॥ মনসুর আহমদ ॥
পাক-ভারত উপমহাদেশে রাজনৈতিকভাবে ইংরেজ শাসনের সূচনা হয় পলাশী যুদ্ধে সিরাজ-উদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। যে গোষ্ঠী এসেছিল এ দেশে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে, তারা পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্দৌলাকে হত্যা করে প্রথমে বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তারপর একে একে বিভিন্ন রাজ্য দখলের ধারাবাহিকতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত বদলে ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ। তাই ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তের নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার পরাজয় এবং উপমহাদশে ইংরেজ শাসনের নামে ঔপনিবেশক শাসনের পত্তন ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা বিন্দু। কারণ বাংলায় মুসলিম শাসনের এ পতনই পরাধীনতার শিকল পরিয়েছিল পাক-ভারত উপমহাদেশকে। যে শিকলমুক্ত হতে প্রায় দুইশত বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। ইংরেজরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়ে স্বদেশে চলে গেলেও আজও মানসিক গোলামি থেকে মুক্তি পায়নি এ উপমহাদেশের মানুষ।
ঐতিহাসিকগণ পলাশীর নাটকীয় প্রহসনের এ যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার জন্য যেসব তত্ত্ব উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে প্রধান ছিল অভ্যন্তরীণ সংকট তত্ত্ব এবং সহযোগিতা তত্ত্ব। পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার অনেকগুলো কারণ ছিল। কিছু ছিল প্রত্যক্ষ কারণ আবার কিছু ছিল পরোক্ষ। অভ্যন্তরীণ সংকট তত্ত্ব-পরোক্ষ কারণের প্রধান ছিল অভ্যন্তরীণ সংকট তত্ত্ব। আলীবর্দী খানের প্রতি তাঁর নিকটাত্মীয়দের ঈর্ষাপরায়ণতা ছিল অতি তুঙ্গে। আলীবর্দীর প্রথম নাম ছিল মির্জা মুহম্মদ আলী। তদানীন্তন বাংলার সুবাদার সুজাউদ্দৌলার দরবারে তিনি সামান্য সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। এ রাজদরবারে তিনি তাঁর নিকটাত্মীয়দের চেয়ে অধিক প্রতিভা প্রদর্শন করায় কালক্রমে আত্মীয় ও অপরিচিত সকলেরই তিনি ঈর্ষার পাত্র হয়ে পড়েন। এ হিংসা আরও চরমে ওঠে, যখন তিনি কর্মদক্ষতার বলে সুজাউদ্দৌলার ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেন এবং মির্জা মুহম্মদ আলী রাজমহলের ফৌজদার নিযুক্ত হন এবং আলীবর্দী খান উপাধিকে ভূষিত হন। (১)। ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তিদের পক্ষে এ সকল সহ্য করা অসম্ভব ছিল। এ ঈর্ষাপরায়ণতা নবাব আলীবর্দীর জীবদ্দশায় কোনো প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। এ ঈর্ষাপরায়ণতার শিকারে পরিণত হন আলীবর্দীর উত্তরাধিকারী নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা।
অপুত্রক আলীবর্দী খানের দুই জামাতার মধ্যে একজন ছিলেন ঢাকার শাসনকর্তা, তারা আশা করেছিলেন আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর তারা মসনদের উত্তরাধিকারী হবেন। কিন্তু সিরাজকে উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নেয়ায় তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং তা অবশেষে শত্রুতায় পরিণত হয়।
নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার প্রধান শত্রু ছিল তাঁর খালাতো ভাই পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গ। সিরাজ-উদ্দৌলার অপর শত্রু ছিল তাঁর খালা ঢাকার ভূতপূর্ব শাসনকর্তার বিধবা পত্নী ঘষেটি বেগম। ঘষেটি বেগম ছিলেন অপুত্রক। তিনি সিরাজ-উদ্দৌলার ছোট ভাই ইকরামুদ্দৌলাকে লালন-পালন করেন। ঘষেটি বেগমের ইচ্ছা ছিল নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পরে ইকরামুদ্দৌলাকে মসনদে বসাবেন। কিন্তু ইকরামুদ্দৌলা অকালে মৃত্যুবরণ করেন। ঘষেটি বেগম শওকত জঙ্গের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। এক সময় ঘষেটি বেগম শওকত জঙ্গকে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। (২)
সিরাজ-উদ্দৌলার অপর প্রধান শত্রু ছিলেন মীর জাফর আলী খান। তিনি আলীবর্দী খানের বৈমাত্রেয় বোন শাহখানমকে বিয়ে করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পান। মীর জাফর আলী খান ছিলেন অত্যন্ত লোভী ও অকৃতজ্ঞ। তিনি আলীবর্দী খানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে দ্বিধাবোধ করেননি। তার অভিলাষ ছিল আলীবর্দী খানকে হত্যা করে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করা। কিন্তু তিনি সে সুযোগ পাননি। কিন্তু মীর জাফর নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি হয়ে নবাব সিরাজের প্রধান শত্রু হয়ে ওঠেন। ঘষেটি বেগম ও শওকত জঙ্গের সাথে যখন নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা ব্যতিব্যস্ত তখন মীর জাফর ইংরেজ কোম্পানির সাথে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা খালা ঘষেটি বেগমকে তার প্রাসাদ থেকে নিজ প্রাসাদ মনসুরগঞ্জে নিয়ে আসেন। এসময় সিরাজ মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতি থেকে সরিয়ে মীর মদনকে ঐ পদে নিয়োাগ প্রদান করেন। পরে তিনি অবশ্য মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব প্রদান করেন। কিন্তু মীর জাফর মনে মনে নবাবের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। এ সময় মুর্শিদাবাদে সিরাজ-উদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঘনিভূত হয়ে ওঠে। সিরাজের প্রতি নাখোশ জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, ঊমিচাঁদ প্রমুখ সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করে তদস্থলে মীর জাফরকে অধিষ্ঠিত করার চক্রান্ত করেন। মীর জাফর প্রথম দিকে এদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু চক্রান্তকারীরা ইয়ার লতিফকে সিংহাসনে বসানোর ষড়যন্ত্র করে। তখন মীর জাফর নবাব পদ লাভের জন্য উঠেপড়ে লেগে যান।
সহযোগিতা তত্ত্ব : আলীবর্দী খানের হিন্দুদের প্রতি উদার নীতি ও সহযোগিতা সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বীজ বপনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নবাব আলিবর্দীর আমলে হিন্দুদের প্রতিপত্তি আরও বৃদ্ধি পায়... হিন্দু জমিদাররা নবাবীর ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন না।(৩) তার সময় হিন্দু কর্মকর্তাদের নিয়োগ বৃদ্ধি পায়। এ সময় যারা প্রধান ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে জানকী, দুর্লভ রাম, রাম নারায়ণ, কিরাত চাঁদ, বিরু দত্ত, গোকুল চাঁদ, ঊমিচাঁদ রায় এবং রাম রাম সিংহের নাম উল্লেখ যোগ্য।(৪) সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রে হিন্দু কর্মকর্তা অধিক সংখ্যায় নিয়োগ পান। এভাবে আলীবর্দী খানের শাসনামলে হিন্দুরা সকল ক্ষেত্রে প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে। এর পরিণতি হয়েছিল অত্যন্ত অশুভ।
নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার শাসনামলে তারা ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে বাংলার মুসলিম রাজত্বের অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সিরাজ-উদ্দৌলাও তাঁর নানার মতোই হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ দেন। তিনি মোহনলাল নামক এক কাশ্মিরী হিন্দুকে উচ্চপদে নিয়োগ দেন। মোহন লাল সিরাজের ওপরে প্রভাব বিস্তার করে নবাবের প্রধান উজিরে পরিণত হন। আর এ সব হিন্দুরাই নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করে। নবাব সিরাজের হাতে কলকাতা পতনের পর যদি ঊমিচাঁদ নবকিষেণ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, মানিক চাঁদ প্রমুখ হিন্দুগণ গভর্ণর ড্রেক ও তার লোকজনকে সাহায্য না করতো, তাহলে ইংরেজদের জন্য আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না।(৫)
বাংলায় মুসলমানদর এ স্বাধীনতা বিপর্যয়ের কারণ শুরু হয়েছিল নবাব আলীবর্দী খান ও সিরাজ-উদ্দৌলার বহু আগ থেকে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র বাহাদুর শাহের পুত্র আজিম উদ্দীন বাংলায় ১৬৯৭ থেকে ১৭১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুবাদার পদে নিযুক্ত ছিলেন। প্রথমেই তিনি ষোলো হাজার টাকার বিনিময় ইংরেজ কোম্পানিকে এক খানা অনুমতি পত্র প্রদান করেন। ফলে ইংরেজ কোম্পানি মালিকদের কাছ থেকে সুতানাটি, গোবিন্দপুর এবং কলকাতা নামক গ্রাম খরিদ করার অনুমতি লাভ করে। সুবাদার আজিম উদ্দীন যেকোনো উপায়ে অর্থ সঞ্চয় করে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রদেশের ভালমন্দের প্রতি তিনি ছিলেন একদম উদাসীন। তিনি ব্যক্তিগত অর্থ উপার্জনের প্রয়োজনে বাংলার কৃষক বণিকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে ইংরেজদের এ দেশে শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দেন।
ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি তার শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা লাভ করেছিল মোগল শাসকদের দুর্বল উত্তরাধিকারীগণের পক্ষ থেকে। মুর্শিদকুলী খাঁর আগমনের পূর্ব থেকেই ইংরেজগণ মোগল সম্রাটের ফরমানের অনুসারে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার ভোগ করে আসছিল। মুর্শিদকুলী উপলব্ধি করেন যে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর বাংলার সমৃদ্ধি নির্ভরশীল, সুতরাং তিনি ইউরোপীয় ও স্থানীয় বণিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি ১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘দত্তক প্রথা’ বা ছাড়পত্র উঠিয়ে দিয়ে তাদের নিকট থেকে প্রচলিত হারে শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ইংরেজ কোম্পানি সম্রাট ফররুখ শিয়ারের শরণাপন্ন হলে কোম্পানি বাৎসরিক মাত্র তিরিশ হাজার টাকা বিনিময়ে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। বাণিজ্যের ব্যাপারে কোম্পানি তার ‘দত্তক’ ব্যবহার করার অধিকার লাভ করার ফলে কেম্পানি সুরাট, বোম্বাই, মাদ্রাজ, হুগলী, কাশিম বাজার, ঢাকা, মালদহ ও কলকাতা প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ লাভ করে।
‘ব্রিটিশদের বল্গাহীনভাবে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বাণিজ্য ও সেই সূত্রে সামরিক শক্তি বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়ার পেছনে যে এদেশের শাসকগণের মনে অনুসিদ্ধান্ত কাজ করেছিল সেটা হচ্ছে, এরা শুধু বাণিজ্য বিস্তারের জন্য এদেশে এসেছে। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে যে সন্দেহপ্রবণতা এদের নিয়তের ব্যাপারে থাকার কথা আমাদের বাস্তববাদী পূর্বানুমান (জবধষরংঃ ধংংঁসঢ়ঃরড়হ) অনুসারে, সেটা শাসকদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। উপরন্তু শত্রু-মিত্র ভেদজ্ঞান এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ার পরিণাম যে জাতিসত্তা বিলোপকে ত্বরান্বিত করা, এক্ষেত্রেও তাই-ই হয়েছে। আলীবর্দী খাঁ যে কারণেই হোক ইংরেজদের যে বাণিজ্য করার অনুমতি দিয়েছিলেন, সেটাই পরবর্তীতে এ অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।’(ড. নাজমুস সাকিব নির্ঝর)।
পরবর্তীতে ইউরোপে শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকগণ বাংলায় দুর্গ নির্মাণ শুরু করে। নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা তাদেরকে দুর্গ নির্মাণে নিরস্ত হতে আদেশ প্রদান করেন। ফরাসি বণিকগণ নবাবের আদেশ অনুযায়ী দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করে। কিন্তু উদ্ধত ইংরেজ বণিকগণ নবাবের আদেশ উপেক্ষা করে চলে। ইংরেজদের ঔদ্ধত্য আচরণে ক্রদ্ধ হয়ে নবাব ১৬ জুন কলকাতাস্থ ইংরেজ ঘাঁটি ফোর্ট উইলিয়ম দখল করেন। নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা কলকাতা জয় সমাপ্ত করে হিন্দু মানিক চাঁদের ওপর কলকাতার ভার অর্পণ করে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন। কলকাতা জয়ের পর তা রক্ষার অন্য কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হলো না। নবাব চেয়েছিলেন ইউরোপীয়রা নিজেদের সুসংহত করার জন্য দুর্গগুলোকে যেভাবে দুর্ভেদ্য করে তুলেছিল তার সম্পূর্ণ অবসান। এর জন্য তাঁর প্রয়োজন ছিল কলকাতা জয়ের পর যাতে ইংরেজরা পুনরায় বাংলাদেশে শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে না পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা করা। কিন্তু তিনি তা না করে কলকাতার দায়িত্বভার দিলেন মানিক চাঁদের ওপরে, যা ছিল সিরাজের এক চরম ভুল।
কলকাতা থেকে ইংরেজরা বিতাড়িত হয়ে ফলতায় আশ্রয় নেয়ার পর ‘কলকাতার শাসনভার মানিক চাঁদের ওপর অর্পিত হয়েছিল, সে বিশ^াসঘাতকতা করে ফলতায় অবস্থিত ইংরেজদের সর্ব প্রকারের সাহায্য করতে থাকে।’ (৬) নবাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে গোপনে এক বিরাট অংকের ঘুষের বিনিময়ে ইংরেজদের পক্ষে চলে যায়। ফলে প্রায় বিনা যুদ্ধে ক্লাইভ ও এডমিরাল ওয়াটসন ২ জানুয়ারি ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা অধিকার করে এবং ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ সুরক্ষিত করে। ইংরেজরা কলকাতা অধিকার করেই নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
নবাবের প্রতি হিন্দুদের বিশ্বাসঘাতকতা ও চক্রান্তই ছিল তাঁর পরাজয়ের মূল কারণ। এ চক্রান্তের বীজ বপিত হয়েছিল মুর্শিদকুলী ও আলীবর্দী খানের আমলে। মুর্শিদকুলী খানের অধীনে শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুগণ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাবার সুযোগ লাভ করে। হোসেন শাহী রাজ বংশের আমলে অভিজ্ঞ বাঙালি হিন্দুগণ ‘দিওয়ান’, ‘কানুনগো’ প্রভৃতি উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। মুর্শিদকুলী খানের আমলে এসব হিন্দু কর্মচারী অধিকতর উন্নতি ও পদমর্যাদা লাভ করে এবং এদের অনেকেই বৃহৎ জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। (৭)
মুর্শিকুলী খানের পরে তাঁর জামাতা সুজাউদ্দীন খান বাংলার নবাব হন। তার আমলে দেওয়ান আলম চাঁদ মুর্শিদাবাদের খানসার দেওয়ান নিযুক্ত হন। (৮) সুজাউদ্দীন হিন্দু জমিদার বর্গের সহানুভূতি লাভের জন্য মুর্শিদকুলী খান প্রবর্তিত আইন কানুনগুলোর কঠোরতা হ্রাস করেন, যা হিন্দু জমিদারদের বিদ্রোহী হতে সহায়তা দেয়।
১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে সুজাউদ্দীনের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র সরফরাজ খান মুর্শিদাবাদের মসনদে আরোহণ করেন। (৯)। কিন্তু রাজ্য শাসনের ব্যাপারে সরফরাজ খান ছিলেন অনভিজ্ঞ। সুতরাং আলীবর্দী খান সরফরাজ খানকে সরিয়ে নিজে মুর্শিদাবাদের মসনদ দখল করার পরিকল্পনা করেন। তাঁর এ পরিকল্পনার উপদেষ্টা পরিষদে সদস্য হিসেবে ছিলেন আলম চাঁদ ও জগৎশেঠ। এই জগৎশেঠই পরবর্তীতে নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়। আলম চাঁদ ও জগৎশেঠদের সহযোগিতা নিয়ে নবাব আলীবর্দী খান সরফরাজ খানকে পরাজিত করে বাংলার মসনদ দখল করেন। নবাব আলীবর্দীর শাসনকালে উচ্চপদে হিন্দু কর্মকর্তাগণের নিয়োগ বৃদ্ধি পায়। তাঁর শাসনামলে হিন্দুরা সর্ব ক্ষেত্রে প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে।
নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে সিরাজ-উদ্দৌলা মসনদে আরোহণ করেন। মসনদে আরোহণের সাথে সাথেই নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এ ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় তিনি প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনে অসমর্থ হন। নবাব আলীবর্দী খানের সময় মীর জাফর প্রধান সেনাপতির পদ লাভ করেন। প্রধান সেনাপতি হিসেবে তার হাতে প্রচুর ক্ষমতা থাকায় শাসনকার্যে তার প্রচুর প্রভাব ছিল। এ কারণেই মীরজাফর তরুণ নবাবের একজন প্রবল শত্রু হয়ে ওঠেন। এই সুযোগটি গ্রহণ করে ইংরেজরা। তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে যতদিন সিরাজ সিংহাসনে আসীন থাকবেন ততদিন তাদের স্বার্থ নিরাপদ থাকবে না। তারা নিজেদের মনোনীত কোনো লোককে মুর্শিদাবাদের মসনদে অধিষ্ঠিত করতে পারলেই তাদের স্বার্থ নিরাপদ হবে এ ধারণা ইংরেজদের মনে বদ্ধমূল হল। এ কারণে তারা উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে বেছে নিল মীর জাফরকে। সিরাজের প্রতি অসন্তুষ্ট ও উচ্চাভিলষিত বাংলার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি -জগৎশেঠ, রাজ বল্লভ ও ঊমিচাঁদ প্রভৃতি সিংহাসন থেকে সিরাজকে সরিয়ে মীর জাফরকে অধিষ্ঠিত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। হিন্দুদের এ ঘড়যন্ত্র ছিল তাদের শেষ চাল। নবাব সিরাজের হাতে ইতোপূর্বে কলকাতা পতনের পর যদি ঊমিচাঁদ, নবকিষেণ , জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, মানিক চাঁদ প্রভৃতি হিন্দু প্রধানরা ড্রেক ও তার লোকদেরকে সাহায্য না করতো তা হলে ইংরেজদের আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এভাবেই মুর্শিদকুলী খানের সময় সুযোগ প্রাপ্ত হিন্দুরা নবাব সিরাজের পতনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চক্রান্ত চালিয়ে এসেছিল।
পলাশী যুদ্ধের প্রক্কালে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বাঙালি হিন্দুরা যুক্ত বাংলার প্রশাসনিক পদগুলো প্রায় অধিকার করে বসে এবং বৃহৎ জমিদার গোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে রাজস্ব বিষয়ক সর্ব কর্মই কুক্ষিগত করে ফেলেছিল। ভূম্যাধিকারেও তারা মুসলমানদের পেছনে ছিল না। এ ভাবে বাংলা দেশে হিন্দুর এমন প্রভাব প্রতিপত্তি ও অর্থবলের অধিকারী হয়েছিল যে, শ্রী মজুমদারের ভাষায়- ‘হিন্দু জমিদাররা নবাবীর ওপর সন্তুষ্ট ছিল না।’ অতএব তারা বাংলার মসনদ থেকে মুসলমান নবাবকে সরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠবে এবং মুসলমান শাহী লুপ্ত করতে ব্যাগ্র হয়ে উঠবে মোটেই বিচিত্র নয়। (১০)
ইংরেজরা কলকাতা অধিকার করে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু এ কলকাতা অধিকারে সাহায্য করেছিল নবাবের নিয়োগকৃত বিশ্বাসঘাতক মানিক চাঁদের চক্রান্ত। ইংরেজরা ঘুষ দিয়ে মানিক চাঁদকে হাত করেছিল। যে কারণে ইংরেজরা কলকাতা থেকে বিতাড়িত হয়ে ফলতায় আশ্রয় নেবার পরই মানিক চাঁদ নবাবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে গোপনে ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করে।
বিশ্বাসঘাতকতার দ্বিতীয় নমুনা হলো নন্দকুমার। নবাব নন্দকুমারকে দায়িত্ব দেন যদি ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করে, তবে তিনি যেন তা প্রতিহত করে ফরাসিদের সাহায্য করেন। কিন্তু ইংরেজরা নন্দকুমারকে ১০-১২ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে নিরস্ত রাখে। এমনকি নবাবের গোয়েন্দাপ্রধানকে ঘুষ দিয়ে ইংরেজরা গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। (মৈত্রেয়, ১৭৪) এভাবে ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে নবাবের সমগ্র সামরিক গোয়েন্দাব্যবস্থাকে বিকল করে ফেলে।
এভাবেই নিকটাত্মীয়দের অসহযোগিতা, মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা, হিন্দুদের জালিয়াতি, স্বার্থপরতা ও দেশদ্রোহিতার এক অতি নীচ ও জঘন্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার চেষ্টা করা হয়। যার পরিণতিতে নামমাত্র যুদ্ধে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন প্রাতঃকালে ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশী প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়।
পলাশী যুদ্ধের অবস্থা : যেকোনো যুদ্ধে বিজয়ের ক্ষেত্রে কৌশলী অবস্থান এবং প্রযুক্তির প্রয়োগকে অন্যতম অনুঘটক হসেবে বিবেচনা করা হয়। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ বাহিনীর কেন পরাজয় ঘটেছিল তা অনুধাবনের জন্য এ দুটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া উচিত। প্রথমত নবাব ও ইংরেজবাহিনীর সামরিক সক্ষমতা ও পরিকাঠামো বিশ্লেষণ। দ্বিতীয়ত, পলাশীর বৃষ্টিপাত দিনের কর্দমাক্ত মাঠ।
‘প্রথাগত হিসাবমতে, নবাব বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল ৫০,০০০ (১৫,০০০ অশ্বারোহী এবং ৩৫, ০০০ পদতিক); অপর দিকে ব্রিটিশ বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩২০০জন। প্রকৃতপক্ষে নবাবের অধীনে ছিল ১২,০০০ সৈন্য; ৫০০০ অশ্বারোহী এবং ৭০০০ পদাতিক। এই ইউনিটের নেতৃত্বে ছিল মীর মদন ও মোহনলাল। নবাববাহিনীর বাকি তিনটি ইউনিটের নেতৃত্বে ছিল মীর জাফর, ইয়ার লতিফ ও রায় দুর্লভ। বলাবাহুল্য এ তিনটি ইউনিট যুদ্ধের ময়দানে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেছে। (চৌধুরী ১৫৪-৫)...সকাল ৮টা থেকে নবাবের গোলান্দাজ বাহিনী প্রথমে আক্রমণ শুরু করে। প্রথম আধ ঘণ্টায় ইংরেজ বাহিনীর যে পরিমাণ ক্ষতি করেছে, তা দুপুরের পর অব্যাহত থাকলে ব্রিটিশদের জয়ী হবার কথা নয়। কিন্তু মধ্য দুপুরে বৃষ্টি হলে নবাব বাহিনীর গোলাবারুদ প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে ইংরেজ বাহিনী আমবাগানে অবস্থান করায় তারা বারুদ সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়। ফলে বৃষ্টি থেমে গেলে তারা পুনরায় গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। পক্ষান্তরে নবাব বাহিনীর গেলান্দাজ বিভাগ অকেজো হয়ে যাওয়ায় তারা পদাতিক বাহিনীর আক্রমণকে সাহায্য করতে অপরাগ ছিল। এতে নবাবী ফৌজের হতাহতের সংখ্যা বাড়ছিল এবং অগ্রগমনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। অধিকন্তু বৃষ্টিতে মাঠ কর্দমাক্ত হয়ে যাওয়ায় অশ্বারোহী বাহিনীও অগ্রগামী হতে পারেনি। ৫০০০ সৈন্যের এ বিভাগও সেদিন নবাবী ফৌজের বিশেষ কোনো কাজে আসেনি। সেদিন নবাবের গোলানন্দাজ ও অশ্বারোহী বিভাগ পূর্ণ শক্তি নিয়ে যুদ্ধ করতে সক্ষম হলে ইংরেজ বাহিনীর জয়ের সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ।’ (আবদুল্লাহ আল মামুন-সিরাজ নির্মিতির ধারা-উপধারা) এভাবেই দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকদের কারণে বাংলার স্বাধীনতা হারাতে হয়েছিল।
পলাশীর যুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার শাসন ব্যবস্থায় ইংরেজগণ অতি শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। আর তার সাথে সাথে এ দেশের হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে এবং তারা একটি নতুন সংস্কৃতির পত্তন করতে থাকে।
পলাশীর বিজয়ের পরপরই এ দেশে ইংরেজদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিজয় অভিযান শুরু হয়ে যায়। হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজের উত্থান ও ইংরেজদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিজয় অভিযান বাঙলার মুসলমানদের যে ক্ষতি সাধন করেছে তা শোধরিয়ে নেয়া আজও সম্ভব হয়নি। আর আদৌ শোধরিয়ে নেয়া কবে যে সম্ভব হবে তা ভবিষ্যৎই জানে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, আলীবর্দী খানের সীমাহীন উদারতা, জনসংখ্যার অনুপাত বিবেচনায় না নিয়ে হিন্দু কর্মচারী নিয়োগে অদূরদর্শিতার ফলে প্রশাসনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যা ষড়যন্ত্রকারীদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
ভারতে কয়েক শতাব্দীর মুসলিম শাসন যে জীবনবোধ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গড়ে তুলেছিল, তা পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধের পরাজয়ের মধ্যদিয়ে বিনষ্ট হয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতির অংক এত বিরাট যে, তা পুষিয়ে নিতে হলে যোগ্য মুসলিম নেতৃত্বের অধীনে আরও কয়েক শত বছর অবিরাম প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
তথ্যসূত্র: ১) সিরাজ-উদ্দৌলা থেকে শেখ মুজিব- কে এম ফিরোজ খান; পৃঃ ২০। ২) সিরাজ-উদ্দৌলা থেকে শেখ মুজিব- কে এম ফিরোজ খান; পৃঃ ৩২। ৩) বাংলাদেশেরর ইতিহাস, মধ্য যুগ- ২২২-২৩ পৃঃ। ৪) সিরাজ-উদ্দৌলা থেকে শেখ মুজিব- কে এম ফিরোজ খান; পৃঃ ২৯)। ৫) সিরাজ-উদ্দৌলা থেকে শেখ মুজিব- কে এম ফিরোজ খান; পৃঃ ৩৮)। ৬)বাংলার মুসলমানরে ইতিহাস- আব্বাস আলী খান- পৃঃ ৮৪)। ৭) সিরাজ-উদ্দৌলা থেকে বাংলাদেশ - কে এম ফিরোজ খান- পৃঃ ১৪) ৮) বাংলার ইতিহাস-পৃঃ ৩৫৬। ৯)সিরাজ-উদ্দৌলা থেকে শেখ মুজিব- কে এম ফিরোজ খান, পৃঃ ১৯) ১০) মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতিক রূপান্তর - আবদুল মওদূদ: পৃঃ ৫২।