পড়ুন, পড়ুন এবং পড়ুন : হৃদয় হবে আলোকিত

অতিথি লেখক
৮ মে ২০২৫ ১৪:৩৫

॥ জাফর আহমাদ ॥
বই এমন একটি উপকরণ, যা মানুষকে সহজেই আলোকিত পৃথিবীর সন্ধান দিতে পারে। বইয়ের অলৌকিক ক্ষমতা অত্যন্ত প্রবল। জীবনপথে নির্বিঘ্নে চলার জন্য বই মানুষকে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রদর্শন করে। নীতি-নৈতিকতা-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সভ্যতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং মানুষ মানবিক মূল্যবোধসহ বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর পরিমাণ উপাদান রয়েছে এ বইয়ে। জ্ঞানের আলো ছাড়া পৃথিবী অন্ধকার, বইয়ের মধ্যে আছে সব ধরনের জ্ঞান। তাই জীবনের জন্য, আলোকিত পথ-পরিক্রমার জন্য বই পড়তে হবে। এজন্য পৃথিবীবাসীর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম যে নির্দেশ এসেছিল, তা হলো, ‘ইকরা’ পড়ো। নবী সা.-এর প্রতি আসমান থেকে প্রথম এ প্রত্যাদেশটিই অবতীর্ণ হয়েছিল। অর্থাৎ পড় আর পড়। জানতে হলে পড়তে হবে, মানতে হলে পড়তে হবে, জীবনপথে নির্বিঘ্নে চলার জন্য পড়তে হবে এবং আলোঝলমল পথে চলতে হলে বই পড়তে হবে। অন্যথায় অন্ধকারের গভীর জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে প্রশ্ন হলো, কি বই পড়বো? কোন বই নির্বাচন করবো? আল কুরআনের যেথায় ‘পড়’ নির্দেশটি অবতীর্ণ হয়েছে, সেখানে বইয়ের ধরনও বলে দেয়া হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পড়ো, তোমার রবের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আলাক : ১)। বলা হয়েছে, সর্বপ্রথম সেই রবকে জানার জন্য পড়তে হবে, যিনি স্রষ্টা, যিনি সমগ্র বিশ্বজাহান এবং বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন। আমরা প্রতিদিন সালাতের প্রথমে সূরা ফাতিহায় পাঠ করে থাকি। সূরা ফাতিহা মূলত একটি দোয়া। এ দোয়ার মাধ্যমে আমরা মহান আল্লাহর কাছে সরল ও সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য আবেদন জানাই। ঠিক পরের সূরা আল বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলে দিলেন, “নাও! সেই মহিমান্বিত বই, যার মধ্যে সন্দেহের লেশমাত্র নেই এবং এটি মুত্তাকি তথা যারা আল্লাহকে ভয় করে চলতে চায়, তাদের সুপথ দেখাবে। সুতরাং দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভের জন্য সর্ব প্রথম আপনার পাঠ্য তালিকায় কুরআনকে বেছে নেবেন। একে সহীহ শুদ্ধভাবে পড়তে হবে এবং এর মর্মার্থ আত্মস্থ করতে হবে।
সারা পৃথিবীর চিকিৎসাবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীসহ প্রায় সকল চিন্তাবিদই আজ একটি বিষয় খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পেরেছেন তা হলো, মরণব্যাধি এইডস থেকে বাঁচতে হলে ‘ধর্মীয় অনুশাসন মানতে হবে’ ‘ধর্মীয় জীবনযাপন করতে হবে’। আমি বলতে চাই, শুধুমাত্র মরণব্যাধি এইডস কেন? জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ ও মুক্তির জন্য অবশ্যই ধর্মীয় অনুশাসন মানতে হবে। আর ধর্মীয় অনুশাসন বলতে আল-কুরআনের শাসনকেই বোঝায়। মানুষের ব্যক্তি চরিত্রের অধঃপতন, পারিবারিক বন্ধনে ভাঙন, সামাজিক ভ্রাতৃত্বের ধ্বংস এবং রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও সন্ত্রাসসহ পৃথিবীতে আজ বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, চারদিকে আজ মানুষ মানুষের রক্তের হোলীখেলায় মেতে উঠেছে। সামগ্রিক এ ধ্বংস থেকে বাঁচতে হলে এবং সুন্দর এক পৃথিবীর জন্য আল-কুরআনের কাছে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে। আল-কুরআন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে সকল মানুষের হিদায়াতের মশাল, দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির সনদ। এটি একক কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের সম্পদ নয়। বরং কুরআন সকল মানুষের এক অতুলনীয় ও অমূল্য সম্পদ, যা অবতীর্ণ করা হয়েছে মানুষদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আলিফ-লাম-রা। হে মুহাম্মদ! এটি একখান কিতাব বা বই, যা আমরা তোমার প্রতি নাজিল করেছি, যেন তুমি মানুষদের জমাট বাঁধা অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে লয়ে আস।’ (সূরা ইবরাহিম : ১)।
তাই আপনার পছন্দের ক্রম তালিকার নাম্বার-১ এ রাখুন মহাগ্রন্থ আল কুরআন। আগেই বলা হয়েছে, এটি এমন একটি গ্রন্থ, যা আপনার দুনিয়া ও আখিরাতের পথ পরিক্রমাকে সাবলীল ও সুন্দর করে দেবে। কারণ মানুষের সৃষ্টি কর্তা যিনি, তিনিই মানুষের স্বভাব প্রকৃতি সম্পর্কে অধিক অবহিত, তাই কুরআনকে মানুষের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই প্রণয়ন করেছেন। সুতরাং কুরআন যিনি পূর্ণ মনোনিবেশ সহকারে হৃদয়াঙ্গম সহকারে পড়বেন, তার হৃদয় এতটাই আলোকিত হবে যে, তিনি জীবন চলার পথে ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ ও উপকার-ক্ষতি দিবালোকের মতো স্পষ্ট অবলোকন করতে পারবেন। তাই কোনো মন্দ, অকল্যাণ ও ক্ষয়-ক্ষতি তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কুরআন অনুযায়ী যিনি নিজেকে গড়ে তুলবেন, তিনি সোনার মানুষে পরিণত হবেন, কুরআন অনুযায়ী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা হলে, সেই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র হবে শ্রেষ্ঠ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র।
ঈমানের মজবুতির জন্য বই পড়ুন। কারণ যার জ্ঞান নাই, তার ঈমান নাই। জ্ঞানের অভাবে পদে পদে ঈমানকে বিকিয়ে দিতে হয়। বিশেষত আল্লাহ ও বান্দার হক ও এর সীমারেখা জানার জন্য আপনাকে বইয়ের সাহায্য গ্রহণ করতেই হবে। তাই যত জানবেন, তত মানবেন। যত মানবেন, চারিত্রিক সৌন্দর্য তত উৎকর্ষতা লাভ করবে। বই থেকে যত দূরে থাকবেন, জাহেলিয়াতের অন্ধকার ততই আপনাকে গ্রাস করবে। একসময় এমন অন্ধত্ব লাভ করবেন যে, দিবালোকের মতো সত্য আপনার সামনে উদ্ভাসিত হওয়ার পরও সত্যকে উপলব্ধি করতে পারবেন না। এটিই আল্লাহ তায়ালা এভাবে বলেছেন, ‘আমি তাদের সামনে একটি দেয়াল এবং পেছনে একটি দেয়াল দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। আমি তাদের ঢেকে দিয়েছি, এখন তারা কিছুই দেখতে পায় না।’ (সূরা ইয়াসিন: ৯)। সুতরাং আলোকিত জীবনের জন্য, পরিশুদ্ধ চিন্তা-চেতনার জন্য, পরিশুদ্ধ জীবনের জন্য এবং ঈমান ও আমলের সমৃিদ্ধর জন্য বই পড়তে হবে।
বই এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ, যা খুব সহজেই আপনার-আমার জীবনকে আলোকিত করতে পারে। শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সভ্যতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, চরিত্র, আদব-লেহাজসহ জীবনের সব উপকরণ রয়েছে বইয়ের মধ্যে। প্রত্যেকের জীবনে মানসিক সমস্যা, দুঃখ, কষ্ট, বেদনা ও অস্থিরতাসহ নানাবিধ সমস্যা থাকতে পারে। এসব মানসিক সমস্যা দূর করার জন্য বই একটি প্রধান উপলক্ষ্য হতে পারে। অর্থাৎ মানসিক প্রশান্তির জন্য বই পড়তে হবে। অন্ধকার জীবনের বাসিন্দারা মানসিক সমস্যা দূর করার জন্য এমন কিছু পথ ও পন্থা আবিষ্কার করেছে, যা মানুষকে আরো বেশি করে সমস্যায় জড়িয়ে জীবনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু একমাত্র বই মানুষকে নির্মল আনন্দ দেয়ার প্রভূত ক্ষমতা রাখে। চিত্তকে প্রফুল্ল রাখতে বইয়ের কোনো বিকল্প নেই।
মানবজীবনে একটি বড় সমস্যা হলো অবসর সময় পার করা। বিশেষত কর্মজীবন থেকে অবসরে এসে শুয়ে-বসে সময় কাটে না। অলস সময়ের জন্য নানাবিধ জঠিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। আমি বলবো, এই অবসর সময়গুলোয় বইয়ের ভুবনে ডুবে যান। ইনশাআল্লাহ জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি নানাবিধ সমস্যা থেকে যেমন মুক্ত থাকতে পারবেন, তেমনি সময়ও দ্রুত কেটে যাবে। তাছাড়া এই জ্ঞানচর্চা মহৎপ্রাণ করে তুলবে এবং চিত্ত ও জীবনবোধ বিকশিত হবে এবং মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হবে। জীবন আরো সুশৃংঙ্খল হবে এবং পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানার্জন ও পরিপূর্ণ মানসিক প্রশান্তি লাভ করবে। ফলে জঠিল সব রোগ-বালাই ও নানাবিধ সমস্যা দূরীভূত হয়ে যাবে।
মানুষ সুস্থ থাকার জন্য প্রথম ও প্রধান উপাদান হলো সুস্থ সমাজ। পক্ষান্তরে সমাজের সুস্থতার জন্য তার অধিবাসীদের সুস্থতা একান্ত প্রয়োজন। কারণ সমাজের প্রধান সদস্য হলো মানুষ। মনুষ্য সমাজ নিয়েই একটি জাতিসত্তা গড়ে ওঠে। একটি সুস্থ-সুন্দর জাতি গঠন করতে হলে অবশ্যই বই পড়তে হবে। বই পড়ার মাধ্যমে মানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে, চরিত্র সংশোধিত হয়, ভালো ও বড় প্রতিভাধর মানুষ গড়ে ওঠে। আর এগুলোর জন্য তাদেরকে বইয়ের সান্নিধ্যে আসতে হবে। একদল পড়ুয়া, জ্ঞানে সমৃদ্ধ ও চরিত্রবান মানুষ নিয়েই সোনার সমাজ গড়ে ওঠে। ফলে উন্নত সমাজের অধিবাসীরা সুস্থভাবে সমাজে বসবাস করতে পারে। আলোকিত হৃদয় সম্পন্ন মানুষের সমহারে আলোকিত নিরাপদ সমাজ গড়ে ওঠে। রাসূলুল্লাহ সা. একদল জ্ঞানপিপাসু মানুষ দিয়েই একটি আলোকিত সমাজ কায়েম করেছিলেন। ফলে তিনি নিজেই নিজের সমকালীন যুগ সম্পর্কে বলেছেন, ‘খাইরুল কুরুনি কারনি।’ অর্থাৎ আমার যুগই হলো শ্রেষ্ঠ যুগ।