অ ব লো ক ন
সুদানে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে ইসরাইল
॥ মা সু ম খ লি লী ॥
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সুদানের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে অনেকখানি ফোকাসের বাইরে চলে গেছে। তবে ইসরাইলের বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনার সাথে নানা কারণে তেলআবিবের স্বার্থের যোগসূত্র রয়েছে। জেনারেল বশিরের একটি স্থিতিশীল সরকারকে সরিয়ে গণঅভ্যুত্থানের অস্থিরতা তৈরি এবং সেনাবাহিনীর কিছু জেনারেল ও একটি যুদ্ধবাজ মিলিশিয়া বাহিনীর প্রধানকে মিলিয়ে দিয়ে বশিরের রূপান্তরিত গণতান্ত্রিক সরকারকে চূড়ান্তভাবে উৎখাত করা হয়। আর এরপর সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটি সরকার নেয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মতের বাইরে গিয়ে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের। এতে স্পষ্ট হয় যে, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক তৈরি করার জন্য ব্রাদারহুড-ঘনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট বশিরের সরকারকে উৎখাত করা হয়। এর পেছনে সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায় ইসরাইল ও তার মিত্র শক্তির।
বশিরের উৎখাতের পরও এ শক্তি থেমে থাকেনি। আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গণতন্ত্র¿ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আরেক দফা অভ্যুত্থান করে তাদের বান্ধব জেনারেল ও মিলিশিয়া প্রধানকে ক্ষমতার শীর্ষে আনা হয়। আর সব শেষে সেনাপ্রধান ও শক্তিশালী মিলিশিয়া প্রধানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে মধ্যপ্রাচ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রকে ব্যর্থ দেশের পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
সুদানকে অকার্যকর করার ফর্মুলা অনেকটাই ইরাক ও লিবিয়াকে অকার্যকর করার প্রচেষ্টার সাথে মিলে যায়। ইসরাইলের চারপাশে স্থিতিশীল কোনো রাষ্ট্র না রাখার একটি গোপন কৌশল এক্ষেত্রে কাজ করেছে বলে মনে হচ্ছে। সুদানের এ গৃহযুদ্ধ আরব ও মুসলিম স্বার্থের জন্য কতটা ভয়ানক, সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। ফিলিস্তিনিরা একসময় এ আরব দেশ থেকে ভালো সহযোগিতা পেলেও এখন সুদানিরা নিজেরাই অস্তিত্বের সংকট মোকাবিলা করছে।
পেছন থেকে ইসরাইল সুদানে গুটি চাললেও গৃহযুদ্ধরত পক্ষগুলোর পেছনে কোনো না কোনো আরব রাষ্ট্রের ইন্ধন দেখা যায়। সুদানের এ গৃহসংঘাত অবসানে কার্যকর কিছু করা না গেলে এ সংঘাতের আঁচ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সুদানের গৃহযুদ্ধের অবসানে একটি আরব ওআইসি উদ্যোগ সক্রিয় বলে মনে হচ্ছে। তবে এটি সফল করতে হলে এর সমাধান প্রচেষ্টাকে বৃহত্তর ওআইসি উদ্যোগে নিয়ে যেতে হবে। আরব দেশগুলোর সাথে তুরস্ক ও ইরানকেও এর সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে, ইসরাইল কোনোভাবে এটি চাইছে না। আর দ্রুত এর অবসান ঘটানো না গেলে সুদানের জন্য গৃহসংঘাত বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
আব্রাহাম চুক্তি ও ইসরাইল
প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর ‘আল আকসা প্রলয়’ অভিযানের আগে ইসরাইলের মধ্যপ্রাচ্যে বড় অর্জনের মধ্যে একটি ছিল আব্রাহাম চুক্তিতে খার্তুমকে নিয়ে আসা। অধিকাংশ সুদানি ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক চায় না বলে দেশটির সাথে তার সম্পর্ককে সুসংহত করার জন্য সুদানে বেসামরিক নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক উত্তরণের পরিবর্তে সামরিক কর্তৃত্ববাদকে উৎসাহিত করেছে ইসরাইল ও তার মিত্ররা।
দুর্ভাগ্যবশত সুদানের জাতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর মোহাম্মদ হামদান দাগালো (ওরফে হেমেদতি) এ সংঘাতকে নিজেদের অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে দেখছেন। ফলে দ্রুততম সময়ে একটি ডি-এস্কেলেশন কল্পনা করা সহজ নয়। সুদানের সঙ্কটকে প্রভাবিত করতে চাওয়া বাইরের অভিনেতাদের ভূমিকা এবং এই সহিংসতা দ্রুত আঞ্চলিক হওয়ার আশঙ্কা সম্পর্কেও অনেক কিছু আছে।
বাহ্যিকভাবে ইসরাইলকে খার্তুমের সংঘাতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে বলে মনে হবে না, তবে সুদানে তেলআবিবের নিজস্ব স্বার্থ ও এজেন্ডা সবচেয়ে মুখ্য। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সুদান ২০২০ সালের অক্টোবরে আব্রাহাম চুক্তিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। আব্রাহাম চুক্তিতে সুদানের প্রবেশের অনেক আগে থেকে ইসরাইল ও তার মিত্ররা পরিকল্পনা সাজিয়ে আসছিল সুদানের শাসন পরিবর্তনের ব্যাপারে। ইসরাইল নিশ্চিত করতে গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে সামরিক বাহিনীর জেনারেল বুরহান আর মিলিশিয়া প্রধান হেমেদতি যেই সুদানের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে, সেই পক্ষ যেন সুদানে ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করে ফিলিস্তিনের পরিবর্তে ইসরাইলকে সহযোগী হিসেবে দেখে।
এখন তেলআবিব ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ শিবিরে খার্তুমের প্রবেশকে শক্ত দেখতে চায়। শেষ পর্যন্ত সুদানের চলমান ক্ষমতার লড়াইয়ে যেই শীর্ষে উঠে আসবে, সেই তেলআবিব ও ইসরাইলি সরকারের আরব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, সেটি নিশ্চিত করতে চায় ইসরাইল। এক্ষেত্রে সুদানের অধিকাংশ নাগরিক ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিপক্ষে বলে জনগণ যাতে শাসক নির্ধারণে মুখ্য না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে চেয়েছে। এজন্য ইসরাইল তার স্বার্থ গণতন্ত্রের পরিবর্তে এমন একটি সামরিক শাসনে নিহিত দেখে যার ক্ষমতায় থাকাটা ইসরাইলের নিকট প্রতিবেশী অন্য কয়েকটি দেশের মতো তেলআবিবের ওপর নির্ভর করবে।
ডেনভার ইউনিভার্সিটি অব মিডল ইস্ট স্টাডিজের স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ডিরেক্টর জোসেফ কোরবেল ড. নাদের হাশেমি এর মতে, ‘ইসরাইল কেন সুদান ও অন্যান্য আরব দেশে গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ঠেকাতে চায়, তা বোঝা কঠিন নয়। ইসরাইল যতটা সম্ভব আরব রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখতে চায়। দেশটি আরব বিশ্বের গণতন্ত্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখতে পারে না, কারণ আরব বিশ্বের গণতন্ত্রগুলো কূটনৈতিক সম্পর্কের শর্ত হিসেবে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ছাড় দেওয়ার দাবি করবে। এটি এমন কিছু যা ইসরাইল করতে অস্বীকার করে আসছে। এভাবে ইসরাইল আরব বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এটি সুদানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।’
কয়েক জন বিশেষজ্ঞ যুক্তি দেখান যে, সুদানের সামরিক নেতৃত্ব আব্রাহাম চুক্তি শিবিরে খার্তুমকে শক্ত করতে একটি চ্যালেঞ্জিং অবস্থায় পড়বে। ডেমোক্রেসি ফর দ্য আরব ওয়ার্ল্ড নাও-এর নির্বাহী পরিচালক সারাহ লিয়া হুইটসন একটি সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এমনকি জেনারেলরাও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করার ক্ষমতার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী নন, কারণ তাদের নিজস্ব সমর্থকদের একটি বড় দল ইসরাইলের সাথে শান্তি স্থাপনের কঠোর বিরোধিতা করে।’ অন্যদিকে ওয়াশিংটনের আরব গলফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের ফেলো ড. আজিজ আল গাশিয়ান বলেন, ‘বুরহান এবং হেমেদতির অভ্যন্তরীণ বৈধতার অভাব থাকায়, ইসরাইলের সাথে তাদের সম্পর্ক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে। ইসরাইলের সাথে সুদানের সদ্য আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক এবং এ সম্পর্ক স্থাপনকারী সামরিক জেনারেল উভয়ই সুদানের জনসাধারণের কাছে খুব বেশি জনপ্রিয় নয়। অতএব ইসরাইল বুঝতে পারে যে সুদানের সাথে তার বর্তমান সম্পর্ক খুবই অনিশ্চিত।’
ইসরাইল হয়তো এ কারণে সুদান আরো দুর্বল হোক, সেটিই চেয়েছে। গৃহসংঘাতে যদি সুদান দুর্বল হয় আর সেক্ষেত্রে তাকে দায়ও না নিতে হয়, তাহলে সেটি ইসরাইলের বৃহত্তর স্বার্থের অনুকূলেই যাবে। এখন বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে জেনারেল বুরহানের পক্ষে রয়েছে ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তিকারী মিশর ও সৌদি আরব। আর অন্যদিকে ফাইভ পাস মিলিশিয়া প্রধান হেমেতদির পক্ষে রয়েছে ইসরাইলের আরেক আরব মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত। দুই পক্ষের কেউই সুদানের কার্যকর গণতান্ত্রিক শাসন চায় না। এমনকি সামরিক অভ্যুত্থান করে ক্ষমতায় এসে যে গণতন্ত্র জেনারেল বশির চালু করে কয়েক দশক ধরে স্থিতিশীল শাসন নিয়ে এসেছিলেন, সেটির অবসানে উভয় পক্ষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। এতে শেষ পর্যন্ত দেশটি এখন এমন এক কর্তৃত্ববাদের মধ্যে আটকে গেছে, যেখানে প্রতিদিন মানুষের রক্ত ঝরছে। আর লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে।
এর মধ্যেই বিবদমান দু’পক্ষের মধ্যে আবার মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবও দিয়েছে ইসরাইল। সুদানের সংঘাত শুরু হওয়ার পর গত মাসে ইসরাইল বুরহান ও হেমেদতির মধ্যে মধ্যস্থতায় এ প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও সন্দেহ রয়েছে যে, ইসরাইল সুদানের সংঘাতে একটি বিশ্বাসযোগ্য এবং বৈধ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে, নাকি উভয় সুদানি যুদ্ধবাজের সাথে তার ইতিবাচক সম্পর্র্কের ইঙ্গিতই এটি দিচ্ছে। এটি স্পষ্ট যে, বুরহান বা হেমেদতির সাথে কাজ করার মতো সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত ইসরাইল বজায় রেখে আসছে। ফলে সংঘাতে যে পক্ষই বিজয়ী হোক না কেন, তার সমস্যা নেই।
ড. হাশেমি মনে করেন, ‘সুদানের উভয় সামরিক গ্যাংস্টারের মধ্যে ইসরাইলের বিনিয়োগ রয়েছে এবং দেশটি নিশ্চিত করতে চায় যে, সুদানি সেনাবাহিনীর জেনারেল বুরহান বা হেমেদতি যেই বিজয়ী হবে, ইসরাইলের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকবে।’
তেলআবিব সুদানের সংঘাতে এক ধরনের কৌশলী নীতি গ্রহণ করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সুদানের বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে মিশর ও জেনারেল বুরহানের সাথে অন্যদিকে গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও হেমেদতির সাথে যোগসূত্র রক্ষা করে চলেছে। ইসরাইলের এ কূটনৈতিক ভূমিকার ধারণাটিকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া না গেলেও সুদানের সংঘাতে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেওয়ার পেছনে ইসরাইলিরা সুদানের কাছাকাছি আফ্রিকার অন্যান্য অংশে তেলআবিবের বৃহত্তর স্বার্থের যুক্তি তুলে ধরে।
তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, পূর্ব আফ্রিকায় ইসরাইলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক উপস্থিতি প্রসারিত করার লক্ষ্য রয়েছে। এ কারণেই তেলআবিব ইথিওপিয়া, সুদান ও মিশরের মধ্যে গ্রেট রেনেসাঁ ড্যাম এবং নীল নদের পানি নিয়ে বিরোধ নিয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে, যদিও কেউ এটিকে সেভাবে গুরুত্বের সাথে নেয় না।
মার্কিন নীতি কীভাবে কাজ করছে
ইসরাইল-সুদানিজ সম্পর্ক এবং আব্রাহাম চুক্তিতে খার্তুমের অবস্থান গ্রহণে নেপথ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প এবং বাইডেন প্রেসিডেন্সি নির্বিশেষে সুদানের সাথে মার্কিন নীতিগুলো কোনো সফল গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য নিবেদিত ছিল না। এর পরিবর্তে তারা নিশ্চিত করেছে যে সামরিক বাহিনী দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রেখে খার্তুমকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার স্বাভাবিকীকরণ শিবিরে যেন নিতে পারে।
সুদানে সামরিক জান্তার মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিশেষ করে ক্ষমতায় থাকার জন্য তাদের মধ্যকার হতাশা সুদানকে আব্রাহাম চুক্তিতে যোগদানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চাপ সৃষ্টির সুবিধা তৈরি করেছে। ট্রাম্প ও বাইডেন প্রেসিডেন্সিজুড়ে সুদানের প্রতি মার্কিন নীতিগুলো সফল গণতান্ত্রিক উত্তরণভিত্তিক ছিল না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. হাশেমি উল্লেখ করেন, ‘আমরা দেখেছি কীভাবে সুদানে সাড়ে ৪ কোটি সুদানীর দুঃখকষ্ট এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্বেগ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল না। এটি আরব বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী শৃঙ্খলাকেই রক্ষা করেছিল। সুদানের জান্তা সরকারের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুদানকে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রচুর চাপ এসেছে।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘আরও বিরক্তিকর বিষয় হলো যে মার্কিন সরকার সুদানে সামরিক নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করেছিল এবং ২০২০ সালে আব্রাহাম চুক্তিতে প্রাথমিক সাইন-অব সুরক্ষিত করার একমাত্র উদ্দেশ্যে সুদানকে মার্কিন সন্ত্রাসবাদের তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আক্ষরিক অর্থে ঘুষ দিয়েছে সুদানের জান্তা সরকারকে। যাতে তারা ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করে, আমেরিকা বা সুদানের নয়।’
সুদানকে ইসরাইলের সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের দিকে ঠেলে দেওয়ার লক্ষ্য অর্জনে ওয়াশিংটনের জন্য বশির-পরবর্তী যুগে দেশটির পরিবর্তনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনকারী সুদানের সামরিক বাহিনীর জন্য আমেরিকান সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। বর্তমান সময়ে সুদানে মার্কিন স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে এ উদ্দেশ্যটি ছিল অনেক বেশি আঞ্চলিক এবং ইসরাইল ও আরব কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যে সম্পর্ককে সমর্থন করা। এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং জাতীয় নীতির ব্যর্থতা, যা সাম্প্রতিক সুদানের বিতর্কে হারিয়ে গেছে। আর উদ্ভূত বর্তমান সংকটে ভূমিকা রেখেছে।
পশ্চিমা মূলধারার মিডিয়া সুদানি অভিনেতাদের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কের ওপর এখন খুব বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। কিন্তু আব্রাহাম চুক্তিতে খার্তুমের অবস্থানকে সুসংহত করার জন্য ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা কীভাবে দেশটিতে সামরিক কর্তৃত্ববাদকে উৎসাহিত করেছে সে সম্পর্কে খুব কমই গুরুতর আলোচনা হয়েছে। সুদানের চলমান সংকটের কারণ এবং ঘটনাগুলো মূল্যায়ন করার সময় এ বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত।
আরব উদ্যোগ ও রক্তক্ষয়
গত এপ্রিলের শেষের দিকে জাতিসংঘে মার্কিন দূত সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এবং অন্যদের সুদানের যুদ্ধে হস্তক্ষেপ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন যে, সেখানে ‘মহাকাব্যিক অনুপাতের সংকট তৈরি হচ্ছে।’
এটি আসে যখন একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটার কারণে ওয়াশিংটন সুদানের সঙ্কট মোকাবিলায় সিনেটর, মানবাধিকার গোষ্ঠী ও জাতিসংঘের ক্রমবর্ধমান চাপের সম্মুখীন হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে আফ্রিকার দিকে চোখ বন্ধ করে রাখে এবং এ শূন্যতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেকে রাশিয়ান ও চীনা স্বার্থের মূল প্রক্সি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী র্যাপিড স্পেশাল ফোর্সেস (আরএসএফ) ও সুদানিজ সশস্ত্র বাহিনীর (এসএএফ) মধ্যে দেশের কর্তৃত্ব বিভক্ত হওয়ার পর থেকে এক বছরেরও বেশি সময়ের সহিংসতায় ১৫ হাজার জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। এক কোটিরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ১৮ লাখ সুদানি প্রতিবেশী দেশগুলোয় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে যে, সুদান আসন্ন দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে, প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ চরম ক্ষুধায় ভুগছে, যার মধ্যে ৩৬ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।
এখন খার্তুম, এল ফাশার এবং হোয়াইট নীল রাজ্যে সুদানের সেনাবাহিনী ও র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। সুদানের সেনাবাহিনীর বিমান উত্তর দারফুর রাজ্যের রাজধানী এল ফাশার শহরের উত্তরে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের অবস্থানে বোমাবর্ষণ করেছে।
এ মাসের প্রথমার্ধে সুদানের সার্বভৌমত্ব কাউন্সিল এক বিবৃতিতে আরএসএফকে ওয়াদ আল-নৌরাতে গণহত্যা চালানোর জন্য অভিযুক্ত করেছে, যাতে ১০০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়। কিন্তু র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস এর জবাবে বলেছে যে, সেনাবাহিনী রাজধানী খার্তুমের দক্ষিণে জাবাল আল-আউলিয়া শহরে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে ওয়াদ আল-নৌরার ৩টি ক্যাম্পে বাহিনীকে একত্রিত করেছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স দারফুর রাজ্যের রাজধানী ওয়াদ মাদানি শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং বর্তমানে এ রাজ্যের প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকা তারা নিয়ন্ত্রণ করে, যখন সেনাবাহিনী এখনো বৃহত্তম শহর, আল-মানাকিল রাজ্যের পশ্চিমের অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
যুদ্ধের ১৫তম মাসের কাছাকাছি আসার পর সুদানিদের রক্তপাত বন্ধ করতে গত সপ্তাহে আরব লীগ এক বৈঠকে মিলিত হয়। এই বৈঠকে আরব রাষ্ট্রসমূহের লীগ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার উপায় এবং সুদানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে একটি ব্যাপক যুদ্ধবিরতি অর্জন, ব্যাপক সুদানি রাজনৈতিক সংলাপের কথা বলা হয়। আরব রাষ্ট্রের সেক্রেটারি জেনারেল আহমেদ আবুল গীত সুদানে শান্তি উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার সমন্বয়ের বিষয়ে একটি পরামর্শমূলক সভা করে শান্তি উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার সমন্বয় বাড়ানোর জন্য আহ্বান করেন।
সভায় বলা হয়, জেদ্দা মানবিক ঘোষণা, সৌদি আরব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ প্রচেষ্টা সুদানের জন্য আশার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছিল। কিন্তু এর বিধানগুলো মেনে চলার ব্যর্থতার কারণে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ চলতে থাকে।
সুদানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু আরব উদ্যোগ কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। এজন্য ওআইসির বৃহত্তর পরিসর এবং চীনের সম্পৃক্ততা তৈরি করতে হবে। গাজা যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের অনেক সমীকরণ পাল্টে গেছে। এখন মুসলিম বিশ্বের সংকট দূর করা এবং যেকোনো উন্নয়নের জন্য মুসলিম বলয়কে মূল উদ্যোগ নিতে হবে। আমেরিকার ওপর নির্ভরতা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেটি ফিলিস্তিন ইস্যুতে একবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে।