সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টারা কি অবহিত নন?
২২ মে ২০২৫ ১৭:০০
॥ আহমদ হাসান॥
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চলছে দাবি-দাওয়া আদায়ে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশা গ্রুপের সভা-সমাবেশ, মিছিল, ঘেরাও-অবরোধ ও অবস্থান। বিগত ৯ মাস ধরে যেন চলছে দাবি-দাওয়া আদায়ের এক ভরা মৌসুম। তাদের এসব কর্মসূচিতে রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রসহ অনেক এলাকায় প্রায় দিন অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে। তন্মধ্যে বেশ আলোচিত দুটি ঘটনা হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি-দাওয়া নিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের সমাবেশ ও অবস্থান এবং সাবেক সেনাসদস্যদের জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দাবি-দাওয়া নিয়ে অবস্থান, জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি, ইশরাককে মেয়র ঘোষণার দাবিতে নগর ভবনে বিএনপির নেতাকর্মীদের অবস্থান, শাহবাগে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অবস্থান। এভাবে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন খাত ও বিভাগের লোকজন তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজধানীর প্রধানতম ব্যস্ত সড়ক জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে যেমন অবস্থান করছে, তেমনি রাজধানীর অন্য রাজপথেও এ ধরনের কর্মসূচি পালন করতে দেখা যাচ্ছে। আর এতে করে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও স্থানগুলোয় এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে। এক-দুটিতে তুলকালাম কাণ্ডও ঘটেছে। বিশেষ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্তদের দাবি-দাওয়া নিয়ে।
একটি গ্রুপের দাবির সুরাহা না হতেই রাজপথে নতুন নতুন গ্রুপ ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে আসছে। এসব দাবি-দাওয়ার পেছনে নানা ষড়যন্ত্র ও নাশকতার আশঙ্কাও করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এসব দাবি আসছে অরাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে। অনেক দিক থেকে এ সরকারকে ব্যর্থ করার চেষ্টায় নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলনের কর্মসূচি হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। সব মিলিয়ে আন্দোলনের নামে রাজধানীজুড়ে চলছে এক ধরনের নৈরাজ্য।
কিন্তু এসব দাবি-দাওয়া মিটিয়ে ফেলা বা তাদের সাথে আলোচনা করে একটা সমাধানে পৌঁছার ব্যাপারে কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তথা সরকারের উপদেষ্টাদের তেমন তৎপর দেখা যাচ্ছে না। তারা কি এসব ঘটনার খবর জানেন না, তারা কি অবহিত নন, নাকি জেনেও না জানার ভান করে দায়িত্ব এড়িয়ে চলছেন?
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে মিছিল-মিটিং-সমাবেশ ও অবস্থান করতেই পারেন। তাদের দাবি-দাওয়া জনগণের কাছে নয়, দাবি-দাওয়া সবসময়ই সরকার তথা প্রশাসনের কাছেই করা হয়ে থাকে। তাদের অনেক দাবি ন্যায্য হতে পারে আবার অন্যায্যও হতে পারে। এসব শ্রেণি ও পেশার সংগঠন ইতোপূর্বে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে নাগরিক স্বাধীনতা না থাকায় দাবি করতে পারেনি। আবার এমন কিছু গ্রুপ থাকতে পারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই দাবি-দাওয়া করার সুযোগটা নিচ্ছে।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠন ও গ্রুপের এসব দাবি-দাওয়া আদায়ে মিছিল-মিটিং ও অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে দেশের প্রধানতম একটি দৈনিক যুগান্তর গত ১৯ মে প্রথম পাতায় লিড নিউজ করেছে। পত্রিকাটির ঐ লিড নিউজটির শিরোনাম ছিল, ‘রাজধানী এখন দাবির শহর’। শিরোনামটির সোল্ডারে বলা হয়েছে, ‘মিছিল-সমাবেশ, অবরোধ-ঘেরাও কর্মসূচিতে জনকষ্ট চরমে’।
পত্রিকাটির শীর্ষ খবরটিতে বলা হয়, “রাজধানী ঢাকা রীতিমতো দাবির শহরে পরিণত হয়েছে। ছোট-বড় যে কোনো ইস্যুতে মুহূর্তেই উত্তাল হয়ে উঠছে রাজপথ। প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে মিছিল, সমাবেশ, অবরোধ, ঘেরাও ও আলটিমেটাম দেওয়ার মতো কর্মসূচি। শুধু রাজপথই নয়, প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরও এর বাইরে নেই। এসব কর্মসূচি ঘিরে ব্যস্ততম নগরীজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে একরকম অচলাবস্থা। যানজট যেন নগরবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী। চরমে উঠেছে জনকষ্ট। অন্তর্র্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে এমন চিত্র। কখনো থেমে থেমে আবার কখনো বিরতিহীনভাবে পালিত হয় এসব কর্মকাণ্ড। কিন্তু একরকম নির্বিকার কর্তৃপক্ষ। যদিও এগুলো থামাতে একাধিকবার দেওয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
আন্দোলনকারীদের দমাতে রবার বুলেট, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, লাঠিচার্জসহ নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। কিন্তু আসেনি কোনো ইতিবাচক ফল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে, ঠিক তখনই চাপের মুখে নতি স্বীকার করছে সরকার। তড়িঘড়ি করে মেনে নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ দাবি। অথচ আন্দোলনের শুরুতে উদাসীনতা না দেখিয়ে সহজেই করা যেত সমস্যার সমাধান। আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। ফলে পরিস্থিতি শান্ত হচ্ছে না। কয়েকদিন বিরতি দিয়ে দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হচ্ছে অন্য প্রতিষ্ঠান। আবারও উত্তপ্ত হচ্ছে রাজপথ।
এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থা যেন রাজধানীর ‘স্থায়ী সংস্কৃতি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১৮ মে রোববারও এর ব্যত্যয় হয়নি। এদিন চাকরিচ্যুত সেনাসদস্যদের জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি, দক্ষিণ সিটির মেয়র পদে ইশরাকের শপথের ব্যবস্থা করাতে টানা চতুর্থ দিনের মতো বিক্ষোভ, সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে শাহবাগ থানা ঘেরাও, শাহবাগ মোড় অবরোধ এবং অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে খুনিদের খুঁজে বের করতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে সাদা দল। এছাড়া জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি, বেতনের দাবিতে মাউশি ঘেরাও, বিজয়নগরে বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের ঘোষণা না দিলে দেশ অচলের ঘোষণা শ্রমিকদের, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের কাফনের কাপড় নিয়ে মিছিল, হাইকোর্টের মাজার গেটের সামনে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য স্পষ্টতই সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অদক্ষতা প্রকাশ পাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।”
রাজপথে দাবি-দাওয়া নিয়ে দেশের অন্যতম আর একটি জনপ্রিয় দৈনিক আমার দেশ গত ২০ মে ‘আন্দোলনে নৈরাজ্য’Ñ এ শিরোনামে প্রথম পাতায় লিড নিউজ প্রকাশ করে। খবরটিতে বলা হয়েছে, “আন্দোলনের কারণে রাজধানীজুড়ে এখন ব্যাপক নৈরাজ্য চলছে। প্রতিদিনই রাজপথে দেখা যাচ্ছে কোনো না কোনো আন্দোলন কর্মসূচি। এসবের মধ্যে রয়েছে মিছিল-সমাবেশ, অবরোধ, ঘেরাও ইত্যাদি।
ফলে রাজধানীতে তীব্র যানজট হয়ে উঠেছে নিয়মিত ঘটনা। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। ব্যাঘাত ঘটছে সরকারের স্বাভাবিক কাজকর্মেও। আন্দোলনকারীদের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সুযোগসন্ধানীরাও তৎপর। তারা সুকৌশলে ষড়যন্ত্রমূলক নানা ঘটনাও ঘটাচ্ছে।
জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণ ও শাহবাগ আন্দোলনের ‘হট স্পটে’ পরিণত হয়েছে। এ দুটি স্থানে প্রায় প্রতিদিনই থাকে নানা কর্মসূচি। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে এসব আন্দোলন মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত আট মাসে এমন ২৫০টিরও বেশি কর্মসূচি হয়েছে রাজধানীতে।
স্পটগুলোয় গিয়ে দেখা যায়, আন্দোলনকারীদের কোনো কোনো দাবির যেমন যৌক্তিকতা রয়েছে আবার অযৌক্তিক কিছু দাবিও সামনে আসছে। দীর্ঘদিনের ‘বঞ্চনা’ আর ‘ক্ষোভের’ এসব আন্দোলন নিয়ে প্রথমদিকে সরকার নমনীয় অবস্থানে থাকলেও ক্রমান্বয়ে সরকারও অনেকটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। এজন্য লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল নিক্ষেপসহ শক্ত হাতে আন্দোলন দমন করতে হচ্ছে। কখনো কখনো নিষেধাজ্ঞাও জারি করতে হচ্ছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার ঘটনাও ঘটছে।
শুরুর দিকে এসব আন্দোলনকে স্বাভাবিক মনে করা হলেও এখন ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা করা হচ্ছে খোদ সরকারের তরফ থেকে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক আন্দোলনের পেছনে ষড়যন্ত্র থাকার কথা সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে। এর আগে একটি বাহিনীর সচিবালয়ে ঢুকে পড়ার ঘটনার পেছনে ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা করেছিল সরকার।”
মিছিল, মিটিং, অবস্থান, অবরোধ নিয়ে মানবজমিন গত ২১ মে ‘এ দুর্ভোগের শেষ কোথায়?’ শিরোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রচার করে।
রাজপথে এসব দাবি-দাওয়া নিয়ে মিছিল মিটিং অবস্থান করার নামে যেসব আন্দোলন চলছে, সেটি এখন সংবাদমাধ্যমসহ সাধারণ জনগণের নজরে এসেছে। তাই সংবাদমাধ্যমগুলো গুরুত্ব সহকারে লিড নিউজ হিসেবে প্রকাশ করছে। কিন্তু যাদের এ নিয়ে দায়িত্ব রয়েছে, তাদের টনক নড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। আর এসব দাবি-দাওয়া রাজনৈতিক দল বা তাদের রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠনগুলোরও নয়। অধিকাংশই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা সরকারি, আধাসরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের দাবি-দাওয়া।
বাংলাদেশ বিশাল জনসংখ্যার দেশ, প্রায় ১৭ কোটি মানুষ। জনসংখ্যার তুলনায় সহায়-সম্পদ কম। তাই জনগণের একটি বড় অংশ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে। দেখা গেছে যারা সর্বহারা ও নিঃস্ব তারা কোনোরকমে দিনে আনে দিনে খায় অবস্থায় আছে। অপরদিকে একটি শ্রেণি অর্থ-সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধায় অনেক উপরে। এছাড়া মধ্যবর্তী একটি শ্রেণি আছে, যারা সরকারি ও বেসরকারি চাকরি করে। এ মধ্যবতী শ্রেণি, যাদের চাকরি-বাকরি আছে রাষ্ট্র থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, তারাই আরো বেশি বেশি পেতেই মিটিং-মিছিল করে আন্দোলন করছে। তারা সরকারি বা আধাসরকারি চাকরি করে কিছু না কিছু অর্থ পাচ্ছে। আবার তারাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামছে।
এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তথা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, প্রশাসন ও সচিবদের যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে যারা দাবি-দাওয়া করছে তাদের বিষয়গুলো কী তা ভালো করে জেনে যথাযথভাবে ডিল করার দায়িত্ব। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকার ও প্রশাসন তাদের দাবি-দাওয়া শুনবে, আলোচনা করবে, তারপর দাবিগুলো যুক্তিযুক্ত হলে এবং রাষ্ট্রের সক্ষমতা থাকলে দাবি পূরণ করবে আর না পারলে সময় নেবে বা পরবর্তীতে দাবিগুলো পূরণ করার আশ্বাস দেবে ইত্যাদি উপায়ে একটি সমাধানের দিকে যাবে। তাদের দাবিগুলো যদি ন্যায্য হয় এবং মানা সম্ভব হয়, তা তাদেরকে জানানো উচিত। আর যদি ন্যায্য না হয় এবং বাস্তবায়নযোগ্য না হয়, তাও তাদের জানানোর পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের দ্বারা জনগণকে অবহিত করা উচিত। প্রয়োজনীয় যুক্তি ও ব্যাখ্যা করে জনসাধারণের সামনে পরিষ্কার করতে হবে। তাদেরকে সংবাদমাধ্যমের সামনে সবকিছু জানাতে হবে। যদি এভাবে জানানো না হয়, তখন জনমনে একটি সন্দেহ-সংশয় তৈরি হবে। তারা বলবে যারা দাবি করছে তাদের দাবি-দাওয়া সরকার না মেনে অবিচার করে ঠকাচ্ছে। এসব বার্নিং ইস্যুগুলো যখন শুরু হয়, তখনই সরকারের উচিত সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ করে কথা বলা। যেসব দাবি যারা করছে, তারা কোনো না কোনোভাবে সরকার ও প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট। তাদের দাবি-দাওয়া রাজপথে উত্থাপনের আগেও প্রশাসনের জানার সুযোগ রয়েছে। সরকারের বেশ কটি গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। তাদের মাধ্যমেও সরকার ও প্রশাসন জানতে পারে কারা কোন সংগঠন বা গ্রুপ কী কী দাবি নিয়ে রাজপথে যাচ্ছে। তারা রাজপথে আসার আগে তাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কোনো না কোনোভাবে জানিয়েছে। তারপর তারা রাজপথে এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজপথে অবস্থানকারী এসব দাবি-দাওয়ার বিষয়ে সরকার, সরকারের উপদেষ্টা ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের তৎপর বলে মনে হচ্ছে না। দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিস্পৃহ ও উদাসীনতার কারণে জনমনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার তৎপর নয় এবং কার্যকর নয় ।
আমরা ধরে নিলাম অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, বিচার সংস্কার, নিবাচন ও রুটিন কাজ। অন্যান্য বিষয় আসয় তাদের এখতিয়ারের মধ্যে না। তবে রাজপথে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার লোকজন যেসব দাবি-দাওয়া পেশ করছে, সেগুলোর বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া সরকার ও প্রশাসনের রুটিন কাজ। এসব কাজে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের অনেকটা উদাসীন ও নির্বিকারই মনে হচ্ছে। রুটিন কাজে যেমন উপদেষ্টারা সক্রিয় হবেন, তেমনিভাবে উপদেষ্টারা যেসব মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্বে সেসব মন্ত্রণালয়গুলোর সচিবদেরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু এসব দাবি-দাওয়ার সাথে সরকার তথা প্রশাসন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষ করে প্রশাসনের সচিবদের এসব সমস্যা ও দাবি-দাওয়া নখদর্পণে। অথচ সচিবদের এ ব্যাপারে কোনোরকম উদ্যোগ ও তৎপরতা আছে বলে মনে হচ্ছে না। এসব সচিব তথা আমলাদের ব্যাপারে দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যথাযথ একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমলা, ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদরা মিলে আওয়ামী লীগের আমলে চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন রাজনীতিবিদরা পালিয়ে গেছেন, ব্যবসায়ীরা ম্রিয়মাণ আর আমলারা পুরো শক্তি নিয়ে পুনরুজ্জীবিত।’ গত ১৯ মে রাজধানীতে একটি সেমিনারে বক্তব্য প্রদানকালে এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
আমলারা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে নিজেদের স্বার্থে। কিন্তু দেশ ও জাতির জন্য উনাদের অবদান খুঁজতে গেলে দুরবিন দিয়েও কিছু পাওয়া যাবে কিনা, সন্দেহ। ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানে ছাত্র-জনতা রক্ত ঘাম ঝরালেও প্রশাসনের এ আমলাদের কোনোরকম উপস্থিতি দেখা যায়নি জনগণের কাতারে। অভিজ্ঞজনদের অভিমত, দেশের রুটিন কাজে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের নির্বিকার ও উদাসীন থাকার কারণও এ আমলাদের অসহযোগিতাই প্রধান কারণ। তবে উপদেষ্টারা যেহেতু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাই তাদের আমলাদের ওপর নির্ভর করলে যথাযথ দায়িত্ব পালন করা হবে না। উপদেষ্টাদের নিজেদেরই উদ্যোগ নিয়ে সমস্যা সমাধানে আমলাদের কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশের আমলারা কোনো সময়ই দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে নিজেদের বিলিয়ে দেয়নি। অভিযোগ রয়েছে দেশের আমলারা সব সরকারের আমলেই নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। ড. দেবপ্রিয় একজন অভিজ্ঞ সজ্জন বুদ্ধিজীবী, তিনি আমলাদের বিষয়ে যথাযথ মন্তব্যই করেছেন। আশা করা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের নামে রাজপথের বিশৃঙ্খল অবস্থার নিরসনে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।