আওয়ামী নৃশংসতার প্রতীক আয়নাঘর

ভয়কে জয় করেই ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্টের পতন ঘটিয়েছে

ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:১৪

॥ ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া ॥
আওয়ামী লীগ হচ্ছে মানবতাবিরোধী এক ফ্যাসিস্ট দল ও শেখ হাসিনা এক ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসকের নাম। ফ্যাসিবাদের আইকন হচ্ছে শেখ মুুজিব আর তার কন্যা শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ হলো একবিংশ শতকের মূর্তিমান আতঙ্ক। কিলার লেডিখ্যাত হাসিনা মানবাধিকার লঙ্ঘন, বাকস্বাধীনতা হরণ করে এককথায় গণতন্ত্রকেই হত্যা করে ভোটারবিহীন কথিত নির্বাচনের মাধ্যমে জোর করে দেড় দশক ক্ষমতায় ছিল। বিভিন্ন উপায়ে ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করে জনগণকে দাবিয়ে রেখে ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখাই ছিলেন হাসিনার মূল টার্গেট। এ ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করতে তার অন্যতম উপাদান ছিল গোপন আয়নাঘর। আয়নাঘর তৈরিসহ বিভিন্ন অপকায়দায় এ আতঙ্ক সৃষ্টি করেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে অত্যাচার-নির্যাতন করেছে। তার পলায়নের পর শেখ হাসিনার তৈরি এসব গুপ্ত টর্চার সেলের খবর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে।
আয়নাঘর মানে এক গোপন বন্দিশালা। এসব বন্দিশালার ব্যাপারে হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে সাধারণ মানুষ তেমনভাবে জানতে পারেনি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের গিরগিটি সংবাদমাধ্যমও তার কোনো খবর জানাতে পারেনি বা জানলেও প্রকাশ করেনি। অপরদিকে গণতন্ত্রের পক্ষের মিডিয়াও আয়নাঘর নিয়ে কোনো খবর জানাতে ও প্রকাশ করতে পারেনি এবং এ ধরনের কোনো খবর প্রকাশের কোশেশ করেছে বলেও জানা যায়নি। এটা বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের চরম ব্যর্থতা। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদেশে অবস্থিত ব্লগাররা এ ব্যাপারে কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন।
আয়নাঘর নিয়ে প্রথম খবর প্রকাশ করে সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজ। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক সম্পাদক তাসনিম খলিলের সম্পাদনায় বিদেশ থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিষ্ঠান এ আয়নাঘরের নিউজটি প্রকাশ করে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে ঘটা করে প্রচার করা হতো বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আয়নাঘর নিয়ে কোনো ধরনের খবর প্রকাশিত হয়নি।
স্বাধীন নিউজ পোর্টাল নেত্র নিউজ ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট একটি অনুসন্ধানী হুইসেলব্লেয়ার প্রতিবেদন প্রকাশ করে অভিযোগ করে যে, বাংলাদেশের কর্মকর্তারা ‘আয়নাঘরে’ বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের আটক ও নির্যাতন করছে।
নিউজ পোর্টালটি গোপন কারাগারের সম্ভাব্য অবস্থানও প্রকাশ করেছে, যেখানে বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের বাংলাদেশে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। নেত্র নিউজের বিশদ প্রতিবেদনটি বলপূর্বক গুমের শিকার দুই ব্যক্তি হাসিনুর রহমান এবং শেখ মোহাম্মদ সেলিমের অন-দ্য রেকর্ড অ্যাকাউন্টের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। তারা বলেছেন যে, তাদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কারাগারের ভিতরে রাখা হয়।
কারাগারের সেলগুলোর ছবিও প্রকাশ করা হয়েছিল, যেগুলো সক্রিয় ডিউটি সামরিক অফিসারদের দ্বারা সরবরাহ করা হয়েছিল বলে সংবাদ সাইটটি দাবি করেছে।
এদিকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাজধানীর কচুক্ষেত, আগারগাঁও এবং উত্তরা এলাকার তিনটি গোপন কারাগার পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যেগুলো স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় টর্চার সেল এবং গোপন বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহার হতো।
পরিদর্শনকালে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম, গুম তদন্ত কমিশন ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসহ আয়নাঘরে গুম হওয়া ভুক্তভোগীরা।
পরিদর্শনকালে প্রধান উপদেষ্টাসহ উপস্থিত প্রতিনিধিরা সেখানে ইলেকট্রিক চেয়ারসহ নির্যাতনের জন্য ব্যবহৃত উপকরণ দেখতে পান। ভুক্তভোগীরা তাদের নির্যাতনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সময়কালের এসব টর্চার সেল এবং গোপন কারাগার আয়নাঘর নামে পরিচিতি পায়।
এর আগে ১৯ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন প্রধান উপদেষ্টার সাথে একটি বৈঠক করেছে। সে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে গুমের ঘটনায় তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানানো হয়। আর তখন বন্দিদের যেখানে রাখা হতো, তা জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল বা আয়নাঘর নামে পরিচিত।
কমিশনের সদস্যদের আহ্বানেই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত তিনটি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গণঅভ্যুত্থানের পর গত ১৯ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাক একটি খবর প্রকাশ করে যে, ‘আয়নাঘর’ নিয়ন্ত্রণ করতেন তারিক আহমেদ সিদ্দিক, যিনি শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন।
কলকতার আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আয়নাঘর’ হচ্ছে ‘গুমখানা’। হাসিনার শাসনকালে ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে মোট ৬০৫ জনকে গোপনে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে নিখোঁজ হন ৪০২ জন মানুষ। এ তথ্যটি প্রকাশ করে ঢাকাভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। ২০১৪ থেকে জুলাই ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৪৪ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়। তাদের মধ্যে ৪০ ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে গ্রেফতার অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে ২০৩ জন এখনো গুম রয়েছেন। যারা দীর্ঘদিন গুম থাকার পর ফিরে আসেন, তারা গুমের ব্যাপারে মৌনতা অবলম্বন করেন। ধারণা করা হয়, এসব মানুষকে গুম করে রাখা হয় আয়নাঘরে।
আয়নাঘর থেকে আরমানের মুক্তি
ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম আরমান। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। তাকে ২০১৬ সালে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য। যদিও তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল না। তার পিতা মীর কাসেম আলী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা। মীর কাসেম আলীর ছেলে হওয়ায় তাকে গুম করে আয়নাঘরে আটক করে রাখা হয়েছিল। প্রায় আট বছর আটক রাখার পর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীতে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
আয়নাঘর থেকে মুক্তির পর তিনি আয়নাঘরে বন্দি জীবনের দুঃসহ কাহিনী জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাকে জানালাবিহীন একটি কারাপ্রকোষ্ঠে আট বছর বন্দি রাখা হয়েছিল। ওই কক্ষটি এতো বছর ছিল যেন অন্তহীন অন্ধকার রাত। তবে ওই দিনটা ছিল ভিন্ন রকমের। ভোরের আলো ফোটার আগেই নিরাপত্তারক্ষীরা কক্ষে ঢুকে তাকে নামায শেষ করতে বলেন। খুলে দেন চোখের পুরো বাঁধন। খুলে ফেলেন হাতকড়াও। আমি সবসময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, এ পৃথিবীতে যদি আমাদের (স্ত্রী ও দুই কন্যা) আর দেখা না-ও হয়, বেহেশতে যেন একত্র হতে পারি।
আরমান তার মুক্তি নিয়ে জানান, কারারক্ষীরা এদিন ভোর হওয়ার আগেই তার কক্ষে ঢোকেন, ওইসময় তার মনে হয়েছিল, এই মনে হয় সব শেষ।
আরমান ভেবেছিলেন, তাকে মেরে ফেলে হয়তো লাশ নদীতে বা ডোবায় ডুবিয়ে দেওয়া হবে। সেদিন তিনিসহ আরও কয়েকজনকে একটি ছোট ভ্যানগাড়িতে তুলে শুইয়ে বেঁধে রাখে রক্ষীরা। দুজনের নিচে লুকিয়ে রাখা হয় তাকে। তাদের নিয়ে গাড়ি ছুটে চলে এক ঘণ্টা।
কিন্তু দেশের অন্য অনেক রাজনৈতিক বন্দির মতো ভাগ্য বরণ করতে হয়নি মীর আহমেদ কাসেম আরমানকে। তিনি বলেন, তাকে নিয়ে রাজধানী ঢাকার একপ্রান্তে নির্জন মাঠে ফেলে চলে যান ওই নিরাপত্তারক্ষীরা।
আরমান (৪০) বলেন, দীর্ঘ অন্ধকার বন্দিজীবনে একটি বিষয়ই তাকে পাগল হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। তা হলো, তার স্ত্রী এবং বর্তমানে ১১ ও ১২ বছর বয়সের দুই কন্যার চিন্তা।
গোপন বন্দিশালায় বিরামহীন যন্ত্রণা ভোগের বর্ণনা দিয়েছেন আবদুল্লাহিল আমান আযমী।
সাবেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমীকেও দৃশ্যত তার বাবার কারণে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার পিতা অধ্যাপক গোলাম আযম ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর তিনিও ওই সামরিক কারাগার (আয়নাঘর) থেকে ছাড়া পান। আমান আযমী আট বছর বন্দি ছিলেন। আযমীর অনুমান, ওই কয়েক বছরে অন্তত ৪১ হাজারবার তার চোখ বাঁধা এবং হাতকড়া পরানো হয়েছে।
আমান আযমী বলেন, ‘আমি (বন্দিজীবনে) সৃষ্টিকর্তার আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, ঘাস, গাছপালা দেখিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বন্দি হওয়ার পর প্রথম দিকে আমি দুটি ছোট ভেন্টিলেটর দিয়ে সূর্যের আলো দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ার পর তারা (কর্তৃপক্ষ) সেগুলো বন্ধ করে দেয়।’
জীবনধারণের মতো পরিবেশ না থাকা কারাগারটিতে চলত কঠোর নজরদারি। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতো নিয়মিত। চুল কাটা হতো প্রতি চার থেকে ছয় মাসে একবার। জিজ্ঞাসাবাদের প্রাথমিক দিনগুলোয় চলত শারীরিক নির্যাতন। বেশি হতো মানসিক নির্যাতন।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা কেন আয়নাঘর করেছিল
শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে এক বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছিল। যার কারণে বিরোধীদল, সংবাদমাধ্যম ও সুশীল সমাজ তার ক্ষমতা গ্রহণ ও স্বৈরাচারী কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালনার সমালোচনা করছিল। কিন্তু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বিরুদ্ধ মত সহ্য করতে পারছিল না। বিরোধীদলকে দমন করতে শুরু করে দমন-পীড়ন। দমন-পীড়ন করেও যখন বিরোধীদলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না, তখন বিভিন্ন অপকৌশল আটতে থাকে শেখ হাসিনা। আর সেই অপকৌশল ও চিন্তার ফসল হচ্ছে রাজনৈতিক বন্দিদের নির্যাতনের জন্য তৈরি করা হয় আয়নাঘর, যা ছিল রাজনৈতিক বন্দিদের কাছে ত্রাস বা বিভীষিকাময়। হাসিনার তৈরি বিরুদ্ধ রাজনৈতিক কর্মীদের গুমঘর। প্রতিবাদীদের কণ্ঠরোধ করার একটি উপায়। সারা দেশে ডিজিএফআই’র ২৩টি গোপন আটক কেন্দ্র রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি রয়েছে ঢাকায়।
২০২৪ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার বছর ২০০৯ সাল থেকে তার পতন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬০০টিরও বেশি গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
দেশে একটি ভীতির পরিবেশ তৈরি করে হাসিনা তার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতেই এ আয়নাঘর তৈরি করেছিল। যুগ যুগ ধরে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট শাসকরা এভাবেই দেশে ভীতির পরিবেশ তৈরি করে জনগণকে অত্যাচার-নির্যাতন করেছে। শেখ হাসিনাও এভাবে বিগত সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশের জনগণকে অত্যাচার-নির্যাতন করে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. বারি গ্লাসনার তার ‘কালচার অব ফিয়ার’ বইতে চমৎকারভাবে আধুনিক বিশ্বের এ ভীতির রাজনীতির বিশদ আলোচনা করেছেন। মি. গ্লাসনার তার বইতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভিত্তি করে লিখলেও তিনি সারা বিশ্বের ওপর গবেষণা চালিয়েছেন।
তার গবেষণার মূল ফলাফল হলো- এই সর্বব্যাপী ভয়ের সংস্কৃতির প্রধান উদগাতা হলো ক্ষমতাবানরা এবং যখন এরা ক্ষমতাসীন থাকে তখন অবিরত নানা অবয়বে এর ব্যবহার করে। যার নেতৃত্বে থাকে রাজনীতিবিদরা। আর ফেরিওয়ালা সহায়তাকারী হলো বিভিন্ন সংগঠন। এদের মাঝে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, সংবাদমাধ্যম; বিশেষ করে টেলিভিশন। এ আতঙ্কের ফেরিওয়ালা তথা পেডলারস অব ফিয়ার মানুষের মাঝে অযৌক্তিক আতঙ্ক সৃষ্টি করে, যাতে সাধারণ মানুষ ভীত হয়ে যায়। গ্লাসনারের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এ ফেরিওয়ালারা ক্ষুদ্র অভিজাতদের ক্ষমতা নিশ্চিত করার সাথে সাথে নিজেদের জন্য মুনাফার দুয়ার খোলে এবং ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করে। তিনি বলেছেন, এ কর্মকাণ্ডগুলোয় ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা সরকারের সব সরঞ্জাম ও ব্যবস্থা এমনভাবে ব্যবহার করে- যাতে জনগণ এক ভীতির রাজ্যে ডুবে থাকে এবং লাভবান হতে থাকে সমাজের ক্ষুদ্র উচ্চ একশ্রেণির মানুষ।
অস্ট্রেলিয়ান টিভি এবিসির জনাথন গ্রিন ২০১৪ সালে এক রিপোর্টে দেখিয়েছেন কেমন করে রাজনীতিবিদরা জনগণকে ভয় দেখায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক মন্ত্রী রামসফিল্ড জনগণকে সতর্ক করে বলেছেন, কখন হবে, কীভাবে হবে জানি না, তবে কিছু একটা ভয়ঙ্কর হবে। তেমনিভাবে আরেক মন্ত্রী রবিন উইলিয়ামস বলেছেন, সন্ত্রাসী আক্রমণ যে কোনো সময় হতে পারে।
বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীদের এমন সব বক্তব্য ও বিবৃতি প্রদান ও তা গণমাধ্যমে সম্প্রচারের আসল টার্গেট হচ্ছে জনগণের মধ্যে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করা, যাতে জনগণ সবসময় একটি ভীতির মধ্যে থাকে। সাধারণ জনগণ যদি সবসময় একটি ভয়ভীতির মধ্যে থাকে, তাহলে ক্ষমতাসীন ও সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা ও প্রতিবাদ করার সাহস পাবে না। এ ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির আসল টার্গেটই হচ্ছে ভয়ের আবহ তৈরি করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখা।
ভয়ের সংস্কৃতি ও ভীতির রাজনীতি নিয়ে বিশ্বখ্যাত অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ক্ষমতা ও রাজনীতির জন্য রাজনীতিবিদরা যে ধরনের শঙ্কা ও ভীতি ছড়ায়, তারই প্রতিফলন যেন ঘটেছে বিগত ১৫ বছর শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে। ফ্যাসিস্ট দল আওয়ামী লীগ ও তার প্রধান শেখ হাসিনা সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশে একটি ভয়ের সংস্কৃতিই চালু করেছিল। আর এ ভয়ের সংস্কৃতি প্রচার করতে তার অনুগত গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেছিল । যাতে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ তার বিরুদ্ধে কোনো উচ্চবাচ্চ্য না করে। আর এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে বা বলা যায়, এটার দায়িত্ব পালন করেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর একটি অংশ। তাদের মাধ্যমে গুম, খুন, ক্রসফায়ার করেই থেমে থাকেনি তাদের ভীতির সংস্কৃতিও ছড়িয়ে দিয়েছে। সব শেষে হাসিনা হিটলারের অনুসরণে গ্যাস চেম্বারের আদলে তৈরি করে আয়নাঘর। হাসিনা ক্ষমতার জন্য গুম-খুন, ক্রসফায়ার ও আয়নাঘরের মাধ্যমে দেশের হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করার পাশাপাশি ধ্বংস করে দিয়েছে অনেক অসহায় পরিবারকে। আজও অনেককে আয়নাঘরের এ ট্রমা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ খুন ও পরিবারকে ধ্বংস করেও শেষ রক্ষা হয়নি ফ্যাসিবাদের আইকন শেখ মুজিবের, তেমনি তার কন্যা শেখ হাসিনারও। বাংলাদেশের অকুতোভয় ছাত্র-জনতা শেখ হাসিনার ভয়ের সংস্কৃতি ও ভীতিকে উপেক্ষা করেই ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন ঘটিয়ে দেশকে স্বাধীন ও মুক্ত করেছে।