সংবাদ শিরোনামঃ

নির্বাচনী বৈধতা চ্যালেঞ্জের মুখে ** ত্রুটিপূর্ণ আইনে জামায়াত নেতাদের বিচার করা হচ্ছে ** রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিন ** সরকার দেশকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে ** দেশ আজ গভীর সঙ্কটে॥ প্রয়োজন দ্রুত একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ** জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি নয় উৎপাদন বাড়ান ** আরো এক কাপুরুষ জেনারেলের কাহিনী ** দুঃস্থ সাংবাদিকতা ** নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ** সিলেট বগুড়া ও রাজশাহীতে শিবিরের মিছিলে পুলিশের গুলি ** কবি ফররুখ আহমদ এক দুঃসাহসী সিন্দাবাদ **

ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪২১, ২৭ মহররম ১৪৩৬, ২১ নভেম্বর ২০১৪

মূল : জরিন আনজুর
অনুবাদ : ফজল হাসান
[আফগানিস্তানের সিরহিন্দ জেলায় পশতুনদের ওপর আক্রমণ করার জন্য ১৪৬২ সালে তৎকালীন দিল্লির রাজা সুলতান মোহাম্মদ শাহ তার গভর্নরকে আদেশ দিয়েছিলেন। বর্তমান গল্পটি ঐতিহাসিক এ ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা, যা ‘দ্য হিস্ট্রি অব দ্য পশতুনস’ গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রফেসর আবদুল শাকুর রেশাদ তার এলিজিতে মর্মান্তিক এ ঘটনার কথা উল্লেখ করে গেছেন। এ ছাড়া এ ঘটনার বিবরণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবির কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে।]

সারা গ্রামে ওরা শুধু তাকেই একমাত্র পুরুষ খুঁজে পেয়েছে। ওখানে আর কোনো পুরুষ ছিল না। গ্রামে যে সব পুরুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে, জেলার গভর্নর তাদের সবাইকে তার বাড়ির উঠানে উপস্থিত করার জন্য সেনাবাহিনীকে হুকুম জারি করেছেন।

গ্রামের যেসব পুরুষ প্রতিবাদী, গভর্নর নিজেই তাদের মোকাবেলা করবে। সৈন্যবাহিনীকে যা আদেশ করা হয়েছে, তারা তাই করেছে। সারা গ্রামে চিরুনি অভিযানে শুধু এই বৃদ্ধ লোকটিকে ছাড়া তারা আর কোনো পুরুষকে খুঁজে পায়নি। গ্রামটি ছিল সিরহিন্দ জেলায়। তবে ‘পশতুনদের গ্রাম’ নামেই এই গ্রামটি সুপরিচিত ছিল। গভর্নরের পাশবিক অত্যাচার, বর্বরতা ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে একসময় গ্রামের মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। যার জন্য ধরা পড়ার ভয়ে পুরুষরা বাড়ি ছেড়ে পাহাড়ে লুকিয়ে থাকত। ওখান থেকে তারা গভর্নরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করত এবং কোনো অবস্থাতেই অত্যাচারী গভর্নরের কাছে আত্মসমর্পণ না করার শপথ নিয়েছিল। তবে নারী ও শিশুদের দেখভালের জন্য এই বৃদ্ধকে তারা গ্রামে রেখে গিয়েছিল। যেহেতু সৈনিকদের আদেশ করা হয়েছিল, তাই তারা বৃদ্ধকে ধরে নিয়ে গভর্নরের সামনে উপস্থিত করেছিল। সৈন্যরা বৃদ্ধ লোকটিকে একটা প্রকোষ্ঠে বন্দী করে রেখেছিল।

পরদিন গভর্নর আরো নতুন সেনা নিয়োগ করলে রাজা তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন। অত্যন্ত নির্দয় এবং পাষণ্ড এক সৈনিককে দলের নেতা বানানো হয়েছিল, যাতে সে ক্ষুদ্র ও নিরস্ত্র গ্রামের মানুষের ওপর নির্বিবাদে অত্যাচার করতে পারে। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, সৈনিকেরা বিনা প্রতিরোধে গ্রামে ঢুকতে পারেনি। গ্রামবাসীর সাথে পুরো দুই দিন তাদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল। একজনও বেঁচে থাকা পর্যন্ত গ্রামের পুরুষেরা প্রচণ্ড সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছিল। অবশেষে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের সবাইকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। তারা দেশের জন্য শহীদ হতে রাজি ছিল, কিন্তু গভর্নরের আদেশের কাছে নতজানু হতে মোটেও রাজি ছিল না। পরে সৈনিকেরা তাদের শিরñেদ করে সাক্ষী হিসেবে রক্তাক্ত মুণ্ডু ছালার থলেয় ভরে গভর্নরের সামনে উপস্থিত করেছিল।

সেই সময়ে বৃদ্ধ লোকটি বন্দী ছিলেন। তিনি রীতিমতো বিভ্রান্ত এবং কিছুতেই জানতে পারেননি কী ঘটেছে কিংবা তার জন্য কী ধরনের দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। একসময় তার মনে হয়েছিল, সৈনিকেরা হয়তো তাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি ভেবেছেন, হয়তো তাকে অন্য কোনো বড় কারাগারে স্থানান্তরিত করা হবে। অবশেষে তিনি দেখতে পেলেন, পাহারাদারেরা তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসছে। পাহারাদারেরা তাকে গভর্নরের সামনে হাজির করেছে। সেখানে গভর্নর বিজয়ের আনন্দ উৎসব পালন উপলক্ষে হরেক রকমের খানাপিনার আয়োজন করেছিলেন। শাহি ভোজে উপস্থিত হয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং সৈন্যবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

বৃদ্ধ লোকটিকে উঠানে হাজির করার জন্য গভর্নর হুকুম দিয়েছেন। বৃদ্ধ লোকটি ভাবলেন, এটা রীতিমতো এক আশ্চর্যের বিষয় যে, তার মতো একজন গ্রামের গোবেচারা মানুষকে আড়ম্বর ভোজসভায় উপস্থিত থাকতে হবে। ঘুণাক্ষরেও তিনি জানতে পারেননি, এই শাহি ভোজ কেন আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি শাহি ভোজের কারণ বুঝতে পারলেন। গভর্নর অট্টহাসির সাথে প্রায় চিৎকারের মতো করে বললেন, ‘রক্তাক্ত মুণ্ডু ভর্তি ছালার ব্যাগ নিয়ে আসো। বুড়োকে জিজ্ঞেস করব মাথাগুলো কাদের। সব মাথা এখানে নিয়ে আসো।’ বৃদ্ধ লোকটি ভয়ে জড়োসড়ো এবং রীতিমতো বিচলিত। গভর্নরের পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি মোটেও ওয়াকিবহাল নন।

উঠানে বড় বড় ছালার ব্যাগভর্তি রক্তাক্ত মুণ্ডু এনে হাজির করা হলো। উঁচু মঞ্চে তোলার পথটুকুতে ব্যাগ থেকে চুইয়ে পড়ছিল ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। তারপর ব্যাগ থেকে রক্তাক্ত মাথাগুলো বের করে স্তূপাকারে সাজানো হয়। এ দৃশ্য দেখে বৃদ্ধ লোকটির গাল বেয়ে ঝরে পড়ছিল অশ্রুর নহর। তার শুভ্র দাড়ি ভিজে সয়লাব এবং চোখেমুখে ঘৃণা আর প্রতিশোধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ঝলকানি। আকস্মিকতা এবং অনুশোচনায় তার মাথার চুল খাড়া। নিঃশব্দে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রচণ্ড ক্ষোভের সাথে তিনি রক্তপিপাসু বর্বরদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।

এ সময় গভর্নর কণ্ঠস্বর সপ্তমে তুলে গম্ভীর গলায় আদেশ করেন, ‘শনাক্ত করার জন্য একেকটা করে মাথা বের করে বুড়োর সামনে ধরো।’ দেহহীন মাথাগুলোর দিকে বুড়ো নির্বাক তাকিয়ে আছেন এবং মনে মনে ভাবছেন, মাথাগুলো তরতাজা যুবকদের ছিল। বৃদ্ধ লোকটির ভাবনার নিস্তরঙ্গ পুকুরে ঢিল ছুঁড়ে ছন্দপতন ঘটিয়ে গভর্নর বললেন, ‘এখানে যে মাথাগুলো আছে, তার প্রত্যেকটির নাম বলো। এগুলো যাদের মাথা, তাদের পরিবার সম্পর্কে বলো এবং সামাজিক পরিচয় দাও।’ ভয়ার্ত চোখে বৃদ্ধ লোকটি গভর্নরের মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু যা বলা হয়েছে, তাই তাকে বিনাবাক্যে পালন করতে হবে। কেননা তার সামনে বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই।

ছালার ব্যাগ থেকে প্রথম মাথা বের করে বৃদ্ধ লোকটির সামনে রাখা হলো। মাথাটা দেখেই তৎক্ষণাৎ তিনি চিনতে পারলেন। লোকটি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য তিনি বললেন, যেমন নাম, পারিবারিক পরিচয়, পেশা ইত্যাদি। তারপর আরেকটি মাথা তার সামনে রাখা হলো। তারপর আরো একটি। এভাবে একের পর এক মাথা বের করে বৃদ্ধ লোকটিকে দেখানো হলো। প্রতিটি মাথা সম্পর্কে তিনি বিশদ তথ্য পরিবেশন করলেন। বৃদ্ধ লোকটি প্রত্যেককেই ভালো করে চেনেন। কেননা একসময় তিনি একই গ্রামে শৈশব কাটিয়েছেন এবং মৃত যুবকদের সাথে গভীরভাবে মেলামেশা করেছেন। যখনই তিনি একেকজন যুবক সম্পর্কে বলা শুরু করেন, তখনই গভর্নর এবং অন্য কর্মকর্তারা অবাক বিস্ময়ে ও গভীর মনোযোগে শুনতে থাকে। মাঝে মধ্যে তারা বৃদ্ধ লোকটিকে ভর্ৎসনা করেন। কখনো বা তাদের হালকা ও চটুল গল্প উপস্থিত দর্শক মহলে বেশ হাসির উদ্রেক করে। কিন্তু বৃদ্ধ লোকটি ক্রমাগত মৃত যুবকদের বীরত্ব ও সাহসিকতার বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। এক যুবক সম্পর্কে বলার মাঝখানে হঠাৎ বৃদ্ধ লোকটির সামনে এটি দেহহীন রক্তাক্ত মাথা আনা হয়। মাথার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে তিনি বললেন, ‘না, আমি একে চিনি না।’

গভর্নর বাঘের মতো গর্জন করে উঠে বললেন, ‘দেখো, ভালো করে তাকিয়ে দেখো। অবশ্যই তোমার চেনার কথা। আমি বিশ্বাস করি না, তুমি ওকে চেনো না।’

বৃদ্ধ লোকটি আরেকবার ভালো করে মাথার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করেন। একসময় তিনি উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘দুঃখিত, আমি ওকে চিনি না, এমনকি কোনো দিন দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। একমাত্র পরম করুণাময় আল্লাহপাক ভালো জানেন।’

রাগে-ক্ষোভে গভর্নর চিৎকার করে বললেন, ‘কেমন করে তুমি চেনো না? ওর মাথা তো ভিন্ন গাঁ থেকে আনা হয়নি। ভালো করে দেখে বলো। ওর সম্পর্কে বলো। তোমাকে বলতেই হবে।’

বৃদ্ধ লোকটি আবার রক্তাক্ত মাথা উল্টেপাল্টে দেখলেন এবং আলতো হাতে মৃত যুবকের গাল স্পর্শ করে বললেন, ‘ওকে আমি চিনি না। এখন কী করব? কিছুতেই ওকে আমি চিনতে পারছি না।’

আবারো গভর্নর চিৎকার করে বললেন, ‘ওকে অন্য মাথাগুলো দেখাও। এ মাথা সম্পর্কে পরে আবার জিজ্ঞেস করব। হয়তো তখন বুড়ো চিনতে পারবে। না হলে ওকে জোর করে বলতে বাধ্য করব।’

বৃদ্ধ লোকটির সামনে অন্য মাথাগুলো বের করা হলো। কয়েক ঘণ্টা ধরে এ ঘটনা চলতে থাকে। বৃদ্ধ লোকটি প্রতিটি যুবকের ব্যক্তিত্ব, বীরত্ব এবং তাদের ত্যাগ সম্পর্কে বিশদ বলছিলেন। এ সময় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজন যুদ্ধের সময় মৃত যুবকদের ভূমিকা ও কলাকৌশল সম্পর্কে বলতে শুরু করেন। তারা এ-ও বললেন, কেমন করে ওদের পাকড়াও করেছেন এবং পরে শিরñেদ করেছেন, এমনকি যুবকদের অসীম সাহসের ঘটনাও বললেন। উপস্থিত রাজসভার লোকজন একে অন্যের আশ্চর্যান্বিত মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।

শেষের দিকে বৃদ্ধ লোকটি মুষড়ে পড়েন। ইতোমধ্যে তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে এবং কণ্ঠস্বর বসে গেছে। হঠাৎ তার মনে পড়ল, একটা মাথা ছাড়া তিনি সব মাথার পরিচয় দিয়েছেন।

বৃদ্ধ লোকটি বুঝতে পারলেন, গ্রামের কিছু যুবক এখনো বেঁচে আছে। কেননা এখানে তাদের মাথা নেই। চোখে-মুখে একচিলতে আশার আলো জ্বালিয়ে তিনি মনে মনে ভাবলেন, আপাতত তার নিজের ছেলে বাহলুল বেঁচে আছে। অন্য কেউ তার কথা শুনতে পারে, সেদিকে খেয়াল না করে তিনি অবচেতন মনে নিজের সাথে বিড়বিড় করে কথা বলছিলেন, ‘বাহলুল এবং অন্য যুবকেরা নিশ্চয় এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধ নেবে। অবশ্যই ওরা একদিন এই অত্যাচার এবং অবিচারের সঠিক বিচার করবে। ওদের বিচার করতেই হবে। নিশ্চয় ওরা প্রতিশোধ নেবে।’

রাজসভার কর্মকর্তারা পুনরায় একে অপরের মুখের দিকে তাকান এবং বৃদ্ধ লোকটিকে নিয়ে হাস্য-উপহাস করেন। তখনো বৃদ্ধ লোকটি ভাবনার অতলে ডুবে ছিলেন। গভর্নর আবার চিৎকার করে বললেন, ‘আগের মাথা নিয়ে এসো।’ এটি সেই মাথা, যা বৃদ্ধ লোকটি কিছুতেই এর আগে শনাক্ত করতে পারেননি। তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কম্পিত গলায় বললেন, ‘আমি জানি না। পরম করুণাময় আল্লাহপাক ভালো জানেন।’

‘এর মানে কী?’ ধৈর্যহীন গভর্নর চিৎকার করে জানতে চাইলেন। তিনি আরো বললেন, ‘এই বুড়ো, তুমি একটা মূর্খ। হয় তুমি এ মাথার পরিচয় দাও, নইলে তোমার নিজের মাথা যাবে। বুঝতে পারছো?’

গভর্নরের বদমেজাজিভরা কণ্ঠস্বর শুনে রাজসভার কর্মকর্তারা ভয়ে কেঁপে ওঠেন। বৃদ্ধ লোকটি গভীর মনোযোগ দিয়ে দেহহীন রক্তাক্ত মাথা পুনরায় শনাক্ত করার চেষ্টা করেন। কিছুক্ষণ বাদে তিনি মিনমিনে গলায় দৃঢ়তার সাথে বললেন, ‘বলেছি তো আমি ওকে চিনি না। এখন আপনার যা খুশি, আমাকে নিয়ে তা-ই করতে পারেন।’

বৃদ্ধ লোকটির কথা শুনে রাগে-ক্ষোভে গভর্নর ফেটে পড়েন। তার চোখে-মুখে হিংস্রতার রক্তিম আভা ফুটে ওঠে। রাগান্বিত গলায় তিনি বললেন, ‘বুড়ো, যে করেই হোক আমি তোমাকে জানতে বাধ্য করবো।’

বলেই গভর্নর আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। উঠোনজুড়ে ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা। গভর্নরকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে সবাই রীতিমতো কাঁপছিলেন। আরেক কদম এগোনোর আগেই সেনাবাহিনীর প্রধান এগিয়ে এসে বললেন, ‘এই যুবক সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই, অর্থাৎ এই মাথা সম্পর্কে।’

গভর্নর সেনাবাহিনীর প্রধানকে বলার অনুমতি প্রদান করেন। বৃদ্ধ লোকটি সেনাবাহিনীর প্রধানের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন। সেনাবাহিনীর প্রধানও বুড়োর দিকে তাকালেন, এমনকি গভর্নরও। একসময় সেনাবাহিনীর প্রধান যুদ্ধের বর্ণনা শেষে মৃত যুবকের সাহসিকতা সম্পর্কে এভাবে বলতে শুরু করেন, ‘আমার ইচ্ছে হচ্ছিল ও যদি আমাদের সেনাবাহিনীতে থাকত, তবে খুব ভালো হতো। আমাদের অনেক ঝামেলায় ফেলেছিল। ভীষণ সাহসী। আমাদের অনেক সৈনিককে ও একাই খতম করেছে। ওকে ধরতে আমাদের বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। প্রথমে আমরা ওকে কিছুতেই ধরতে পারিনি। ও সৈন্যবাহিনীর যাবতীয় কলাকৌশল ব্যবহার করেছে। আসলে ও একজন বীরযোদ্ধা।’

সেনাবাহিনীর প্রধান কথা শেষ করার আগেই বৃদ্ধ লোকটি কম্পিত স্বরে বললেন, ‘এখন আমি ওকে চিনতে পেরেছি।’ উপস্থিত সবার চোখে-মুখে আশ্চর্যের ঝিলিক ফুটে ওঠে এবং সবাই নিশ্চুপ হয়ে যান। কেউ টুঁ শব্দটিও করেননি, এমনকি গভর্নরও না। বরং গভর্নর অবাক বিস্ময়ে বৃদ্ধ লোকটির মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকেন।

বৃদ্ধ লোকটি বললেন, ‘আমি ওকে চিনি। ওর নাম শাহীন।’

এক মুহূর্ত নীরবতার পর বৃদ্ধ লোকটির ঠোঁটের ফাঁকে এক টুকরো কঠিন হাসি ফুটে ওঠে। পরমুহূর্তে তার চোখ বেয়ে নেমে এলো অশ্রুধারা। চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে তার শুভ্র দাড়ি। নিচুস্বরে তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমি বলেছিলাম, শাহীন একটা ভীতু। আপনারা যখন ওকে জবাই করেছেন, আশা করি শাহীন তখন কোনো ধরনের লজ্জার কাজ করেনি। আমার ভয় হচ্ছিল, ও হয়তো যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাবে এবং সবাইকে বিপদে ফেলবে বা আত্মসমর্পণ করতে সুযোগ দেবে। এখন আমার কাছে মেঘহীন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, আমার ছেলে শাহীন সত্যিকার দেশপ্রেমিকের মতো দেশবাসীর মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে। দেশের এবং অন্যদের সম্মান রক্ষা করার জন্য শাহীন জীবন উৎসর্গ করেছে। কেমন করে এতক্ষণ আমি ওকে চিনতে পারিনি।’

বলেই বৃদ্ধ লোকটি আকুল কান্নায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

[লেখক পরিচিতি : জরিন আনজুর আফগানিস্তানের একজন সাংবাদিক, সমালোচক, ঔপন্যাসিক, কবি এবং গল্পলেখক। ১৯৫৭ সালে তিনি নাঙ্গাহার প্রভিন্সের গার্দি গাউসে জন্মগ্রহণ করেন। কাবুল ও পাকিস্তানের পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা এবং পশতু ভাষার ওপর পড়াশোনা করে তিনি কাবুলে শিল্প-সংস্কৃতি বিভাগে যোগ দেন। আফগান সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তিনি লেখালেখি করেন। এ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন বিষয়ে কুড়িটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে দিজ হেডস্ অ্যান্ড দিজ পিকচার্স, পয়েমস অ্যান্ড ক্রিটিসিজম এবং দ্য রুইন্ড স্ট্রিটস। ২০১১ সালে তিনি ‘সার্ক লিটারারি অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। বর্তমানে তিনি সপরিবারে জার্মানিতে বসবাস করেন এবং ‘দ্য সোসাইটি অব কালচারাল প্রমোশন অব আফগানিস্তান’ সংগঠনের একজন সক্রিয় সদস্য।

‘এভাবেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকে’ গল্পটি জরিন আনজুরের ইংরেজিতে দিস ইজ হাউ দ্য লিভস্ লিভ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি ২০০১ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর সংখ্যা আফগানম্যাগাজিন.কম-এ প্রকাশিত হয়। পরে গল্পটি শর্ট স্টোরিজ্ ফ্রম আফগানিস্তান গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।                                সূত্র : অন্যদিগন্ত

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।