প্রসঙ্গ : বৈষম্য, সংস্কার ও নির্বাচন
১০ জানুয়ারি ২০২৫ ০০:০০
বর্তমানে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত বিষয় হলো- বৈষম্য, সংস্কার ও নির্বাচন। বৈষম্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দেখা যায়, এটা শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকেই। মুসলিম বসবাসকারী এলাকা নিয়ে একটি ভূখণ্ড তৈরির জন্য তদানীন্তন সময়ের আলোচিত ব্যক্তি কায়েদে আযমের নেতৃত্বে ব্রিটিশ-ভারতে তুমুল আন্দোলনে পাকিস্তান ও ভারত দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়।
প্রতিবেশী ভারত পাকিস্তান ভাঙার আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের উৎসাহিত করে। কারণ ভারতের ৭ রাজ্যের ভালো ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে শেখ মুজিবকে সবদিক দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। যদিও শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন। তারপরও ভারতের কূটনৈতিক চালে পাকিস্তান ভাঙার কাজে লেগে যান।
শেখ মুজিব ছিলেন তুখোড় বক্তা এবং জাতীয়তাবাদী নেতা। ভালোমন্দ না বুঝেই ভারতের কূটকৈৗশলের কাছে হেরে গিয়ে মুসলিম সত্তার দাবিদার পাকিস্তান দুই টুকরো করার কাজে আত্মনিবেশ করেন তিনি।
আমরা ফেরাউনের কথা বলতে পারি। আবু জেহেল, আবু লাহাবের কথা বলতে পারি, আর ইদানীং আমরা দেখেছি আফগানিস্তানে ব্রিটিশ, রাশিয়া ও সর্বশেষ শক্তিধর আমেরিকার পরাজয়। সিরিয়ার ৫৪ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান দেখলাম আমরা। মাত্র ১২ দিনের আন্দোলনে জনগণের বিজয়। আমাদের দেশের হাসিনার পরাজয় ও পালানোর কাহিনী মাত্র ৩৬ দিনের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মহান আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করেছেন নিজ হাতে, আবাবিল পাখির মতো ছাত্র-জনতাকে দিয়ে হাসিনা ও তার দোসরদের শাসনের অবসান ঘটিয়ে। ৩০০ এমপি-মন্ত্রী তাদের জনরোষ থেকে বাঁচতে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। জেলে গেছেন অনেকে। কেউ কেউ ভারতে পালিয়ে পরাধীনতার স্বাদ ভোগ করছেন। বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তি পেয়েছেন। কাজ এখনো অনেক বাকি।
ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হয়েছেন ৮৫ বছরের কর্মঠ ও জনদরদি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আরো ২৩ জন উপদেষ্টা নিয়োগ হয়েছে। যদিও তাদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তারপরও দেশের জনগণ স্বস্তিতে তাদের কাজ পর্যবেক্ষণ করছে, সহযোগিতা করছে। আবার সমালোচনাও করছে। আমরা ভালোর দিকে যেতে চাই। ৫৩ বছরের বৈষম্যের মূলোৎপাটন করতে চাই। ইতোমধ্যে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে।
যোগ্য-অভিজ্ঞ লোকদের নিয়ে বিভিন্ন সংস্কারের কমিটি করা হয়েছে। বের হয়ে আসছে হাসিনা ও তার দোসরদের দুর্নীতির পাহাড়। এমন কোনো দিক বা বিভাগ নেই, যেখানে হাসিনা ও তার লোকদের দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, টাকা চুরি থেকে রক্ষা পেয়েছে। আসলে গোটা হাসিনা প্রশাসন একটি চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ইতোমধ্যেই টাকা চুরির শ্বেতপত্র প্রধান উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করেছেন। অন্যান্য সংস্কারের কমিটিগুলোও স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাদের সুচিন্তিত মতামত সরকারের কাছে উপস্থাপন করবে। আমরা আশা করি, সরকার দেশদরদি দলগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা করে দ্রুততম সময়ে সংস্কারের প্রাথমিক কাজ শুরু করতে পারবে, ইনশাআল্লাহ।
নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। আমার জানামতে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারগণ তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও জনগণের অংশগ্রহণে যুগোপযোগী একটি নির্বাচন দিতে পারবেন। গত ৩টি নির্বাচন সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ভুয়া, ডামি, দিনের ভোট রাতে করে দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি করা হয়েছে। তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারপতি খায়রুল হক দেশের নির্বাচন পদ্ধতির বড় ক্ষতিসাধন করে গেছেন। তাকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচার বিভাগের সংস্কার কমিটিকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার অনুরোধ করছি।
নির্বাচন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হওয়ার প্রয়োজন। সংখ্যাভিত্তিক নির্বাচনের ব্যাপারে ইতোমধ্যেই জামায়াতে ইসলামীসহ প্রায় সবাই এ পদ্ধতি গ্রহণের জন্য মত দিয়েছে, বিএনপি ছাড়া। আমরা বিশ্বাস করি, এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ভালো লোকের সংসদ হবে। ছোট-বড় সব দলেরই প্রতিনিধি সংসদে ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবে। পতিত আওয়ামী লীগ আবার সংসদে চলে আসে কিনা বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সবই আজগুবি এবং চিন্তার দৈন্যতা ছাড়া কিছু নয়। কারণ আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা যে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, লুটপাট, দেশের টাকা বিদেশে পাঠিয়ে ঘরবাড়ি বানিয়েছে অন্যায়ভাবে, তারা আর দেশের মাটিতে জনগণের সামনে দাঁড়াতে পারবে কী? এটা অবিশ্বাস্য। শহর-বন্দরে দেয়াল লিখন দেখলেই হাসিনার দুর্নীতি, অপশাসনের কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়। তারা বিচারের সম্মুখীন হবে এবং দুর্নীতি, দেশের ক্ষতিকারক নেতা-নেত্রীরা ও দল নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষিত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের দেশদরদি দল, ছাত্র-জনতা আগস্ট বিপ্লবের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চললে দেশের মানুষ আওয়ামীদের বাদ দিয়ে দেশদরদিদেরই সংসদে পাঠাবে। দেশ উন্নতি-অগ্রগতির দিকে চলে আসবে। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব, ইনশাআল্লাহ।
যারা ইতোমধ্যেই কিছু লোক ভারতে দালালি করার দায়িত্ব পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে আবারো আওয়ামী লীগের বিকল্প খুঁজছেন ভারতের গোয়েন্দারা, তাদের ফাঁদে এসব লোকের পা দেয়ার আভাস পাওয়া গেছে। তাদের বলতে চাই, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পরও কেউ এ পথে হাঁটলে ভালো হবে না দেশের জন্য এবং তাদের জন্য। মানুষ আর ভুল করবে না। ইতোমধ্যেই হাসিনা ও তাদের লুটপাট জনগণের কাছে উন্মোচিত হয়েছে। তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। লুকিয়ে থাকা আমলা বা দোসররা কেউ তাদের আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না। হয় পালানো অবস্থায়ই থাকতে হবে অথবা জেলের ভাত খেয়েই জীবন পার করতে হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের মানুুষ একবার ক্ষেপলে কারো পরোয়া করে না। পাকিস্তানের স্বৈরশাসকরা বুঝেছে, আওয়ামী দোসররা আগস্ট বিপ্লবে বুঝেছে। তাই কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
আমরা দেশকে ভালোবাসী, দেশের মানুষকে ভালোবাসী। আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো গোলামি করতে চাই না। আমরা বিশ্বাস করি, তিনিই আমাদের একমাত্র অভিভাবক আর আল্লাহই আমাদের সাহায্যকারী। তাই আমাদের কারো রক্তচক্ষুর ভয় নেই। আমরা জনগণের সেবা করে দেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রেখে দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আখিরাতের কল্যাণ চাই। জান্নাতের সীমাহীন কল্যাণ চাই। জান্নাতুল ফেরদাউস পেতে চাই। দেশের ভালো মানুষকে নিয়ে।
দেশের বড় দলের প্রধান বেগম জিয়া ইতোমধ্যেই চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেছেন। তিনি যাওয়ার পূর্বে নেতাদের বলেছেন ভেদাভেদ ভুলে দেশের সেবা করার জন্য। আমরা তার আহ্বানের সাফল্য কামনা করছি। আমরা বেগম জিয়ার সুস্থতা কামনা করছি। আর ভেদাভেদ নয়, আমরা দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। সাময়িক লাভ নয়, দেশকে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপহার দিতে চাই স্বাধীন-সার্বভৌম কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে।
জনগণকে আহ্বান করতে চাই, দেশে কারা চাঁদাবাজ, দখলবাজ, তাদের ধরিয়ে দিন। নিজে চাঁদা দেবেন না, কাউকে চাঁদা দিতে দেবেন না। চাঁদাবাজদের কোনো দল নেই। আগে বা পরেও নেই। চাঁদাবাজ চাঁদাবাজই। তাদের উচ্ছেদ চাই। বর্তমানের পুলিশ প্রধান ভালো মানুষ। তাই আপনারা পুলিশের সাহায্য নিন। কোনো অভিযোগ থাকলে পুলিশের সাহায্য নিন। দলমত-নির্বিশেষে থানার ওসি, ইউএনওদের নিয়ে মতবিনিময় করুন। দেশের ভালোর জন্য কাজ করুন। ফল পাওয়া যাবে। আমরা কয়েকদিন পূর্বে ধানমন্ডি থানার উদ্যোগে পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে জামায়াতের একটি মতবিনিময় সভা হয়েছে। আমরা সবাই সবার সহযোগিতায় চাঁদাবাজ উচ্ছেদের কর্মসূচি নিয়েছি। আপনারাও যার যার এলাকায় উদ্যোগ নিন। ভালো ফল পাওয়া যাবে।
নির্বাচন যথাসময়ে হবে, ইনশাআল্লাহ। ভোটার লিস্টের হালনাগাদ করার কাজ চলছে। সঠিক ভোটার লিস্ট করার ওপর নির্ভর করছে সুষ্ঠু নির্বাচন। আমরা ভোটার লিস্ট করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করব।
সবাই জনগণের আস্থা পাওয়ার চেষ্টা করুন। ভালো কাজ করলে ভালো ফল পাবেন। আমাদের দেশ সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নয়। আমরা বাংলাদেশি। আমরা সৎ প্রতিবেশী হিসেবেই বসবাস করতে চাই।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।