॥ জাকারিয়া আল হোসাইন ॥
চোখে প্রচুর ঘুম আসছে! কিন্তু বাবা শহরে গেছেন। বাড়ির একমাত্র আদরের মেয়ে লামিয়ার জন্য একটি লাল সাইকেল কিনতে। বাবার আসতে দেরি হওয়ায় লামিয়া ঘুমিয়ে পড়ে।
লামিয়া তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। তার অনেক দিনের স্বপ্ন একটি লাল সাইকেল কিনবে। বাবা সারা দিন অফিসে থাকেন। তবে লামিয়াকে আজ কথা দিয়েছেন- রাত হলেও তার সাইকেল নিয়ে বাসায় ফিরবেন, ইনশাআল্লাহ।
রাত তখন এগারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। হঠাৎ চারদিকে আর্তচিৎকারের শব্দ। লাফ দিয়ে ঘুম থেকে ওঠে লামিয়া। বাইরে দেখে পানি আর পানি। লামিয়া ভাবে আমি স্বপ্ন দেখছি না তো। কিন্তু না! সত্যিই চারদিকে বন্যার পানি।
লামিয়াদের বাসাটা দোতলা। প্রথম তলা বন্যার পানিতে একদম ডুবে গেছে। লামিয়ারা দ্বিতীয় তলায় থাকে। সেদিন বাসায় লামিয়া, তার মা ও ছোট ভাই ছিলো। কিন্তু প্রথম তলায় তাদের সবকিছু। ঘুম থেকে উঠে দেখে, মা তার বাবাকে ফোন দিচ্ছেন! কিন্তু বাবা ফোন রিসিভ করছেন না। এতে তার মা কান্না করছেন। মায়ের কান্না দেখে লামিয়াও কান্না করছে। লামিয়ার মা বারান্দা আর ঘরে ছোটাছুটি করছেন। পুরো এলাকা অন্ধকার; পানি আর পানি। সারা দিন হালকা বৃষ্টি ছিলো। এত বড় বন্যা তো হওয়ার কথা নয়। যে পানি আর ভয়াবহ বন্যায় আত্মীয়-স্বজন সবাই ব্যস্ত থাকবেÑ এটাই স্বাভাবিক। তবুও ফোন দিলেন তিনি। কেউ ফোন রিসিভ করছেন না। অফিসে ফোন দিলে ওনারা বলে, স্যার তো চলে গেছে। কোনো খোঁজ পেলেন না লামিয়ার মা। চিন্তাটা আরও বেড়ে গেল। আর্তচিৎকার, কান্না আর নির্ঘুমে কাটলো সেই রাত।
পরদিন সকালের দৃশ্য আরও ভয়াবহ। চারদিকে পানি আর পানি। সবকিছু ডুবে গেছে। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, টিনশেড বাড়িঘর সবকিছু ভেসে যাচ্ছে। শিশু, নারী ও পুরুষসহ কয়েকজনকে ভেসে যেতেও দেখেন তারা। কিন্তু লামিয়ার মা তার বাবার চিন্তায় বার বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। সকল আত্মীয়-স্বজনদের ফোন দিলেন। কিন্তু কেউ তার কোনো খবর জানেন না। ওনার অফিসে আবার ফোন দিলেন, তারাও কিছু জানেন না বললেন। এতে তার মায়ের চিন্তা আরও বহুগুণ বেড়ে গেল। “আল্লাহ্ তুমি কী করলা! কী হচ্ছে! একলা আমি কী করমু এহন। মানুষটা শহরে গেল! এহনো ফিরলো না! আল্লাহ্ তুমি কী করলা!” এভাবেই অনবরত লামিয়ার মা কেঁদে যাচ্ছেন।
তারপর বন্যার পানি কমতে থাকে। দীর্ঘ ৫ দিন পর লামিয়ার বাবার লাশ পাওয়া যায় তাদের বাড়ি থেকে দশ কিলোমিটার দূরে একটি বাঁশঝাড়ের ওপরে। সাথে লামিয়ার জন্য কেনা লাল সাইকেলটা শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন তার বাবা।
এখন সবকিছু স্বাভাবিক, কিন্তু স্কুলে যেতে চায় না লামিয়া। লামিয়ার চোখে এক ধরনের হতাশা। যে লামিয়া সাইকেলের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতো। সারা দিন সাইকেল সাইকেল বলে বাবাকে বিরক্ত করতো। সে এখন সাইকেল পেয়েও সাইকেলের দিকে তাকায় না।
তার ভাবনা, এই বুঝি বাবা অফিস থেকে আসছে। কখন যেন ডাকছে, লামিয়া... লামিয়া... গেটটা খোলো মা। প্রশ্নের পর প্রশ্ন মা, বাবা কখন আসবে অফিস থেকে! বাবা কেন আসে না? বলো মা; বলো না প্লিজ।