সংবাদ শিরোনামঃ

মাওলানা সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড ** আমরা আশা করেছিলাম তিনি খালাস পাবেন ** বৃহস্পতি ও রোববার সারাদেশে হরতাল ** ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা : ইমেজ সঙ্কটে মিডিয়া ** সন্ত্রাসবাদের ইস্যুকে উজ্জীবিত রাখতে সক্রিয় যুক্তরাষ্ট্র ** মুক্ত চিন্তা বন্ধ করতেই মাহবুব উল্লাহর ওপর হামলা ** বিরোধী দলের প্রতি সরকারকে আরো সহনশীল হতে হবে ** এবার কোটি কোটি টাকার গালগল্প ** ঈদকে সামনে রেখে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে চোরাচালান বাড়ছে ** প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে বেঁচে আছে তিস্তাপাড়ের মানুষ ** মৌলভীবাজার মনুব্যারেজ ও লেকে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় ** কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষা ভাবনা **

ঢাকা, শুক্রবার, ৪ আশ্বিন ১৪২১, ২৩ জিলক্বদ ১৪৩৫, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪

শেখ আবুল কাশেম মিঠুন
যুগে যুগে বৃদ্ধিবৃত্তি এবং চিন্তার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে, সে পরিবর্তন কখনো কল্যাণময়তা নিয়ে আসে- কখনো বা অশান্ত, অস্থির হয়ে ওঠে সমাজ, রাষ্ট্র। কবি-সাহিত্যিকরা চিন্তার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রাখেন। যে সকল মানুষ তৌহিদে বিশ্বাস করেন, মৃত্যুপরবর্তী জবাবদিহিতে বিশ্বাস করেন তাদের অনেকের চিন্তারাজ্যেও পরিবর্তনের হাওয়ায় বিশৃঙ্খল হতে পারে, হয়ও। আর তখন বিশ্বাসী কবি-সাহিত্যিকরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে বিশ্বাসীদের বিভ্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ এবং পরবর্তীতে আশারফ সিদ্দিকী, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবদুল মান্নন সৈয়দ, আল মুজাহিদী, আফজাল চৌধুরী, সাজজাদ হোসাইন খানের মতো বিশ্বাসী কবিরা বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন, আজও তাদের সৃষ্টি অব্যাহতভাবে বিশ্বাসীর মন-মননে ভূমিকা রাখছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী আশির দশক পর্যন্ত বিশ্বাসী বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে একটা ধস নেমেছিলো। তখন বিশ্বাসী কবি-সাহিত্যিকদের অনুজ্জ্বল করার একটা প্রয়াস লক্ষণীয়। এতে অবিশ্বাসী কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় যুবশ্রেণীর মন-মানসকে সন্দেহ প্রবণ করে তুলেছিলো, চিন্তার ক্ষেত্রে বিশ্বাসহীনতা সৃষ্টির একটা প্রচেষ্টা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলো, যদিও তা অব্যহত গতিতে আজও এগিয়ে চলছে। আর আশির দশক পর্যন্ত তা ছিলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। উক্ত সময়ে বিশ্বাসের আলোর পতাকা বুকে ধারণ করে হাতে সত্যের কলম নিয়ে একঝাঁক তরুণ কবি এগিয়ে এলেন। প্রতি ছত্রে ছত্রে, প্রতি পঙক্তিতে পঙতিতে বিশ্বাসের জয়গান, দেশপ্রেম, মানবতা আর কল্যাণের সুর। কবি মতিউর রহমান মল্লিক, আবদুল হাই শিকদার, সোলায়মান আহসান, মুকুল চৌধুরী, বুলবুল সারওয়ার, আসাদ বিন হাফিজ, হাসান আলীম, মোশারফ হোসেন খান, তমিজউদ্দীন লোদী এবং আরো অনেকের সাথে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আমাদের আজকের স্বরণীয় কবি গোলাম মোহাম্মদ। ২০০২ সালের ২২ আগস্ট সুন্দরের কবি দেশবাসীকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন কায়িক জীবনের ওপারে।

মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর থানার সবুজ এক গ্রাম গোপালনগরে তাঁর জন্ম ১৯৫৯ সালে ২৩ এপ্রিল। সবুজ গাছ-গাছালির মেলা, নদী, পাখি, ফুল তার মনন গঠনে ভূমিকা রেখেছিলো। তাই তার কবিতায় বারবার ফিরে ফিরে এসেছে সহজ ও সারল্যে ভরা চিরসবুজ গ্রাম। গ্রামের সরল মনের মানবিক বোধসম্পন্ন লোকজন, পাড়া-প্রতিবেশী, শিক্ষকবৃন্দ, কবির চিন্তা, মনন গঠনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলো। অনেক কবিতায় তা স্পষ্ট মনে হয়েছে। ছোট বেলায় আল্লাহর কালাম পড়া মন-মস্তিস্কে গ্রাম এবং আশ-পাশের বিশ্বাসী মানুষ কবিকে আত্মিক উৎকর্ষের দিকে ধাবিত করেছে। তার বহুমুখী প্রতিভার স্ফুরণে তারই সাক্ষ্য বহন করে। বিশেষ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য যে পবিত্র আত্মার অধিকারী হওয়ার দরকার, কবির সৃষ্টি সেদিকেই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে বেশি। কবি বলেছেন:

হে মানুষ তুমি সুন্দর হও

বৃক্ষ, পত্র, ফুল দেখনি! ঝরনার নিক্কন শুনেও

কেন তুমি সুন্দরের পাগল হতে পার না।

........................................

সুন্দর হও সাদা মেঘ শরতের মতো

বকের ডানার মতো জোছনা, কুয়াকাটা,

সুন্দরবন, মাধবকুণ্ডের ঝরনার মতো।

নীলভেদী সাদা মিনার যেমন

পিকাসোর চিত্রকলার মতো প্রতিবাদে বিভাসে

তুমি সুন্দর হও।’

‘ফিরে চলা এক নদী’ কাব্যগ্রন্থের চতুর্থ কবিতা ‘প্রতিবাদে বিভাসে’। কবি গোলাম মোহাম্মদের চেতনায় চিন্তনে যে নিরন্তর সৌন্দর্য পিপাসা তা মরিচার আস্তরে আবৃত কোনো অন্ধ আত্মার নির্বোধ সৌন্দর্য পিপাসা নয়। সে উদগ্র সৌন্দর্য পিপাসা নিষ্ঠুরতায় অথবা হিংস্রতার পঙ্কিলতায় বহমান নয়, নয় কোনো স্বার্থান্ধ আত্মার আগ্রাসন। কবি গোলাম মোহাম্মদ তার সমস্ত কবিতায়, ছড়ায়, গানে অথবা প্রবন্ধে গদ্যে কিংবা ভাষণে যে সুন্দরের সাধনার পিপাসায় অবগাহন করেছেন, তা এক বিভাসিত প্রতিবাদের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত। বিনা রক্ত ক্ষরণে কালো মেঘকে পরাজিত করে সূর্য যেমন সত্য হয়ে উঠে। মানুষ আর প্রকৃতির সকল জঞ্জালের বিরুদ্ধে আলোকিত লড়াই করে সাগর নদী অথবা পদ্মা, মধুমতি অথবা হিজলবন, স্বচ্ছ আর নির্মল হয়ে ওঠে। কবির সুন্দরের সাধনা তেমনি প্রতিবাদে বিভাসে। আর এই সাধনার সুনির্মল পথ মাত্র একটিই। কবি তাঁর ‘অদৃশ্যের চিল’ কাব্যগ্রন্থের ‘বিশিষ্ট রসায়ন’ কবিতায় বলেছেন :

শক্তিমান আত্মা ও মননের সম্পৃক্ত দ্রবণে

পরিণত সময়কে প্রবাহিত করলে

মূল্যবান ধাতব সুকৃতি উৎপন্ন হয়।

আয়নিক বন্ধনে সোডিয়াম-ক্লোরিন যেমন

খাদ্যলবণ হয়ে যায়।

খাদ্য লবণ ছাড়া কোনো খাদ্যই যেমন রুচিকর হয় না তেমনি আত্মাকে মননের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বিশুদ্ধ না করলে তা পৃথিবীর কল্যাণে ব্যয়িত হতে পারে না। এই কবিতায় তিনি লিখেছেন,

আত্মার অনুগুলো কখনও কখনও আণবিক শক্তিমান হয়

বেষ্টিত শত্রুর লিপ্ততা ফুঁ করে ফেলে

অতল সমুদ্র থেকে সাবমেরিনের মত

বয়ে আনে ইলেকট্রনিক বিজয়।

মূলত আত্মাই মানুষের সকল বড়ত্বের

বিশিষ্ট রসায়ন।

কি সূক্ষ্ম গভীর দৃষ্টিভঙ্গিমায় কবির অন্তর্লোক উদ্ভাসিত। মূলত সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষ তখনই মানুষ হয়ে ওঠে যখন তার আত্মা পবিত্রতার সমুদ্রে ডুবে ডুবে , ঘষে ঘষে, মেজে মেজে স্বচ্ছ এক সুঘ্রাণে ভরপুর হয়। ছড়ায় সে ঘ্রাণ, নিজের পাশে, চারিপাশে, চতুর্দিকে। তা শুধু গোচর হয় স্বগত্রীয়ের দৃষ্টিতে এবং তাদের মানসপটে।

 

কবি গোলাম মোহাম্মদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে সেই সুনির্মল পবিত্র আত্মা যা তার কর্মে সৃজনে চিন্তনে স্বপ্নে জাগরণে মিলেমিশে হয়েছে একাকার। তিনি অদৃশ্যের চিল কাব্য গ্রন্থে ‘অদৃশ্যের চিল কবিতায় তা অকপটে বলে গেছেন:

দেহ নেই, প্রেম আছে, কবিতা আত্মার মতো

অদৃশ্যের চিল।

তিনি সুনির্মল পবিত্র আত্মা নির্মাণে এতো বেশি যতœà¦¶à§€à¦², এতো ব্যাকুল, এতো আকুল যে তার সৃষ্টিই এখন আত্মার সদৃশ্য। যদিও কবিতার আত্মার স্বরূপ উদঘাটনের চেয়ে কবিতার শরীরের পরিচয়টা আমাদের কাছে সহজ হয়ে ওঠে। কবিতার ভাষা, ছন্দ, উপমা, ব্যঞ্জনা অলঙ্কার সবই আমাদের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং স্বচ্ছ। মনে হয়, আমরা যারা আমাদের আত্মাকে আমাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ করে রাখি তখন কবিতার দেহসৌষ্ঠব দেখে আমরা মুগ্ধ হই অথবা মুখ ফিরিয়ে নেই। কিন্তু দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে আত্মাকে মুক্তি দিতে পারলেই আত্মা তখন ছন্দে, বর্ণে, ভাষায় পবিত্রতায় অনবদ্য কবিতার মতো সুন্দর হয়ে ওঠে। আর তখনই কবি গোলাম মোহাম্মদের অন্তর্লোকের সৌন্দর্য অনুভূত হয়, দৃষ্টিগোচর হয়:

১.

হৃদয়ে জমেছে অনেক কয়লা কালো

যতনে মরমে আবে জমজম ঢালো

হীরকের গায়ে ধুলার আস্তরণ

কতক্ষণ থাকে মিথ্যার প্রহসন

হৃদয়ে হৃদয়ে ফুটাও হাসনাহেনা

দেখ জমে উঠে কত না আকর্ষণ।

অদৃশ্যের চিল/ঝড়ের রাত্রে

 

২.

মানুষের ছায়ারাই তো মানুষ নয়

প্রস্তরের মূর্তিরাও নয় মানুষ

মানুষের আকৃতিও ভেতরের মানুষ নয়

মানুষের ভেতরই মানুষ থাকেÑ

ফুলের ভেতরে থাকে যেমন ফুল।

ফিরে চলা এক নদী/ভেতরের মানুষ

৩.

দৃষ্টির গভীরতাই শিল্পীকে অমরতা এনে দেয়

আশ্চর্য মেঘেরা বর্ণময় কারুকাজের ভেতর মানবিক হয়ে ওঠে।

অন্ধরা কিছুই দেখে না

মানুষ অন্ধ হলে তাই ব্যাহত হয় শিল্প-সুন্দর ও মানবতা।

ফিরে চলা এক নদী/অন্ধরা

৪.

হাতটারে সাফ কর সাফ করো দিল

মুছে যাবে যন্ত্রণা যতো মুশকিল

তাল তাল আন্ধার পাপ করো দূর

পুষ্পিত দিন পাবে ঘ্রাণ সুমধুর।

অদৃশ্যের চিল/হাসতো নিখিল

কবিত্ব শক্তিটি কোনো নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা অন্যকোনো শক্তি নির্ভর নয়। কবিত্ব শক্তি সম্পূর্ণ অলৌকিক শক্তি। পবিত্র আত্মার কোনো সাধক যখন এই অলৌকিক কবিত্ব শক্তির শিল্পী হয়ে ওঠেন তখন কবিতা ভাষা, উপমা, ব্যঞ্জনা আর অলঙ্কারের মাধ্যমে মানবাত্মার সর্বাঙ্গীন পুষ্টি সাধন করে। মানুষের বৈষয়িক কর্মসাধনে নৈতিকতায় ভূমিকা রাখে, আবার মানুষ যখন কর্মজগৎ থেকে পরিশ্রান্ত হয়ে অবসরে একটা কল্পনার জগতে বিচরণ করে তখন কবিতাগুলো তার আধ্যাত্মিক শক্তিকে বলিষ্ঠ করে। এখানেই স্বার্থকতা একত্ববাদী কবির। নিন্মের এইসব কবিতা তার স্বাক্ষর বহন করে :

১.

তাঁর দুই হাতে নিয়ামত সম্ভার

সে দান কেমনে করবে অস্বীকার

চোখ মেলে দেখ সেই স্নেহময়

অনু অন্তরে প্রতিক্ষণ সঞ্চার।

অদৃশ্যের চিল/কারুকাজ ভরা

২.

আমি যে সুপথ চাই আলোকিত সরল সুপথ

যে পথে হেরার নূর কামেল ইনসান

নববীর মিম্বর যেনো জীবন সমাজ

রূহ যার কালেমার চিরন্তন বাণী

অদৃশ্যের চিল/আমি যে সুপথ চাই

৩.

এক বলে ছয় রান মানুষেই করে

তোমার ইনিংস হোক পুষ্পময় নতুন রেকর্ড

সাহস বুদ্ধির খেলা অনিশ্চয়ে ঘেরা

সতর্ক মাঝির মতো ঢেউ ঠেলে ঠেলে

তরণী তোমার নাও উৎসবের তীরে।

ফিরে চলা এক নদী/সময়ের ক্রিকেট

৪.

তুমি কি দেখনা

ফুলের পাপড়িতে মৌমাছি কেমন ঘুরে বেড়ায়

দীঘল ভালোবাসায় সিক্ততায় নত হয়

আমি নত হই পরম সত্যের কাছে

এ আমার অধিকার ফিরে চলা এক নদী/দীঘল মুগ্ধতা

অন্তর্লোক যার সত্যের আলোয় ঝলমল, পুষ্পিত আত্মা যার মানবতার কল্যাণে কেঁদে ওঠে, অন্যের দু:খে চোখ থেকে অশ্রুঝরে, হৃদয় আবেগে কাঁপে থরথর। কিছু কবিতা আছে যা তাদের মনে জাগায় অনুপ্রেরণা এবং অত্যাচারীর প্রতি রুদ্ররোষে ফুঁসে দাঁড়ায় চিন্তা। কবি গোলাম মোহাম্মদের নির্মল সবুজ কচি ক্ষেতের মতো হৃদয় থিরথির করে কাঁপে, কাঁদে, অস্থির হয়ে ওঠে শব্দে ভাষায় অনিবার্য প্রতিবাদে :

১.

যার ঘর নাই তার ভালোবাসা কী?

ফিলিস্তিনীদের কেবল যুদ্ধই মানায়

মৃত্যু লাশ ধ্বংসের ভেতর দিয়ে

নতুন নতুন যুদ্ধে প্রতিদিন ধাওয়া করে মৃত্যু

উদ্বাস্তু শিবির, উদ্বেগ, প্রেমহীন পৃথিবী

ক্ষুধা কান্না স্বজন হারানোর যন্ত্রণা

আবার যুদ্ধ

ফিরে চলা এক নদী/ঘরহীনের কাব্য

২.

কাশ্মীরী শিশুর কান্নায় যখন ঝিলামের পানি প্রশস্ত হয়

বিপন্ন নারীর চিৎকারে যখন কাঁপতে থাকে ভূ-স্বর্গ

তখনও সাড়া তোলে না

পুঁজির পাহাড় আঁকড়ে পড়ে আছে ভোগবাদী বিশ্বাসীরা

জিহাদের আওয়াজ ঐ কানে বিরক্তিকর জঞ্জাল

ফিরে চলা এক নদী/আলোকিত অতীত

৩.

আজ ষাট হাজার বসনীয় নারী

বর্বর সার্ব দস্যুর সন্তান ধারনে বাধ্য হয়েছে

এ লজ্জা আমি রাখবো কোথায়?

ফিরে চলা এক নদী/গ্লানির উপত্যকা

৪.

ওরা কি কোন বোনের ভাই নয়, যারা সীমার মৃত্যুকে ডেকে আনে

পশুদের অত্যাচারে কত মেয়েই না সীমা হচ্ছে, ইয়াসমীন-শবমেহের হচ্ছে

নারীর চোখের লবণে বিষাক্ত হচ্ছে জনপদ-ভারী হচ্ছে পৃথিবীর বুক।

যেখানে ফুলের বিপনী আছে, সুগন্ধি কিনে নেয় মানুষ

সেখানে নারী কিভাবে লাঞ্ছিত হয়।

ফিরে চলা এক নদী/খুনীরা

 

কবি গোলাম মোহাম্মদ মূলত এক মানবতার কবি। তাঁর রচিত প্রায় সব কবিতাই মানবতার দলনে যন্ত্রণাদগ্ধ, বিপরীত দিকে প্রতিবাদে বিভাসে উন্মুখ, সোচ্চার।

আলীয়া তোমার জন্য অনুভব -অদৃশ্যের চিল

হরিয়াল পাখির মতো”

জিজ্ঞাসিব কারে”

বহতার তৈলচিত্র”

বিরস বোঝা ফিরে চলা এক নদী

ফসলহীন সময়ের কথা”

প্লাবিত প্রার্থনা”

ইতিহাসের পোট্রেট”

বিশ্ব বিবেক গান

যুদ্ধে যাবার সময় এলো”

শহীদের লাশ দেখো রক্ত মাখা”

ফিলিস্তিনী মায়ের চোখ ”

ঐ দেখো বালাকোট”

কান্দাহারের সেই মেয়েটি”

রাজপথে পড়ে আছে”

এমনি আরো অনেক কবিতায় ও গানে নিষ্পেষিত মানবতার দগ্ধ শরীর দেখে শিউরে ওঠা কবির প্রাণ কেঁদে ওঠেছে। কবির অন্তরাত্মার পবিত্রতা, যেখান থেকে উৎসরিত চিন্তনমালা প্রেমময় এক মানবসমাজ অবলোকন করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। সঙ্গত কারণেই কবি মৃত্যুর পরের জীবনে জবাবদিহির ভয়ে শঙ্কিত। এই শঙ্কা তাকে করে তুলেছে মানবপ্রেমিক ক্ষমাশীল, অনুভূতিপ্রবণ, ত্যাগি এবং মানবতার সুবিচারক।

 

তাঁকে বিশ্বাসী বলাটা সঙ্গত নয়। কারণ পৃথিবীতে সবাই বিশ্বাসী। কেউ বিশ্বাস করেন অবারিত স্বাধীনতা ভোগ করো, কোনো কৈফিয়ত কাউকে দিতে হবে না, কেউ বিশ্বাস করে বিশেষ কিছু ব্যক্তির সনদে সব কলুষতা পাপ পঙ্কিলতার ঊর্ধ্বে উঠে যাবে তারা। কেউ বিশ্বাস করে পৃথিবীর সব জঞ্জাল, সবকিছু থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলো, পৃথিবী আবর্জনার স্তূপে পরিণত হোক, তাতে কিবা যায় আসে, নিজে পার পেলেই রক্ষে। আমাদের কবি গোলাম মোহাম্মদ এসব বিশ্বাসে বিশ্বাসী নন। তিনি সহসী বীর যোদ্ধার মতো উচ্চকণ্ঠ এক পুরুষ, যিনি সংঘবদ্ধ শক্তিময় ভাষা চয়নে বলতে পারেন :

১.

আল্লাহর রাহে বিলায়ে দেবো আমার জীবনখানি

আল্লাহর পথে দিয়ে যেতে চাই এ বুকের কুরবানি

২.

খোদা সকল কিছুর বদল হলেও

তোমার শাসন দাও

শক্তি নাও মোর সম্পদও নাও

না হয় আমার জীবন নাও

৩.

খোদার রসূল নেতা আমার বিশ্বনবী মুহাম্মদ

আরশপাকের সম্মনিত

আল্লাহতালার প্রেমাস্পদ

৪.

খোদার জন্য কাজ করে যে সে জন অমর হয়

খোদার ভালোবাসা সে তো অনন্ত অক্ষয়

মাটির বুকে জিহাদের ময়দানে হাতে তীক্ষèধার তরবারী, বুকে ইমান নিয়ে অন্ধকারকে দূর করে সূর্য ওঠার মতো হামজা, আলী কিংবা খালিদ, অন্যদিকে কাগজের বুকে চিন্তার জিহাদের ময়দানে আত্মার তীক্ষèধার কলম- তলোয়ার, বুকে ঈমান নিয়ে অন্ধকারকে দূর করে যে একঝাঁক সূর্য উঠেছিলো আশির দশকে। সূর্যের বিভিন্ন রঙের মতো অথচ একটা প্রখর আলোকবর্তিকা সৃষ্টিতে উত্তাল উদ্যম সব সিপাহসালার। একটি রঙ আর একটির সঙ্গে মেলে না অথচ মিশে যায় আলোর বন্যা সৃষ্টির প্রয়াসে। সাধারণ মানুষ তার বৈষয়িক কাজের অবসরে যখন চেতনকে উন্মুক্ত করে তখন তার হৃদয় হয়ে যায় প্রেক্ষাগৃহের রূপালী পর্দা। সে দেখে, গ্রামের সবুজ বৃক্ষ, লতা, নদী, শীষভরা ক্ষেত, লতায় জড়ানো কলাপাতার বেড়া অথবা শহরের রাস্তায় কোনো ভিখারীর করুণ মুখের ভাষা অথবা নিকট অতীতে হারিয়ে যাওয়া স্বজন অথবা পিতার মৃত্যু, মায়ের ধোঁয়া মাখা রান্না, এরকম বিষয়গুলোকে অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে শব্দের গাঁথুনীতে কাগজের পৃষ্ঠায় একটা একটা করে অভূতপূর্ব অবয়ব আঁকেন কবি। এখানেই সাধারণ মানুষ থেকে কবির পার্থক্য। সেই সাধারণ মানুষ যখন কবিতা পড়ে, তখন তার চিন্তার বাজার থেকে বেসাতি কিনে থলি ভরে রাখে চিন্তনের পাত্রে। তার হৃদয়ের তারগুলো ঝঙ্কার তোলে, চিন্তার ক্ষেত্রে কর্ষণ শুরু হয়। গুণীরা ফসল ফলান, তারা সাংস্কৃতিবান হয়ে ওঠেন। নির্গুনেরাও ব্যর্থ হন না, পাথর সরতে সরতে এক সময় মাটির ক্ষেত হয়তো বের হয়ে আসে। তাই কবিতা আমাদের প্রয়োজন। সাধারণ মানুষকে কবিতামুখী করে তোলা প্রয়োজন। মানুষের কাছে কবিতাকে পৌঁছানোর দরকার, হয়তো পাথরেও একদিন ফুল ফুটবে। কবি গোলাম মোহাম্মদের কিছু কবিতায় সে বীজও লুকিয়ে আছেÑ

১. ঘুম ভেঙ্গে যায় গানে অদৃশ্যের চিল

২. নির্বাক চলে যাবার কথা ফিরে চলা এক নদী

৩. অধিকার হিজল বনের পাখি

৪. তারা মিয়া

৫. হারানো সংবাদ

৬. বঞ্চনার দৃশ্যকাব্য ঘাসফুল বেদনা

৭. কাক ও বিক্ষোভ

৮. কেন এত কষ্ট কেন এত সুখ হে সুদুর হে নৈকট্য

কবির সকল কবিতা ও গানের পরিচয় দেয়া প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। অন্যদিকে কবি যে একজন কবি এই সার্টিফিকেট দেয়ার উপরও তাঁর কবিত্ব নির্ভর করে না। তিনি পাঠকের কাছে কবি এটাই তার কবিত্বের মাপকাঠি। তিনি কবিতা লিখতে গিয়ে অলঙ্কার, অনুপ্রাস, ব্যঞ্জনা, উপমা কোথায় কিভাবে ব্যবহার করেছেন, তার কবিতার ছন্দের ভেদ, ব্যকরণ কি, বিধি-নিষেধ কতোটুকু মেনেছেন এসব নির্ণয় আমার কর্ম নয়। পণ্ডিত, বিশেষজ্ঞদের কাজ সেটা। সাধারণ পাঠক হিসেবে কবির কাছে আমার অধিকার, তাঁর কবিতায় আমি উদ্দীপ্ত হবো, আমার হৃদয় হবে আলোকিত তিনি আমার চেতনার দরজায় করাঘাত করবেন এ আমার অধিকার। আর আমার এ নিবন্ধ তারই প্রকাশ। খুবই অল্প সময় পেয়েছেন কবি গোলাম মোহাম্মদ। এরই মধ্যে তার দৃষ্টি গেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কবিতায় অপ্রচলিত অনেক আধুনিক শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন। যা খুব বেশি অগ্রসর মনের পরিচায়ক। ধারণা করি আগামী এক যুগ পরে কবিতায় যে শব্দ ব্যবহার হবে তিনি অনেক আগেই তার কবিতায় সে সব শব্দের ছান্দিক ব্যবহার করেছেন। ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘হে সুদূর হে নৈকট্য’ কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় কবি নিজের যন্ত্রণা ব্যক্ত করেছেন। কাব্যগ্রন্থটি ট্রাজেডিতে ভরপুর। কবিকে চেনার পরে এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো অন্তরে অশ্রু ঝরায়।

১.

ঘুমভরা রাত ছিলো আলোভরা দিন

এখন সে সব যেনো সুদূরের স্মৃতি

ঘুমের বড়ির খোঁজ শিখেছে মানুষ

কৃত্রিম বাঁচার জ্বালা শরীরে ভীষণ

/মাতাল নগর

২.

শুনেছি আপোস ছাড়া কবিরা বাঁচতে পারে না

আমি আর কতো আপোস করবো

/কবিরা

৩.

হে ঘুম জড়তা অবসাদ

তোমরা আমাকে নিষ্কৃতি দাও।

.......................................

তোমাদের সাথে তো আছি বিয়াল্লিশ বছর

ঘুমে অলসতায় অসতর্ক চেতনাহীন।

/হে ঘুম

৪.

আমি কোনো আবাস গড়তে পারি নাই

এখন মনে হয় ঘর মানুষকে কতোটা আশ্রয় দিতে পারে?

ছেলে মেয়েদের কোথায় রেখে যাবেন, তারো কোনো উত্তর

আমি জানি না, স্পর্ধা করে বলি ওটা আমার কাজ নয়

বিয়াল্লিশ বছর বয়সেই কবি জীবন থেকে নিষ্কৃতি চেয়েছেন। ‘হে ঘুম জড়তা অবসাদ তোমরা আমাকে নিষ্কৃতি দাও। ... তোমাদের সাথে তো আছি বিয়াল্লিশ বছর।’ তেতাল্লিশ বছরে কবি নিষ্কৃতি পেয়েছেন। কি এমন যন্ত্রণা! অভাব! ‘ছেলে মেয়েদের কোথায় রেখে যাবেন’ অথবা ‘আমি আর কতো আপোস করবো।’ এসব পঙক্তিগুলো যে চিত্র তুলে ধরে তাতে তাই মনে হয়। এরপর কবি তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছেন। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন চলে যেতে হবে, বেশ কিছু কবিতায় তা স্পষ্ট উঠে এসেছে।

১.

মৃত্যুর সাথে কাল একজন কবির বাসায় দেখা

পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আলিঙ্গন তার

এই ভাবেই মৃত্যুরা আমাদের পিছে পিছে হাঁটছে

/মৃত্যুর সাথে

২.

মৃত্যুর মোহন বাঁশি জ্বলতে জ্বলতে কবিতার

গণিতের মধ্যে মিশে গেলেন

জীবনের পরম সত্য কবির চিরকালের জানা

/রসনায় রুই মৃগেল

৩.

এখন আমি একা থাকতে পারি

একা একা বসে গুনতে পারি সময়ের সবগুলো পদশব্দ

মানুষেরা যে আসলেই একা

একা আসে একা যায়

/একা

৪.

হে আমার প্রেম! আশ্রয় ও অবকাশ

চোখ বুজলেই থেমে যায় আলোর প্রিজম

দিন রাত, রাত দিন সমতল অবসর যেনো শিল্পখণ্ড

কবি গোলাম মোহাম্মদ চিরঅবসরে চলে গেছেন। সুন্দরের সাধনায় তিনি যে সত্যের সন্ধান পেয়েছেন তার কবিতা গানে, প্রবন্ধে ও শিল্পকর্মে তা উদ্ভাসিত। এ নিবন্ধটি কোনো সমালোচনা বা আলোচনাও নয়। যদিও উন্নত বিশ্বে সমালোচনা সাহিত্যকর্ম হিসেবে উচ্চমর্যাদায় অধিষ্ঠিত। সমালোচনা আলোচনার উৎপত্তিস্থল হচ্ছে মস্তিস্ক। যেখানে যুক্তি কাজ করে। যদিও কবিত্ব বিষয়টি যুক্তি নির্ভর নয়, আত্মা নির্ভর। যদিও যুক্তি নির্ভর কবিতা আছে, কবিত্ব আছে। তাতে মানবতার সাক্ষাৎ যদিও মেলে তা হৃদয়স্পর্শ করে কম। আত্মানির্ভর কবিতাই মানবত্মার কল্যাণের কথা বলে, এখানে যুক্তি, দর্শন, বিজ্ঞান পরাভুত। এখানে জয়ী শুধুই মানবতা। গোলাম মোহাম্মদ মানবতার কবি। তার সৃষ্টি সদকায়ে জারিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক আর তাতে এক আল্লাহতে বিশ্বাসীদের ভূমিকা থাকলে তারাও সওয়াবের অধিকারী হবেন বলে আশা করা যায়।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।