॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, আমলারা। কিছুদিন যাবত সামরিক বাহিনীর সাবেক প্রধান ও পুলিশ বিভাগের সাবেক প্রধানদের দুর্নীতি, সম্পদের পাহাড়, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। সাবেক পুলিশপ্রধানের সম্পদের হিসাব দেখে দেশের বিচার বিভাগ, প্রশাসনের লোক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়েছে। একজন সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব যোগ করলে প্রায় একটি উপজেলার সমান দাঁড়াবে। তিনি কীভাবে এত টাকা বা সম্পদের মালিক হলেন, তার সুষ্ঠু হিসাব জনসমক্ষে আসতে হবে এবং আইনের আওতায়ই বিচার-বিশ্লেষণ করে রায় দিতে হবে। তার ডক্টরেট ডিগ্রির ব্যাপারেও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যহার, তদন্ত করতে হবে এবং আইনের আওতায় আনতে হবে।
দেশের সেনাপ্রধান হঠাৎ করে এ দায়িত্ব পান না। সরকার, সরকারপ্রধানের অনুমোদনেই এ পদে পদোন্নতি হয়। দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের আলোকেই তিনি এ পদে আসেন দীর্ঘদিন তার কর্মতৎপরতার স্বীকৃতি হিসেবে। অথচ এমন একজনকে সেনাপ্রধান করা হয়েছিল যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি তার ভাইদের এনআইডি করা, পাসপোর্ট করা, প্রেসিডেন্টকে দিয়ে সাজা মওকুফ করানো সবই করেছেন ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে গণ্য হবে। দেশের সেনাপ্রধান যদি এ ধরনের চরিত্রের লোক হন, তবে তার অধীনের কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈনিকদের মান কত ভালো রাখা সম্ভব।
একজন তিনবারের এমপির চোরাচালান, স্বর্ণ পাচার, দুর্নীতির কারণে ভিন্ন দেশে অপঘাতে মৃত্যু এবং লাশ পর্যন্ত না পাওয়া দেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক। তিনবার এমপি হিসেবে দলের মনোনয়ন পাওয়া এমন চরিত্রের লোক বাছাইও দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। তার দ্বারা এলাকায় ভিন্নমতের অনেক তরুণের ক্ষতবিক্ষত লাশের খবর এখন বের হচ্ছে, যা মানুষের মানবিক মূল্যায়নের অনুকূল নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষের অনুপরিমাণ ভালো ও মন্দ কাজের হিসাব লিখে রাখছেন, ভিডিও করে রাখছেন। অন্যায়ের কিছু শাস্তি দুনিয়াতেই হবে বা হচ্ছে আবার আখিরাতের বিচারে তাদের সূক্ষ্ম বিচার হবেÑ কারো প্রতি জুলুম করা হবে না।
গত কয়েকদিন পূর্বে জানা গেল, মন্ত্রীসহ ৪ এমপির তত্ত্বাবধানে মালয়েশিয়ায় ৫০ হাজার শ্রমিক যোগ দিতে পারেননি। তাদের হাজার হাজার কোটি টাকা এ সিন্ডিকেট খেয়ে ফেলেছে। অর্থনীতিতে এর প্রভাব দেশ হজম করতে পারবে না। এর প্রভাবে ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া থেকে ৬১ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মধ্যে পড়েছে, যা দেশের জন্য খুবই ক্ষতিকারক ও অপমানজনক। যারা এর জন্য দায়ী, তাদের আইনের আওতায় আনতেই হবেÑ সে যত বড় মাপের লোক হোক না কেন। যারা দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করবে না, তাদের সম্মান পাওয়ার অধিকার নেই।
যেসব আমলা তাদের অবৈধ আয়ে সম্পদ গড়ে তুলেছে। দেশে এবং বিদেশে টাকা পাচার করে দেশে দেশে বেগমপাড়া বানিয়েছে, তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আমরা কাউকেই আইনের বাইরে শাস্তি দিতে চাই না বা তার সমর্থক নই। দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণে আমরা কাজ করতে চাই, সমাজবিপ্লব করতে চাই মহান আল্লাহর শেষ নবী মুহাম্মদ সা.-এর ‘মদিনা সনদের’ আলোকে। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার সমুন্নত রাখতে চাই। তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিতে চাই। দিনের ভোট রাতে চাই না, ভোট ছাড়া নির্বাচন চাই না। বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের জেলে আটকে রেখে একতরফা নির্বাচন চাই না। দেশের জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন চাই। অন্য দেশের প্রত্যক্ষ সমর্থন আমরা চাই না। সবার সাথে বন্ধুত্ব চাই, কিন্তু কারো প্রভুত্ব চাই না। মনে রাখতে হবে ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়।
প্রতিবেশী দেশের সাথে আমরা ন্যায্য পানিবণ্টন চাই। তিস্তা-পদ্মার পানির ন্যায্য হিস্যা চাই। আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে সব দেশের সাথে আমরা ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই। বন্ধুত্ব চাই, শত্রুতা নয়।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীনভাবে বিচারকদের বিচারের ক্ষমতা দিতে হবে। ন্যায়কে ন্যায় বলবে, অন্যায়কে শাস্তির আওতায় আনবে। বিচারকরা মহান আল্লাহর প্রতিনিধি। তাদেরও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তার বিচারের সময় বলেছিলেন, আপনারা অসত্য বিচারে আমার বিচার করছেন। কাল কিয়ামতে আল্লাহর কাছে আমি বিচার প্রার্থী হব, আর আপনারা জবাবদিহি করবেন। ঐ বিচারে কোনো অসত্যকে সত্য বানানো যাবে না। আবার সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা যাবে না। কারো প্রতি অবিচার করা হবে না। কারো প্রতি জুলুম করা হবে না। ন্যায্য বিচার সবাই পাবে। ভালোর জন্য অফুরন্ত শান্তি, সীমাহীন ফুলে-ফলে সুসজ্জিত জান্নাত। আর মন্দের জন্য যারা অভিযুক্ত হবে। তারা পাবে অফুরন্ত আগুনের শিখাসমৃদ্ধ জাহান্নাম। তাই আমাদের জান্নাতে যাওয়ার কাজেই সত্যের সাথে নির্ভীকভাবে কাজ করতে হবে। অন্যায়কে না বলতে হবে।
যারা ব্যবসার কাজে জড়িত, তারা বড় ভাগ্যবান। সৎ ব্যবসায়ীরা কাল কিয়ামতে শহীদ ও সিদ্দিকিনদের সাথে উঠবে। জান্নাত তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। অসৎ, দুর্নীতিপরায়ণ, টাকা পাচারকারী, চোরাকারবারি, ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীরা তাদের কাজের বিনিময়ে জাহান্নাম পাবে। কেউই তা ঠেকাতে পারবো না। কোনো ওপরওয়ালা কোনো সুপারিশ করতে পারবে না। প্রত্যেক কাজের জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবের আওতায় আসবে। অণুপরিমাণ ভালো ও মন্দের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে সবাইকে। তাই এখনই সাবধান হওয়া একান্ত জরুরি। কারণ আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য বা পরিধান পরতে পারবো না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু করলে সাথে নিয়েও যেতে পারব না। দুনিয়ায় ফেলে যাওয়া সম্পত্তির সব খারাপ ফল আমাদের ভোগ করতে হবে। কোনো সুপারিশ করতে পারব না। বুদ্ধিমানরা সময় থাকতেই সাবধান হয়। সম্পদের উদ্বৃত্ত অংশ মসজিদ-মাদরাসা, গাছ লাগানোসহ সব ভালো কাজে বিনিয়োগ করে যেতে পারলে এর ফল কবরেও সাদাকা হিসেবে যেতে থাকবে।
যারা প্রশাসনের বিভিন্ন কাজে দায়িত্ব পালন করছি- অফিসার হোক, আর কর্মচারী হোক, পিয়ন-দারোয়ান, ঝাড়ুদার, ড্রাইভার, ছোটবড় দায়িত্ব পালন করছি, তাদের দায়িত্বের আলোকেই বিচার-ফয়সালা হবে। কাজে ফাঁকি দিয়ে বা ঘুষ নিয়ে কাজ করলে তার ফল তাকে দুনিয়াতেই ভোগ করতে হবে। আখিরাতে তার ভালোর জন্য সুসজ্জিত জান্নাত আর মন্দের জন্য আগুনভরা জাহান্নাম অপেক্ষা করছে। আমরা সবার ভালো চাই, সবাইকে সততার সাথে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের আহ্বান জানাতে চাই। আপনি নিজে ভালো থাকুন, অন্যকেও ভালোর পথে ডাকুন। দেখবেন, মহান আল্লাহ আপনার দুনিয়ার কাজ সহজ করে দেবেন আর আখিরাতে দেবেন অভাববিহীন জান্নাত, যার শেষ নেই। আমরা সেই জান্নাতের অপেক্ষায়। স্কুল-কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, মসজিদ-মাদরাসা, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ সব প্রতিষ্ঠানে সুশাসনের জন্য নাগরিক তৈরি করার পরিকল্পনা চাই। কোনোমতেই যাতে শিক্ষার্থীরা অসৎ পথ অবলম্বন না করে তার প্রশিক্ষণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই দিতে হবে। ভালোকে সবসময় হ্যাঁ বলবে, মন্দকে না বলবে- এ হোক আমাদের প্রত্যাশা।
দেশে বিরোধীদলের লোকদের অবিচারে হত্যা, গুম, বিনাবিচারে আটক রাখা, মিথ্যা অভিযোগে চার্জশিট দেয়া বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে- আপনাকেও একদিন এমন অবস্থায় পড়তে হতে পারে। যেমন আজ পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজের পরিণতি আপনারা দেখছেন, আরো দেখবেন। আমরা এ অনিয়মের পরিসমাপ্তি চাই।
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এ ছোট দেশ বাংলাদেশ। দেশের মাটিতে ফলে সব ধরনের খাদ্যশস্য, ফলফলাদি। এখন কিছু বিদেশি ফলও দেশের মাটিতে হচ্ছে। মহান আল্লাহ তায়ালা এ ছোট দেশকে দিয়েছেন অনেক জনশক্তি। আর তাদের খাওয়া-পরার সব ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। আমরা যদি সদ্ভাবে দেশের জনশক্তি কাজে লাগিয়ে মাটি ও পানি ব্যবহার করে সঠিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করি। শিল্প কারখানায় উৎপাদন বাড়াতে পারি, তাহলে আমাদের পণ্য দেশ ব্যবহার করে বিদেশেও রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হব, ইনশাআল্লাহ।
সৎ চিন্তা ও মানসিকতা এবং দেশের জনগণের কাজে জবাবদিহি সর্বোপরি আল্লাহর কাছে জবাবদিহির মানসিকতা থাকলে মহান আল্লাহ অবশ্যই বরকত ও রহমত দেবেন। এটা তাঁর ওয়াদা। আমরা মহান আল্লাহর কৃপা চাই, আল্লাহর মদদ চাই, অফুরন্ত হালাল রিজিক চাই, নেক সন্তান চাই, চক্ষু শীতল করা পরিবার চাই, দেশে সৎ, যোগ্য নেতার শাসন চাই। বিভেদ নয়, সবাইকে নিয়েই আদর্শ দেশ বানাতে চাই।
সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ দেশের ও বিদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলো ভালো চোখে দেখছে না। বুদ্ধিজীবী সমাজ দেশের প্রধান ও দলের কাজগুলোকে একপেশে ও স্বার্থপরায়ণতায় ভরপুর দেখছে। ওপর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নেতাকর্মীরা তাদের নিজ স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি করে সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করছে। জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতা দখল করে মানুষের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে। বিদেশিরা অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের লোকদের স্যাংশন দিচ্ছে আরো স্যাংশন দেয়ার অপেক্ষা করছে। নেতা ও দলের লোকদের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, চোরাচালানি, ঋণখেলাপি করে দেশের অর্থনীতি সর্ব নিম্নপর্যায়ে নিয়ে গেছে। দুর্নীতির এ পর্যায়কে দুদকের চেয়ারম্যান আক্ষেপ করে বলেছেন, দুর্নীতির এত প্রসার ঘটেছে যে, দুদকের একার পক্ষে দেশের সব দুর্নীতির তদন্ত করা সম্ভব নয়। কোনো উদ্যোগ নেই এসব খারাপ নজির পরিষ্কার করার। এসব দুর্নীতির সাথে থেকে টাকা জমিয়ে শাসকদলের লোকেরাও যে সন্তোষ প্রকাশ করছে, তা কিন্তু নয়। দেশের বিচারক, আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, বড়-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার কারণে তাদের মনোভাবও আমার জানা। তাই দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করতে হবে, চোরাচালান বন্ধ করতে হবে। ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সব খারাপ কাজ থেকে জনগণকে রক্ষা করতে হবে, মন্দকে দূরীভূত করতে হবে। চাই সামাজিক প্রতিরোধ।
আমাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব- দেশের প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ, সামরিক বাহিনী, ব্যাংক লুটকারী, চোরাচালানি, বিদেশে টাকা পাচারকারীদের একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। দেশের বিচার বিভাগ, সরকারি দল, বিরোধীদল, সুধী সমাজের সৎলোকের সমন্বয়ে জাতীয় ‘দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি’ করে প্রত্যেক বিভাগের দুর্নীতিপরায়ণ লোকদের তালিকা প্রস্তুত করে এদের আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। আমাদের ৩০০ এমপির সম্পদের হিসাব নিতে হবে। দেশের আমলাদের সম্পদের হিসাব সরকার সহজেই পেতে পারে। বিভিন্ন বাহিনীর দায়িত্বশীলদের সম্পদের হিসাব নিতে হবে। ব্যবসায়ী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সব পেশার লোকদের আয় ও ব্যয়ের খতিয়ান নিলে বৈধ-অবৈধ সম্পদের সোর্স বের হয়ে আসবে। আমরা দেশের উন্নয়ন চাই, জনগণের জীবনমানের উন্নতি চাই, দেশের সৎলোকের ভালো চাই, মন্দ লোককে সংশোধিত করতে চাই। আসুন, এ কাজে সবাই একমত হয়ে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ভালো কাজে শরিক হই। মন্দ কাজকে ঘৃণা করি। দেশ ভালো হবে, সমাজ ভালো হবে। আমরা দুনিয়ার মধ্যে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় করে নিতে পারবো।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।