের এ অনুকূল ও উর্বর পরিবেশে বেড়ে ওঠার সফলতা।
সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে-
“এ এমন একটি চারা গাছ যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর তা নিজ কাণ্ডের ওপর শক্ত ও মজবুত হয়ে দাঁড়ায় এবং যা চাষিকে আনন্দে অভিভূত করে- যাতে আল্লাহ তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তজর্¦ালা সৃষ্টি করেন। আর তাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন।” [সূরা ফাতহ : ২৯]।
মহান আল্লাহ্ দীনের জন্য আত্মার এ সম্পর্ককে আরো মজবুত করুন, আমল-আখলাক ও যোগ্যতায় আরো উচ্চতা আর অনন্যতা দান করুন।