আমাদের সন্তানরা হোক প্রকৃত মানুষ


২২ মে ২০২৫ ১৭:১৫

॥ শারমিন আকতার ॥
মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব তথা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। মানুষ মূলত স্বাধীন এবং যাচাইক্ষমতাসম্পন্ন জীব তথা প্রাণী। বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ বা ঘটনাকে মানুষ বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে। কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়, তা অনুধাবন করার মাধ্যমে গ্রহণ ও বর্জননীতিও মানুষ অবলম্বন করতে পারে নির্দ্বিধায়। ধীশক্তির অধিকারী হওয়ায় মানুষ ভালোকে মন্দ থেকে পৃথকও করার ক্ষমতা রাখে। সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত এ অভাবনীয় যাচাইক্ষমতা থাকার পরও কেন আজ আমাদের সমাজে মানবিকতাহীন ও মূল্যবোধহীন মানুষের আনাগোনা? কেন আমরা আস্তে আস্তে ভ্রষ্ট জাতিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছি? কেন আমরা আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে ন্যায় ও অন্যায়ের পথ সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিতে পারছি না। কেন পরিবারে পরিবারে বখে যাচ্ছে আমাদের সন্তানরা?
আমাদের তথাকথিত আধুনিক সমাজের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই অন্যায় করার পরও দিনের পর দিন আমরা আমাদের সন্তানদের শাসন করি না। অন্যায় করার পরও ছেলেসন্তানকে আমরা ছাড় দেয় এই বলে ‘ছেলেরা একটু এমনই হয়!’ এই একটি মাত্র আশকারামূলক বাক্য সমাজে ছেলেদের অবস্থানকে ভারসাম্যহীন করে তুলছে। অধিকাংশ পরিবারেই আমাদের ছেলেসন্তানরা ছাড় পেয়ে পেয়ে বড় হয়। একটু বুঝ হবার পর থেকে সামাজিক নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, ছেলেরা একটু-আধটু দুষ্টামি, অসভ্যতা করেই থাকে। বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে! বড় হয়ে আদৌ ঠিক হয় কি আমাদের সন্তানরা?
একই পরিবারে বেড়ে ওঠা ছেলে-মেয়ে যখন ভাই-বোন হিসেবে পাশাপাশি বড় হতে থাকে, তখন ছেলেসন্তান কোনো ভুল বা দুষ্টামি করলে শুধুমাত্র ছেলে হবার কারণে সহজেই ছাড় পেয়ে যায়। একই ভুল বা দুষ্টামি আবার যদি মেয়েসন্তান করে সে কিন্তু ছাড় পায় না। বরং শুধুমাত্র মেয়ে হবার কারণে তাকে গঞ্জনার শিকার হতে হয়। সে যতই ছোট হোক না কেন; যতই তার মানসিক ও শারীরিক বিকাশ কম হোক না কেন। ছোটবেলা থেকেই পরিবারে মেয়েদের আঙুল দেখিয়ে শেখানো হয় মেয়ে মানুষের এত চঞ্চলতা, এত রাগ, এত দুষ্টামি ঠিক না। মেয়ে মানুষকে অন্য মানুষের ঘরে যেতে হবে। ধৈর্য ধরে অনেক কিছু সহ্য করতে হবে।
এই যে মেয়ে মানুষের এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না; এত এত কিছু শিখতে হবে। কোনোভাবে ভুল কিছু করা যাবে না! আমাদের সমাজে সাধারণত নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এমন ঘটনার অবতারণা হয়। প্রগতিশীল মানুষদের কাছে বাহ্যিক দৃষ্টিতে এটা এক ধরনের অমানবিক এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব মনে হলেও আমি বলব, নারী হওয়ার কারণে ছোট বেলা থেকে মেয়ে মানুষের এটা করা যাবে না, ওটা করে যাবে না এ বাধ্যবাধকতাই যেন একটা নারীকে মারাত্মক অপরাধী মানুষ হওয়া থেকে বাঁচায়। এটাই একজন নারীকে নিজের অস্বাভাবিক খায়েশের লাগাম টেনে ধরে নিজেকে সুস্থির রাখতে এবং ন্যায় ও অন্যায়ের ভেদাভেদ করতে শেখায়। সমাজের জন্য অনাকাক্সিক্ষত আজে বাজে কাজ করা থেকে মেয়েদেরকে বিরত রাখে এ লিঙ্গ বৈষম্যমূলক বাধ্যবাধকতা। তাই তো গুণ্ডা-ছিনতাইকারী, খুনি, নারী সমাজে সেভাবে থাকে না। তাদের ছোট বেলা থেকেই ছোট-খাটো ভুল হলেই শেখানো হয় যে, “তোমার এটা করা ঠিক না, ওটা করা ঠিক না।” অন্যায় করার পরও বলা হয় না “মেয়েরা একটু এমনই হয়!” এছাড়া স্বভাবগতভাবেও নারীরা একটু নমনীয় হয়ে থাকে। তাই বাঙালি সমাজে প্রেম বা পরকীয়াঘটিত অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার মতো অন্যায় কাজ ছাড়া বড় ধরনের তেমন কোনো অপরাধমূলক কাজে মেয়েদের খুব একটা জড়িয়ে পড়তে দেখা যায় না।
বাঙালি গ্রামীণ সমাজে এমন ঘটনা অহরহ দেখা যায়, একটা সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলে যাকে সবাই ভালো বলেই জানে সেও বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কারও গাছের আম, কারও গাছের ডাব বা লিচু চুরি করে খায়। কেউবা প্রতিবেশীর মুরগি ধরে জবাই করে বন্ধুদের সাথে জমসে পিকনিকের আয়োজন করে। এমন ঘটনা বাবা-মা বা মুরুব্বিরা জানলে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় বলে আমার মনে হয় না। এটা যে এক ধরনের বড় অন্যায় কাজ, কেউ তাদের বলে না। কোনো কোনো অবিভাবক দুই একটা ধমক দিয়ে সন্তানকে সুপথে আনার চেষ্টা করলে অধিকাংশ অবিভাবক এমন ছোট-খাটো অন্যায়কে পাত্তা দেন না। অনেক মুরুব্বি তো আবার মন্তব্য করেই বসেন, ‘এই বয়সে আমরাও কতো চুরি করছি আম-জাম। এই বয়সে ছেলেরা একটু এমনই হয়।’
একটা গরিব চোরকে মানুষের বাসায় চুরি করার দায়ে যে রকমের শাস্তি দেয়া হয়, তেমন কোনো শাস্তি কিন্তু দেয়া হয় না বিনোদনের উদ্দেশ্যে চুরি করা অল্প বয়সী ছেলেদের। বরং ‘এই বয়সে ছেলেরা একটু এমনই হয়’ এই কথার ছলে তাদের উঠতি বয়সের উন্মাদনায় আরও ঘি ঢালা হয়। তাদের ছোট ছোট খারাপ কাজের মৌখিক অনুমোদন দিতে দিতে আমরা তাদেরকে আরও মারাত্মক খারাপ কাজ করতে প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করে থাকি। অনেক সময় উঠতি বয়সী ছেলেদের মামাতো বা চাচাতো বোনের সাথে চুটিয়ে প্রেম করা, বন্ধুর ছোট বোনের সাথে প্রেম প্রেম খেলা, এমনকি অনৈতিক সম্পর্কের কাহিনীকেও ‘বয়সের দোষ’ বলে তাদের জন্য সহীহ করে দিই!
অনেক সময় দেখা যায় যে, রাস্তায় উ™£ান্ত কোনো ছেলে যখন কোনো মেয়েকে ইভটিজিং করে বা কোনো মেয়ের গায়ে হাত দেয়, তখনো অবিভাবক তাদের ছেলের বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয় না। বরং সন্তানের কুকর্ম ধামা চাপা দেয় বেশ কৌশলে। কেউ কেউ আবার নিজের ছেলেকে নিষ্পাপ ঘোষণা দিয়ে ইভটিজিংর শিকার মেয়েটার ওপরই নিজের ছেলের কুকর্মের দ্বায় চাপিয়ে দেয় নির্দ্বিধায়! তাদের ভাষ্যমতে নিশ্চয় মেয়েটার পোশাক খারাপ ছিল! সে নিজেই ছেলেটাকে সিডিউস করেছে! উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে আবার ছেলে মানুষকে ছেলে হওয়ার সুবাদে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে সানন্দে ছাড় দেয়া হয়।
অবশ্য এটা ঠিক যে ইদানীং মেয়েদের উগ্র চলাফেরা ছেলেদের অনেকটা উদ্বুদ্ধ করে মেয়েদের প্রতি বাজেভাবে আকৃষ্ট হতে। কিন্তু তাই বলে কি এ অসামাজিক কাজের জন্য ছেলেটার কোনো দ্বায় নেই? আমাদের সমাজে প্রতিটি পরিবারে এমন নৈতিক শিক্ষাভিত্তিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠা উচিত যেখানে ন্যায়-অন্যায়ের সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ে বলে কোনো বিভেদ থাকবে না। যেটা অন্যায় বা অপরাধ সেটা ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে অন্যায় বা অপরাধ। কোনো ধরনের খারাপ কাজে নিজেকে জড়িত না রাখার সুষ্ঠু শিক্ষা ছেলে-মেয়ে উভয়কেই পরিবার থেকেই দিতে হবে।
একবার এক পহেলা বৈশাখে হাজার লোকের মাঝে কিছু বখাটে ছেলে কর্তৃক দু-একজন নারীর শ্লীলতাহানীর চেষ্টা চলেছিল। ঐ সময় শ্লীলতাহানীর বিষয় নিয়ে সাধারণ জনমতের ভিত্তিতে দুই ধরনের প্রান্তিক অবস্থান তৈরি হয়েছিল। এক পক্ষ বলছিল, ‘যে মেয়েদের শ্লীলতাহানী হয়েছে তারা খারাপ মেয়ে, তাই তাদের এ দশা হয়েছে। ভদ্র মেয়ে হলে এমনটা হতো না। তারা এমন অনুষ্ঠানে কেন যাবে, যেখানে সাংস্কৃতিক চর্চার চেয়ে বেলিল্লাপনার চর্চা বেশি চলে?’ অন্যদিকে আর এক পক্ষ এ অঘটনের সব দায়ভার চাপিয়ে দিচ্ছিল ছেলেদের ওপর! ‘নষ্ট ছেলের দল!! তারা কেন এমন করবে? মেয়েরা কেমন পোশাক পরবে, সেটা তাদের নিজস্ব চয়েস। এটা তাদের পোশাকের স্বাধীনতা। মেয়ে পেলেই তার ওপর জানোয়ারের মতো হামলা করতে হবে? এটা কোন ধরনের অসভ্যতা? এদের বিচার চাই, এদের বিচার করতে হবে।’
এমন অন্যায়ের আসলেই বিচার হওয়া উচিত। তবে তার আগে আমাদের প্রান্তিক চিন্তাধারায় একটু লাগাম টানতে হবে। আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে দোষটা আসলে কার? আমি উভয় পক্ষের উদ্দেশ্যে বলতে চাই ছেলে বা মেয়ে কাউকে এককভাবে দোষ দেয়ার আগে আমাদের পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থার দিকে একবার চোখ বুলাতে হবে। যেখানে একটা ছেলে ছাড় পেয়েই বড় হয় যে, ‘ছেলেরা একটু এমনই হয়’ সে সমাজে বেড়ে ওঠা উঠতি বয়সী ছেলের থেকে আমরা এর চেয়ে আর ভালো কী আশা করতে পারি? যে সমাজে মেয়েদের স্বাধীনতা দেয়ার নামে বেলিল্লাপনার ট্রেনিং দেয়া হয়; সেখানে আমরা মেয়েদের নিরাপদ রাখবো কীসের ভিত্তিতে?
নারীরা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়ে পশ্চাৎপদ হলেও দেখবেন একটা পরিবার মেয়েকে বই-কলম হাতে দিতে নারাজ থাকলেও তার হাতে লিপস্টিক, প্রসাধনীর সরঞ্জাম কিনে দিতে একটুও কার্পণ্য করে না। মেয়েদের যেন একজন দেহসর্বস্ব মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা হয়! নিজেকে কত আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, সেটার জন্য ক্রমাগত অনুপ্রেরণা ও দিক নির্দেশনা পেয়ে আসে পরিবারের বড়দের কাছ থেকে। শাড়ির ভাঁজ কীভাবে ফেললে নিজেকে বেশিনিটোল ললনা লাগবে? কোন রংয়ের ড্রেসের সাথে কোন কালারের লিপস্টিক বা মেকআপ মানানসই হবে, সেটার প্রশিক্ষণ দেয়া হয় প্রতিটি পরিবারে। বাইরের পুরুষের সামনে নিজেকে আধা উদোম ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করলে আসলে যে নারীর নিজের সমস্যা হতে পারে, এটা অধিকাংশ পরিবারে মেয়েদের শিক্ষা দেয়া তো দূরের কথা, এর ভয়াবহতাটুকুও পর্যন্ত জানানো হয় না!
যে সমাজ ব্যবস্থায় ছেলে মানুষেরা ‘ছেলেরা একটু এমনই হয়’ এই বক্তব্যের সুবাদে ছাড় পেয়ে পেয়ে নিজের কোন কাজটা করা উচিত কোন কাজটা করা উচিত নয় ভুলে গেছে; সেই সমাজে একটা মেয়ে নিজেকে কিছুটা খোলামেলা ও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করলে ছেলেদের কুদৃষ্টি, কুমন্তব্যের; এমনকি ধর্ষণের শিকার হবে না এমন প্রত্যাশা করা আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কি?
পরিশেষে বলতে চাই পরিবার ও সমাজে এমন সুনিয়ন্ত্রিত রীতিনীতি এবং প্র্যাকটিস চালু হওয়া উচিত, যেখানে ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, কারও জন্য অন্যায় বা অপরাধ করার কোনো অনুমোদন থাকবে না। প্রতিটি পরিবার ছেলে-মেয়ে উভয়কে নৈতিক মূল্যবোধে শিক্ষাদানে অংশগ্রহণ করবে। ছেলেদের শিক্ষা দিতে হবে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া কী তাদের দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকানো যাবে না। অন্যদিকে মেয়েদেরও শিক্ষা দিতে হবে ছেলেদের সামনে খোলামেলাভাবে ঘোরাফেরা করা যাবে না। উভয় পক্ষকে কোনো ধরনের নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা না দিয়ে তাদের ওপর শুধু দোষ চাপিয়ে কোনো লাভ হবে না। ছেলে-মেয়ে উভয়কে নৈতিক, মানবিক এবং পারিবারিক সুষ্ঠু শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে এ সমাজ, এ পৃথিবীকে নিরাপদ ও শঙ্কাহীন আবাসভূমিতে পরিণত করতে হবে। তাদের জানাতে হবে নৈতিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে রাসূল (সা.) সর্বোত্তম লোক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই উত্তম, যার চরিত্র উত্তম।’ (বোখারি ও মুসলিম)।