রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ


২৪ অক্টোবর ২০২৫ ১০:০৯

॥ ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ ॥
মানবিক মূল্যবোধের কারণেই মানুষ শ্রেষ্ঠ। পশু এবং মানুষের মাঝে মৌলিক কতগুলো মিল-অমিল রয়েছে। এসকল বৈশিষ্ট্যই মানুষকে পশু থেকে উচ্চতর স্থানে সম্মানিত করেছে। মিলের বিষয়গুলো হচ্ছে- ক্ষুধা পেলে মানুষও খায়, পশুও খায়। পরিশ্রান্ত হলে মানুষও বিশ্রাম চায়, পশুও চায়। বয়ঃপ্রাপ্ত হলে মানুষও জৈবিক চাহিদা মিটাতে চায়, জীবন মাত্রই এ বৈশিষ্ট্যের ধারক। এসকল কাজে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য হচ্ছে বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে। পশুরা যা তা ইচ্ছেমতো খেতে পারে। হালাল-হারামের কোনো বালাই নেই। অবশ্য রুচির বাছবিচার আছে। মানুষ শুধু রুচি নয়, তাকে হালাল-হারাম কিংবা বৈধ-অবৈধের চিন্তা করতে হয়। পশুর বিশ্রামের কোনো সময় কিংবা নিয়ম নেই। সুযোগ পেলেই যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু মানুষ পারে না। অপরিচ্ছন্ন স্থানে নামাজের নির্ধারিত সময়ে তারা বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারে না। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়াই পশুর মিলনের শর্ত। স্থান-কাল-পাত্র তাদের কাছে কোনো বিষয় না। কিন্তু মানুষ তা পারে না। মানুষের জন্য স্থান-কাল-পাত্রের নির্ধারিত প্রোফর্মা আছে। বৈধ-অবৈধের প্রশ্নের কাছে মানুষকে জবাবদিহি করতে হয়। এ জবাবদিহির প্রধান বিচারক হচ্ছে বিবেক। এই বিবেকই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদালত। বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা নিয়ে যিনি যত বেশি সতর্কভাবে চলতে পারেন, তিনি তত ভালো মানুষ হিসেবে পরিগণিত হতে পারেন। বিবেকই মানুষের মূল্যবোধ এবং পরিশুদ্ধ সংস্কৃতির উদ্ভাবক। বিবেক আছে বলেই মানুষ সত্যের কাছে মাথা নত করে। বিবেক আছে বলেই মানুষ স্রষ্টার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। বিবেক আছে বলেই মানুষ সুন্দর সমাজ গঠনে উৎসাহী হয়।
রাজনীতি শুধু ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে হতে পারে না। রাজনীতি সমাজকে উন্নতির দিকে, জাতিকে সম্মানের দিকে নিয়ে যায়। না পারলে সে রাজনীত আসলে রাজনীতি হয় না। সেটাও সন্ত্রাসের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। পেশিশক্তি এবং মিথ্যাচারের রাজনীতি বৃদ্ধি পেয়ে পাশবিক পর্যায়কে অতিক্রম করার মতো ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে সমাজে। নৈতিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পেয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, আমরা একে অপরের প্রতি কল্যাণকামী না হয়ে বিনাশকামীতে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি এবং অন্যায় করে পৈশাচিক উল্লাস প্রকাশ করার ভয়াবহ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোনো অপরাধই অপরাধ বলে গণ্য হচ্ছে না। অন্যায় কাজের প্রতি ঘৃণা ও অন্যায় করলে লজ্জিত হবার প্রবণতাও সমাজ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। যারা সমাজের নেতৃত্বের আসন অলংকৃত করে আছেন তারা মিথ্যা অহমিকায় মেকি চাকচিক্যের মাঝে রাজনৈতিক মিথ্যাচার ও ধোঁকাবাজি করে জনগণের রক্ত শোষণ করছে। যারা জ্ঞানের অলংকার নিয়ে সবজান্তার ভাব করে আছেন, তাদের মাঝে সত্যিকার অর্থেই জ্ঞান বলতে কিছুই নেই। ফলে সমাজে আজ দুর্বৃত্তায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে যা নয় তাই সাজতে চায়। এ যেন চোরের হাতে গৃহ পাহারার ঠিকা দেয়া। নিম্ন শ্রেণির অযোগ্য লোকেরাই সমাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে বসতে চায়। ফলে হাজার বছর পূর্বের সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের অসভ্য সমাজ ব্যবস্থা পুনরায় যেন আমাদের কাঁধে এসে ভর করেছে। যে রাজনীতি রাজনৈতিক কর্মীকে ঘাতক হতে শেখায়, যে রাজনীতি মানুষের মধ্যে থেকে মনুষ্যত্ব কেড়ে নেয়, তার হৃদয়বৃত্তিকে পাষাণে পরিণত করে, সেই রাজনীতিকে ধিক্কার জানাতে হবে। সেই রাজনীতিকে না বলতে হবে। বলতে হবে- সেই রাজনীতি চাই, যা মানবতার কথা বলে, মানুষের কথা বলে, ন্যায়বিচারের কথা বলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিচারের কথা বলে। স্বপ্ন দেখায় সত্যিকার মানুষ হবার।
আমাদের সমাজ এবং সমাজব্যবস্থা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন পাগলা ঘোড়ার মতো। এমন কোনো অপরাধ নেই যেটা আমাদের বর্তমান সমাজে ঘটে না। খুন, অপহরণ, ধর্ষণের পর হত্যা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ বলতে গেলে প্রায় সব ধরনের অপরাধই ঘটছে। আর নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে মানুষ হিংস্র ও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আইন আদালত সবকিছুকেই অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র চলমান। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে পড়েছে অনেকেই। রাজনীতি যেন অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে সন্ত্রাসীরা মানুষ মেরে ফেলছে আর সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে অন্য অনেক মানুষ। এমনকি পুলিশের সামনে হত্যাকাণ্ড চালানোর পরও পুলিশ নিরব দর্শক। ফ্যাসিবাদী শাসনামল থেকে সহিংসতার ক্রমাগত নৃশংস ঘটনা নাগরিক ও মানুষ হিসেবে আমাদের দারুণভাবে শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন ও বিধ্বস্ত করে তোলে। দুর্বৃত্তরা যখন নায়কের বেশে আবির্ভূত হয়, অসৎ-লুটেরা অযোগ্য লোক যখন ইতিহাসের অংশ হয়, গণতন্ত্রের সম্ভাবনা তখন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। সভ্যতা-মানবতা তখন বিপন্ন হয়। আইনের শাসন, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হয়। তাই তো সাত বছরের শিশু সায়মারাও নিস্তার পায় না দাঁতাল শুয়োর আর হায়েনাদের হাত থেকে।
সবশ্রেণির মানুষের মুখে আজ একই কথা। জুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন ফ্যাকাসে হতে চলেছে। ন্যায্যতার মানদণ্ড যেন দারুণ সংকটের মুখোমুখি। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা সকলের মধ্যে। একের পর এক খুন হচ্ছে মানুষ। পারিবারিক কলহে স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের শিকার হচ্ছেন। ব্যক্তিস্বার্থ আর দ্বন্দ্বে সহোদর, নিকটাত্মীয়, বন্ধু, বান্ধবকেও খুন করা হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণ কিংবা সন্ত্রাসী ঘটনায়ও মানুষ খুন হচ্ছে। প্রতিনিয়তই পত্রিকার পাতা খুললেই দলীয় কোন্দলের শিকার হয়ে খুনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতার কারণে জীবনে বাড়ছে হতাশা, মানসিক বিষণ্নতা, আর্থিক দৈন্য। ফলে সমাজে বেড়েই চলছে অপরাধ। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে শিশুসন্তানরাও। পারিবারিক কলহ, রাজনৈতিক বিরোধ, পরকীয়া, ছিনতাইকারীর আক্রমণ ও পেশাদার অপরাধী গ্রুপের অভয়ারণ্য ঠেকানো যাচ্ছে না।
সভ্যতার বিকাশ এবং মানবসমাজ গঠনে বিশেষ প্রভাব রয়েছে নারী-পুরুষের সম্পর্কের। সমাজে বিয়ে প্রথা চালু হওয়ার পর কেবলমাত্র স্বামী-স্ত্রীর মিলনকেই বৈধতা দেওয়া হয়। এর বাইরের অন্যসব সম্পর্কই অনৈতিক বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে পরকীয়া যেনো মহামারি রূপ নিতে যাচ্ছে। চীন দেশে নিকটাত্মীয়র মধ্যে বিয়ে আইনত নিষিদ্ধ। আধুনিক সভ্য সমাজে অনৈতিক সম্পর্ক রোধের জন্য আইনকানুনও চালু রয়েছে বিভিন্ন দেশে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে এবং চীন দেশে পর্নো আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ওইসব দেশে অনৈতিক সম্পর্ক বা ধর্ষণের মতো ঘটনার খবর খুব একটা পাওয়া যায় না। মুক্ত মেলামেশার সমর্থকরা বলতে পারেন, সৌদি আরবে আইনকানুন ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশে চলে। কিন্তু আধুনিক চীন, সেখানে তো ধর্মের বিষয় নেই সেখানেও অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে রয়েছে কঠোর আইন। আমাদের দেশে নারীবাদীরা ইনিয়ে-বিনিয়ে অবৈধ প্রেম বা অনৈতিক সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে চাইছেন। নারীবাদীরা পুরুষবিদ্বেষী হয়ে নারীর অপরাধ আড়াল করে সমস্ত অপরাধের জন্য পুরুষকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর
অপচেষ্টায় সচেষ্ট থাকেন। ধর্ষণ নিয়ে দেশব্যাপী হুলস্থুল হচ্ছে অথচ সম-অপরাধ অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে কেউ কোনো ধরনের প্রশ্ন তুলছেন না। আসলে ধর্ষণ আর অনৈতিক সম্পর্ক দুটিই একই সমস্যার এপিঠ-ওপিঠ। ধর্ষণে অপরাধী একজন আর অনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টিতে অপরাধী উভয়েই। ধর্ষণ বলপূর্বক আর অনৈতিক সম্পর্ক স্বেচ্ছায়। দুটিতে আসলে মৌলিক কোনো তফাৎ নেই। দুটি সমস্যাকে একই দৃষ্টিতে দেখতে হবে এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে যুগপৎভাবে। অমুসলিম দেশগুলোর মতো আমাদের ভোগবাদী সমাজে এক ধরনের প্রবণতা প্রবলতর হয়েছে। অমুসলিম দেশগুলোর সমাজব্যবস্থায় নর-নারী অবাধ মেলামেশা কেন্দ্র করে যে অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে তাতে ওসব দেশে পরিবার ব্যবস্থায় ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। সামাজিক জীবনে নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে, মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে সামাজিক বন্ধন। আমরাও যেন তাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানের উন্নততর তথ্য প্রযুক্তির অপপ্রয়োগই এর অন্যতম কারণ বলা চলে। পর্নোগ্রাফির করাল গ্রাসে নিপতিত আজকের সমাজ। মা মেয়েদের নিয়ে টিভির পর্দায় এমনসব ছবি দেখছেন, যাতে এক পুরুষ একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক করছে, আবার এক নারী একাধিক পুরুষাঙ্গে তৃপ্তি ভোগ করছে। এসব সরকারি সেন্সরপ্রাপ্ত ছবি পুরোপুরি পর্নো না হলেও সমাজের জন্য সত্যিই ক্ষতিকর। পর্নোর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বিশ্বের সর্বাধিক পর্নোর ব্যবস্থা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব পর্নো এবং টিভি সিরিয়ালের পাশ্চাত্যমুখী প্রভাব পড়ছে আজকের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ের ওপর; বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহে নানা প্রোগ্রামের মধ্যে প্রায় সবকিছুই পাওয়া সম্ভব। এদিকে কম্পিউটার মোবাইল তো আজ নব প্রজন্মের ছেলেমেয়ের হাতে হাতে। ফলে সহজ মেলামেশার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে নারী-পুরুষের মধ্যে।
পাশ্চাত্যের অনুকরণে ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ সাংস্কৃতিক অধপতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী। সমাজে চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সামাজিক অবক্ষয়, কালো টাকা ইত্যাদি নিয়ে নানাজন নানাভাবে কথা বলছেন; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ ধরনের নৈতিক মূল্যবোধের সমস্যায় পরিবারগুলো ভাঙতে ভাঙতে একদিন সমাজটাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আর সে কারণেই অনৈতিক সম্পর্কের সূত্র ও উৎস গভীরভাবে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা মানুষ জন্মগত ভাবে ‘মানুষ’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও ‘মনুষ্যত্ব’ অর্জন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। মনুষ্যত্ববোধ, মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মনুষ্যত্বের কার্যকর উপস্থিতির মধ্যেই মানুষ এর প্রকাশ। প্রতিদিনের ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ব্যবহার, হাসি-রহস্য, একটুখানি সহায়তা, একটু স্নেহের বাক্য, অসহায়ের প্রতি একটুখানি দয়া প্রদর্শন, একটুখানি নম্রতা, একটুখানি সৌজন্যতাই মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়। মিডিয়াই বিকাশমান সংস্কৃতির বাহক। মিডিয়াকে তাই এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। পাল্টাতে হবে আমাদের নষ্ট কালচার। প্রতিষ্ঠা করতে হবে মূল্যবোধের রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।