ইকবাল কবীর মোহন : একদিনের এক ঘটনা। শাম দেশের ফাহলে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। প্রতিপক্ষ খ্রিষ্টান রোমান বাহিনী। প্রচণ্ড সাহস ও শক্তিমত্তার এক বিশাল বাহিনী রোমানরা। তবে তারা মুসলিম বাহিনীর রণপ্রস্তুতির কথা শুনে ঘাবড়ে গেল। রোমানরা ভাবল, মুসলমানদের সাথে এখনই যুদ্ধ করা সমীচীন হবে না। তাই রোমান সেনাপতি সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এলো।
আবু উবাইদা (রা.) মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি তিনি। অত্যন্ত দক্ষ ও পারদর্শী সেনাপতি হিসেবে সর্বত্র তার নাম উচ্চারিত হতো। সুনিপুণ যুদ্ধবিশারদ হিসেবেও আবু উবাইদা (রা.) সমধিক পরিচিত ছিলেন। সেই সময়ে আরো একজন দক্ষ সমরবিদ ও পারদর্শী কূটনীতিক সাহাবী ছিলেন। তাঁর নাম মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা)। জ্ঞান, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞায় তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ। রোমানদের সাথে সন্ধি আলোচনায় তাই তাঁর নাম এলো সবার আগে। সন্ধি স্থাপনের বিষয়টি অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। আবার রোমান কূটনীতিক বলে কথা। তাই সেনাপতি আবু উবায়দা (রা.) মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-এর নাম ঠিক করলেন। তিনি সময়মতো রোমান সেনাছাউনিতে গিয়ে হাজির হলেন। অভিজ্ঞ ও দুঃসাহসী মুয়াজ (রা)-এর আগমনে রোমান ছাউনিতে রব পড়ে গেল। কিন্তু তাঁবুতে পা রেখেই মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) অবাক হলেন। কারণ অতিশয় জাঁকজমক ও চাকচিক্য করে সাজানো হয়েছে সেই তাঁবু। সেখানে বিছানো হয়েছে সোনালি কারুকাজ করা গালিচা। দেখে মনে হলো, এটা কোনো সেনাছাউনি নয়, বরং এক বাদশাহি বালাখানা।
একজন পদস্থ রোমান সৈনিক তাঁবুর গেটে মুয়াজ (রা.)-কে সাদর সম্ভাষণ জানাল। তারপর রীতি অনুযায়ী তাঁকে আদব ও সম্মানের সাথে তাঁবুর ভেতর নিয়ে গেল। একটি অনিন্দ্যসুন্দর আসনে তাঁকে সযত্নে বসানো হলো। তবে এসব আতিশয্য ও অপ্রয়োজনীয় আয়োজন মুয়াজ (রা.)-এর মোটেও পছন্দ হলো না। তাই তাঁর চোখে-মুখে বিরক্তির ভাব পরিলক্ষিত হলো। তাই তিনি সমবেত খ্রিষ্টানদের লক্ষ করে বললেন, ‘দেখুন ভাই, আমি এমন রাজকীয় গালিচা ও আসন পছন্দ করি না। কারণ দরিদ্র মানুষকে শোষিত ও বঞ্চিত রেখে এসব দামি আসন বানানো হয়েছে। এ কথা বলেই তিনি আসন ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়লেন। মুয়াজ (রা.)-এর এ অবস্থা দেখে খ্রিষ্টানরা তো হতবাক। তারা হতহ্বিল হয়ে পড়ল। তখন তাদেরই একজন পদস্থ সৈনিক বলল, ‘জনাব! আপনি এক মহান ব্যক্তি। আপনি দেশের নামিদামি লোক। চারদিকে আপনার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। অনেকেই আপনাকে সম্মান করে। আমরাও আপনাকে অসম্ভব সম্মান করি। তাই সম্মানজনক স্থানেই আমরা আপনাকে বসাতে চাই। অথচ আপনি তা পরিহার করলেন?’
খ্রিষ্টান সৈনিকের কথা শুনে মুয়াজ (রা.) মুচকি হাসলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘শোন সেনারা! তোমরা আমাকে অনেক বড় বলে মনে করলেও আমি কিন্তু মোটেও তা নই। আমি অতি সাধারণ ও নগণ্য একজন মানুষ। অত সম্মান ও চাকচিক্য আমার প্রয়োজন নেই। আর তাই মেঝেতে বসতেও আমার অসুবিধা নেই।’
মুয়াজ (রা.)-এর মন্তব্য শুনে উপস্থিত খ্রিষ্টানরা আরেকবার বিস্মিত হলো। তারা বলল, ‘কী অবাক কথা বলছেন আপনি! আপনি তো অনেক বড় মাপের মানুষ। আপনি মোটেও সাধারণ নন। তাই মেঝেতে বসা আপনাকে মানায় না। মেঝেতে তো বসবে দাসেরা।’
খ্রিষ্টানদের কথা শুনে মুয়াজ (রা.) আরেকবার হাসলেন। তিনি মনে মনে বললেন, ‘তোমরা তো কিছুই জান না সৈন্যরা। সত্যিই বলেছ, এ মুয়াজই আল্লাহর বড় এক দাস। আর এ দাসের কোনো বিলাসিতা নেই।’
এবার মুয়াজ (রা.) দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘ভাই, তোমরা ঠিকই বলেছ। মেঝেতে বসা দাস শ্রেণির লোকদের কাজ। সমাজে ওরা ছোট, তাই ওরা মেঝে বা মাটিতে বসে। জেনে রাখ, আমিও যে আল্লাহর খুব নগণ্য এক দাস। তাই মেঝেতে বসতে পারায় আমি ধন্য হয়েছি।’
মুয়াজ (রা.) নিজেকে দাস বলে স্বীকার করায় খ্রিষ্টানরা হতবাক হলো। তাই তারা বিস্ময়ের সাথে মুয়াজ (রা.)-এর মুখের দিকে অনেকক্ষণ অপলকনেত্রে তাকিয়ে রইল। তাদের বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটে না। মুয়াজ (রা.)-এর অসাধারণ কথা ও অনুভূতি দেখে তাঁর প্রতি তাদের কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। এরপর একজন রোমান সেনা অবাক ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনার চেয়েও বড় ও মর্যাদাবান ব্যক্তি কী আপনাদের মধ্যে আরও কেউ আছে?’
‘কী বলছ তোমরা? আমি মর্যাদাবান? কে বলল তোমাদের? অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন মুয়াজ (রা.)। জেনে রেখ, মুসলমানদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে নিকৃষ্ট। আমার মতো অধম মুসলমানদের মধ্যে আর কেউ নেই।’-আবারো জানালেন মুয়াজ (রা.)।
এবার খ্রিষ্টানদের বিস্ময় আরও একবার বেড়ে গেল। মুয়াজ (রা.)-এর কথাবার্তা শুনে তারা বেশ ভাবনায় পড়ে গেল। মুসলমানদের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে তারা চিন্তায় পড়ে গেল। মুসলমানদের আচরণ, ঐতিহ্য ও উদারতা তাদের মনকে নাড়া দিল। তারা আরও ভাবনায় পড়ল মুসলমানদের সাহস ও বীরত্ব নিয়ে। ফলে রোমানদের মনে ভয়ের উদ্রেক হলো। তারা ভাবল, মুয়াজ (রা.)-ই যদি একজন সাধারণ মানুষ হন, তাহলে মুসলমানদের না জানি আরও কত অসাধারণ মানুষ আছেন! এমন অসাধারণ ও খোদাভীরু মুসলিম বাহিনীর সাথে লড়াই করা মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু। এদের সাথে যুদ্ধ করে জয়লাভের চিন্তা করাও বোকামি। তাই রোমানরা মুয়াজ (রা.)-এর সাথে সন্ধি স্থাপন করাকেই শ্রেয় বলে মনে করল। ফলে ভয়ানক যুদ্ধের আশঙ্কা আপাতত কেটে গেল।
হিজরি পনেরো সনের আরেকটি ঘটনা। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। কেঁপে উঠল ইয়ারমুক ময়দান। একদিকে মুসলিম বাহিনী; অন্যদিকে ইসলামবিরোধী কুফরি শক্তি। এ সময় লড়াই শুরু হলো। ভয়ানক যুদ্ধ চলছে ইয়ারমুক ময়দানে। কুফরের দল সর্বশক্তি নিয়ে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ যুদ্ধের সেনাপতির দায়িত্ব পালন করছেন স্বয়ং মুয়াজ (রা.)। প্রচণ্ড সাহস ও অমিত তেজ নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন তিনি। কুফর বাহিনী বেশ শক্তিশালী। তাই মুসলিম সেনারা প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ল। শত্রুপক্ষ বেশ শক্তিশালী। তাদের মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়ল। তারপরও আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে লড়ছে মুয়াজ (রা.) সেনারা। সবার মধ্যে ছিল অদম্য সাহস ও আল্লাহ তায়ালার ওপর অকৃত্রিম ভরসা।
সেনাপতি মুয়াজ (রা.) আল্লাহর ওপর দৃঢ় আস্থাশীল ছিলেন। ঈমানের দৃঢ়তা ও সত্যের পাহাড়সম শক্তি তাঁর বুকে অসীম সাহসের ফুলকি ছড়াচ্ছে। মুয়াজ (রা.)-এর স্বপ্ন আল্লাহর দীনের গোলাপের পাপড়িতে ভরা। আল্লাহর মদদ যে মুয়াজ (রা.)-এর সাথে আছে তা তিনি ভাল করেই জানেন। তাই শত্রুরা প্রবল গতিতে ছুটছে দেখেও সেনাপতি বিচলিত হলেন না।
মুয়াজ (রা.) এতক্ষণ তাঁর ঘোড়ার পিঠে সওয়ার অবস্থায় ছিলেন। তিনি সবকিছু গভীর মনোযোগ সহকারে দেখছিলেন। আর যুদ্ধের কৌশল নিয়ে ভাবছিলেন। এবার তিনি ঘোড়া থেকে নেমে মাটিতে পা রাখলেন। তাঁর সাথেই লড়তে এসেছে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র। মুয়াজ (রা.) তাঁর ঘোড়াটি পুত্রের জন্য ছেড়ে দিলেন। মুয়াজ (রা.) এবার নিজ পুত্রকে সাথে নিয়ে জ্বলে উঠলেন। প্রচণ্ড সাহস ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে মুয়াজ (রা.) শত্রুদের মোকাবিলা করলেন। তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল মুসলিম সেনারা। ফলে ক্ষণিকের মধ্যেই পাল্টে গেল ইয়ারমুক ময়দানের দৃশ্য। মুয়াজ (রা.) রোমান বাহিনীর ব্যূহ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
সেদিন প্রাণপণে লড়লেন মুয়াজ (রা.)। তাঁর সাহসের ফুলকিতে শত্রুরা পিছু হটতে শুরু করল। ফলে ইয়ারমুকে বিজিত হলো মুসলিম বাহিনী। শত্রুদের অনেকেই মারা পড়ল। কেউবা বন্দী হলো। যারা ময়দান ছেড়ে পালাতে পারল, তারা জানে বেঁচে গেল।
মুয়াজ (রা.)-এর সাহসের আগ্নেয়গিরি ক্ষণিকের মধ্যে রোমান বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত করল। তাঁর সাহস ও আল্লাহর মদদে শত্রুদের সব বাধা তছনছ হয়ে গেল। ফলে আল্লাহর সৈনিকদের মুখে হাসি ফুটল। স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো ছিল এ হাসি। মুয়াজ (রা.)-এর দৃপ্ত ঈমানের ফুলকির কাছে মিথ্যার পাহাড় ভেঙেচুরে মাটিতে মিশে গেল।
মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)। দুরন্ত সাহসী এক সাহাবী। অত্যন্ত মেধাবী ও অসাধারণ জ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। তবে স্বভাবে ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও দিনহীন। তিনি অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন করতেন। তাঁর জীবন চলায় বাহুল্য বলতে কিছু ছিল না। জাঁকজমক ও চাকচিক্য তিনি মোটেও পছন্দ করতেন না। কোনোরকমে চলতে পারলেই তিনি খুশি হতেন। এই মহান সাহাবী আমাদের সামনে এক উজ্জ্বল আদর্শের মহিমা স্থাপন করে গেছেন।