মরণ ফাঁদ ফারাক্কা বাঁধের ৫০ বছর

পরিবেশগত বিপর্যয়ে বাংলাদেশ


১৫ মে ২০২৫ ১৫:৩৬

বিলীন হয়ে গেছে ৫৪ নদনদী, ক্ষতিগ্রস্ত ৪ কোটি মানুষ
॥ সাইদুর রহমান রুমী ॥
ভারতের তৈরি মরণবাঁধ ফারাক্কার ৫০ বছর অতিক্রান্ত। ফারাক্কার ধ্বংসাত্মক প্রভাবে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদনদী ধ্বংস হয়ে মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের অন্তত ২৬টি জেলার ৪ কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মাসহ ছোট-বড় ৫৪টি নদনদী বিলীন এবং কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত ও সর্বস্বান্ত হয়েছে। মরুকরণের পাশাপাশি লবণাক্ততা বেড়ে দেশজুড়ে এক মারাত্মক প্রতিবেশগত বিপর্যয় বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সব আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু রেখেছে ।
উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের ৫৪ নদনদীর অস্তিত্ব বিপন্ন
ভারতের তৈরি ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মার পানিপ্রবাহের ওপর নির্ভরশীল দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৫৪টি নদনদী শুকিয়ে বর্তমানে মৃতপ্রায়। এককালের খরস্রোতা নদনদীগুলো এখন পরিত্যক্ত নালা বা খালে পরিণত হয়েছে। যেগুলোর বেশিরভাগেই বছরের অধিকাংশ সময় পানি থাকে না। কোনো কোনোটি অস্তিত্ব হারিয়েছে। এসব নদনদীর ওপর নির্ভরশীল কয়েক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সেচ প্রকল্প। নদনদীগুলো মরে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে নৌচলাচলের পথও। এসব নদনদীর বুকে এখন বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। কিন্তু এসব ফসলের পর্যাপ্ত সেচ দেয়ার জন্য আর পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৬টি জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত এসব নদনদী মরে যাওয়ায় ভূ-প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সাড়ে ৪ কোটির বেশি মানুষ। এসব জেলার পানির স্তরও নেমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। ফারাক্কার প্রত্যক্ষ প্রভাবে বন্ধের পথে গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পও। এমনকি সুন্দরবন অঞ্চলের নদনদীতেও বেড়েছে লবণাক্ততা।
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ৪ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা, ব্যবসা-বাণিজ্য। হারিয়ে যাচ্ছে বড়াল, নারদ, সন্ধ্যা, স্বরমংলা, নবগঙ্গা, দয়া, হোজা, বারাহী, ইছামতী, আত্রাই, মহানন্দাসহ অসংখ্য নদী। এর মাঝে ফারাক্কার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হচ্ছে- চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বশেষ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনকষা ইউনিয়নের তারাপুর এবং পাকা ইউনিয়নের পাকা সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার উজানে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সরসেরগঞ্জ থানার গ্রাম ফারাক্কা। এখানে গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত ১১৯টি লকগেটবিশিষ্ট বাঁধটির নামকরণ হয় ফারাক্কা বাঁধ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মার তীরবর্তী পাকা ইউনিয়নের বোগলাউড়ি, জগন্নাথপুর, মনোহরপুর, উজিরপুর, নারায়ণপুর, সুন্দরপুর ও চরবাগডাঙ্গা এলাকাগুলো এখন শুধু ধু-ধু বালুচর। একটি সরু চ্যানেলে পদ্মার পানিপ্রবাহ কোনোভাবে সচল আছে। বছর বছর পদ্মার পানিপ্রবাহ ক্ষীণ হওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ৬টি নদনদীও পানিশূন্য হয়ে মৃতপ্রায় খালে পরিণত হয়েছে। শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা, বিনোদপুর ও দুর্লভপুর ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত চকের নদী উজানে ভারতের মালদহ জেলার হরিশচন্দ্রপুর পয়েন্টে গঙ্গার শাখা নদী হিসেবে উৎপত্তি হয়ে বিনোদপুর পয়েন্টে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। প্রায় ৫০০ মিটার প্রশস্ত এককালের খরস্রোতা চকের নদীটি ৩০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে শিবগঞ্জের বোগলাউড়িতে গিয়ে পদ্মায় পড়েছে। তবে নিষ্কাশনমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্ষাকালেও চকের নদী এখন বদ্ধ খালে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে ঢাকায় বসবাসকারী চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, স্বাধীনতার পরও চকের নদী দিয়ে বড় বড় মালবাহী নৌকা চলাচল করত। নৌকায় করে আশপাশের ২০ গ্রামের মানুষ মনাকষার হাটে এসে ধান, পাটসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য বিক্রি করত। এ নদীটির অস্তিত্ব এখন পুরোপুরি বিপন্ন। এখন নদীর বুকজুড়ে চাষ হচ্ছে ধান। তারা জানান, আরও কয়েক বছর পরে আগামী প্রজন্ম জানবেই না এখানে একটি খরস্রোতা নদী ছিল। এভাবে ফারাক্কার প্রভাবে চকের নদীটিসহ উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ নদীগুলোরই একই অবস্থা।
বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী আহমেদ ফারুক বলেন, ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের প্রধান নদী পদ্মাকে মেরে ফেলায় এর সাথে সংশ্লিষ্ট শাখা নদীগুলোও ধ্বংসপ্রায়। যেমনÑ চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রাচীন নদীগুলোর একটি পাগলা নদী। প্রায় ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাগলা নদীটি পাঁচ যুগ আগেও একটি গভীর নদী ছিল। গঙ্গার শাখা নদী শিবগঞ্জের শাহবাজপুর এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কানসাট-শিবগঞ্জ বাজার হয়ে ৪১ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কালীনগরের কাছে মহানন্দা নদীতে পড়েছে। এককালের তীব্র খরস্রোতা পাগলা নদী এখন একটি সরু নালায় পরিণত হয়েছে। কয়েক বছর আগে পাগলা নদী খনন করা হলেও তাতে ফেরেনি স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ। পাগলা নদীর দুই কোল দখল করে ধান করছে আশপাশের লোকেরা। নৌচলাচলও প্রায় বন্ধ। একইভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আরেক বড় নদী মহানন্দার অবস্থাও মরমর। ভারতের মালদহের ভেতর দিয়ে ভোলাহাট পয়েন্টে মহানন্দা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে রহনপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর উত্তরে গিয়ে পদ্মায় বিলীন হয়েছে। প্রায় ৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মহানন্দা নদীও এখন বিপন্নপ্রায় একটি নদীতে পরিণত হয়েছে। বছরের চার মাস পানি থাকলেও বাকি আট মাস নদীর দুই কোলজুড়ে চাষ হচ্ছে ধানসহ বিভিন্ন ফসল। আবার মহানন্দা এ জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুনর্ভবা নদীটিও ক্ষতিগ্রস্ত নদীগুলোর একটি। একইভাবে ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মায় পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিক মাত্রায় কমে যাওয়ায় ব্যাপক বিপন্নতার শিকার হয়েছে রাজশাহীর বড়াল নদীও। বড়াল পদ্মার অন্যতম একটি শাখা নদী। আবার রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মা থেকে উৎপত্তি হয়ে আড়ানী, নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর হয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী দিয়ে মরা হুরা সাগর দিয়ে ১৪৭ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পাবনার নাকালিয়ায় যমুনা নদীতে গিয়ে বিলীন হয়েছে বড়াল। বড়ালের উৎসমুখ থেকে পদ্মার পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। বড়ালের উৎসমুখে পড়েছে বিশাল বালুস্তর। বর্তমানে বড়াল একটি সরু নালায় পরিণত হয়েছে। নদীর কোথাও পানি আছে, কোথাও নেই। বড়ালের বুকে চলছে ফসলের চাষ। পাশাপাশি পানি না থাকায় দীর্ঘপথে বড়ালের দুই পাড় দখল হয়ে গেছে। গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা। বড়ালের তীরে গড়ে ওঠা প্রাচীন ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র আড়ানীর প্রবীণ ব্যবসায়ীরা জানান, ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর পদ্মায় পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় শাখা নদী বড়ালও ধীরে ধীরে মরতে শুরু করে। স্বাধীনতার সময়েও বড় বড় মালবাহী নৌকা আসত আড়ানীতে। এখন এসব স্বপ্নমাত্র। বড়ালের বিপন্নতায় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশি। বড়ালের পানি তুলে দুই তীরের হাজার হাজার বিঘা জমিতে ফসল ফলানো হতো। সেসব সেচ প্রকল্প প্রায় বন্ধ।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মার শাখা নদী রাজশাহীর মুসাখান, নাটোরের নারদ এবং ১১টি নদীর পানিপ্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ফারাক্কার প্রভাবে রাজশাহীর হারিয়ে যাওয়া পদ্মার শাখা নদীগুলো হলো- নারদ, সন্ধ্যা, স্বরমংলা, নবগঙ্গা, দয়া, হোজা, বারাহী ও চিনারকুপ। এর মধ্যে নারদ নদীতে খননকার্য পরিচালনা করে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার কাজ করেছিল বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তবে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক হচ্ছে না উৎসমুখে পানি না থাকায়।
ফারাক্কা বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর নদনদীর মধ্যে পদ্মার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা নদী পাবনার ইছামতী। ইছামতী নদীটি পাবনার রূপপুরের ভাড়ারা গ্রামের কাছে পদ্মার প্রবাহ থেকে শাখা নদী হিসেবে উৎপত্তি হয়ে বেড়া শহরের ভেতর দিয়ে ৫০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে মরা হুরাসাগর নদীতে পতিত হয়েছে। পাবনা এলাকার আত্রাই হচ্ছে ইছামতীর একটি শাখা নদী। ইছামতী ও আত্রাই দুটি নদী এখন মৃতপ্রায়। বিগত আওয়ামী লীগের সময় ইছামতীর দখল একটি আলোচিত ইস্যু। একইভাবে ফারাক্কার প্রতিকূল প্রভাবের কারণে পদ্মার শাখা নদী কুষ্টিয়ার গড়াই এখন মহাবিপন্ন নদী। নদী গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন মতে, গড়াই হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাইফ-লাইন। প্রায় ৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ গড়াই ঝিনাইদহ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর হয়ে নড়াইলে গিয়ে মধুমতী নাম নিয়ে বাগেরহাটে গেছে। ফারাক্কার প্রভাবে গড়াই নদীর পানিপ্রবাহ নেই বললেই চলে।
ফারাক্কা বাঁধে ক্ষয়ক্ষতি
ফারাক্কা লংমার্চ দিবস উদযাপন কমিটির রাজশাহীর অন্যতম নেতা মাহবুব সিদ্দিকী এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ, দক্ষিণাঞ্চলের চার কোটি মানুষ এবং বাংলাদেশের গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের অধিকাংশ এলাকা বর্তমানে সেচের পানির অভাবে ভুগছে। তিনি বলেন, ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নদীর উজানে ব্যারাজ নির্মাণ করে পদ্মা নদী থেকে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে লংমার্চের নেতৃত্ব দেন। লংমার্চের চাপে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের সঙ্গে পানিবণ্টনের চুক্তি করেছিল। সিদ্দিকী বলেন, ফারাক্কা ব্যারাজের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের মাটির উর্বরতা কমে গেছে, প্রায় ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ ও ৪২ শতাংশ গভীর নলকূপ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে দেশের প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ, হাজার হাজার জেলে কর্মসংস্থান হারিয়েছে, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের ১৭ শতাংশ লবণাক্ততায় হারিয়ে গেছে। সিদ্দিকী একটি সমীক্ষার উল্লেখ করে বলেন, ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সামগ্রিক ক্ষতি হয়েছে এক লাখ ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে বলে তিনি জানান।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন জানান, তাদের এক গবেষণায় দেখেছেন উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগের সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মার ৮০ শতাংশ পানির প্রবাহ কমে গেছে এখন।
বিশিষ্ট কলামিস্ট, সাংবাদিক, ফারাক্কা বাঁধ বিশেষজ্ঞ ও গ্রন্থ রচয়িতা, রাজশাহী অঞ্চলের বাসিন্দা সরদার আবদুর রহমান বলেন, আমরা কেবল জানি যে, ভারত ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে গঙ্গার পানি আটকে রাখে। কিন্তু এটি হয়তো জানা নেই যে, ফারাক্কার আরো উজানে ভারত তার বহুসংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। শুধু ফারাক্কা নয়Ñ ভারত গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ নির্মাণ করছে অসংখ্য ছোট-বড় কাঠামো। ফারাক্কা বাঁধ ছাড়াও ভারত নদীসদৃশ ৭টি ক্যানেল বা কৃত্রিম খাল প্রকল্পের মাধ্যমে লাখ লাখ কিউসেক পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নিয়ে কয়েক লাখ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করছে। তারা অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহদাকার তিনটি খাল (ক্যানেল) প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এ ধরনের প্রকল্পের হাজার হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে সেচ দেয়ার ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আবার গঙ্গা ক্যানেল প্রকল্পের মাধ্যমে উত্তরপ্রদেশের ২৫ লাখ একর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে ৬ হাজার কিলোমিটারের বেশি খাল কেটে পদ্মার পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পে মূল ও শাখাসহ খননকৃত খালের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার। নিম্নগঙ্গা সেচ প্রকল্পের জন্য ৬ হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এভাবে এসব উৎসের শতকরা ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে নদীতে মাত্র ১০ ভাগ পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে। আন্তর্জাতিক এ নদীতে বাঁধের পর বাঁধ দিয়ে প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার ফলে মূল গঙ্গা তার উৎসের কাছে হারিয়ে যেতে বসেছে। অর্ধশতাব্দীর মধ্যে গঙ্গা নদীর প্রবাহ ২০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। সব মিলিয়ে ভারতের নানা উচ্চাভিলাষী কর্মপরিকল্পনার শিকার হয়ে ভাটির দেশ বাংলাদেশ এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে।
এ পরিস্থিতিতে ফারাক্কা বাঁধে জমা হওয়া পানির ভাগাভাগি হওয়া একটা শুভঙ্করের ফাঁকি মাত্র। আমি মনে করি, এ অবস্থায় কমপক্ষে এটুকু সমাধান আশা করা যেতে পারে যে উপরি কাঠামো বজায় রেখে কেবল ফারাক্কা বাঁধের গেটগুলো অপসারণ করতে হবে।
বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন রাজশাহী শাখার সভাপতি প্রফেসর ড. ইফতিখারুল আলম মাসউদ বলেন, ১৯৯২ সালের মে মাসে নয়াদিল্লিতে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের এক বৈঠকে গঙ্গা ও তিস্তাসহ অন্যান্য প্রধান নদীর পানিপ্রবাহ বণ্টনের জন্য সমতাভিত্তিক ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যাপারে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ফারাক্কায় গঙ্গার পানিপ্রবাহ সমতার ভিত্তিতে বণ্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পানি সমস্যা এড়ানোর জন্য সব প্রচেষ্টা চালানো হবে। কিন্তু পরে ভারতের পক্ষ থেকে এ চুক্তির ব্যাপারে আর কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। ফলে ১৯৯৩ সালের ১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪৮তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার ভাষণে ফারাক্কা প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। ১৯৯৫ সালের মে মাসে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া বিষয়টি আবারও উত্থাপন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু তাতেও সমস্যা সমাধানের কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি। ফলে ১৯৯৫ সালের ২৩ আক্টোবর জাতিসংঘের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ফারাক্কা প্রসঙ্গ পুনরায় তুলে ধরে বলেছিলেন, বাংলাদেশের ৪ কোটি মানুষ গঙ্গার পানির ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু ভারত একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় এ ৪ কোটি মানুষ অবর্ণনীয় দুর্দশায় পতিত হয়েছে। তিনি এ সংকট সমাধানে সহায়তা করার জন্য জাতিসংঘে সমবেত বিশ্বনেতৃবৃন্দের নিকট এ আহ্বান জানান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি ইস্যু নিয়ে ৩০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি দুর্বল একটি চুক্তি করেন। কিন্তু ৩ মাসের মধ্যেই সে চুক্তি ভারত অকার্যকর করে দেয়। ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশ মাত্র ৬ হাজার ৪৫৭ কিউসেক পানি পায়, যা ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর সর্বনিম্ন প্রবাহ ছিল। অথচ চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের পানি পাওয়ার কথা ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক। চুক্তির শর্ত অনুসারে ফারাক্কা পয়েন্টে সর্বনিম্ন ৭০ হাজার কিউসেক পানি থেকে বাংলাদেশকে ভারত ৫০ হাজার কিউসেকের সমানভাবে অর্ধেক (২৫ হাজার কিউসেক) পাবে এবং বাকি ২০ হাজার কিউসেক ৭ নদীর নাব্য রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হবে। ১৯৭৭ সালের পানি চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লোজ ছিল, কিন্তু এ চুক্তিতে তা না থাকায় ভারত বাংলাদেশকে তার ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য ছিল না। ফলে বাংলাদেশ পানি কম পেলেও তার প্রতিবাদ করার সুযোগ নেই। এছাড়া চুক্তিটিতে আন্তর্জাতিক সালিশিতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ নেপালের সাথে মহাকালি নদী চুক্তিতে ভারত আন্তর্জাতিক আর্বিট্রেশন মেনে নিয়েছে।