জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য গণভোট অপরিহার্য
২৩ অক্টোবর ২০২৫ ২০:৩৮
গত ১৭ অক্টোবর শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় একটি সরকারি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যবৃন্দ এবং ২৪টি রাজনৈতিক দলের ২ জন করে প্রতিনিধি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেন। গণফোরাম নামক একটি দল ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে হাজির থাকলেও তারা সই করেনি। তাদের দাবি ছিল, সংবিধান থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে তারা সই করা থেকে বিরতে রয়েছে। কিন্তু জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানেই জানা গেল, সনদ থেকে ৭১-এর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়া হয়নি। এটা শুনে গত ১৯ অক্টোবর রোববার গণফোরাম সনদে স্বাক্ষর করে। ৪টি বাম দল এবং এনসিপি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করে এবং স্বাক্ষরদানে বিরত থাকে। ৪টি বাম দল যে কারণে স্বাক্ষর করেনি এনসিপির স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠান শুরুর নির্ধারিত সময় ছিলো বিকেল ৩টায়। কিন্তু দুপুর ১২টা থেকে জুলাইযোদ্ধা নামে কয়েকশত লোক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের সামনেই প্রতিবাদ করে। তারা পাচিল টপকে ভেতরে প্রবেশ করে এবং যেখানে অতিথিদের বসার জন্য যে চেয়ারপাতা হয়েছিল, সেখানে তারা বসে পড়ে। এরপর পুলিশ আসে এবং তাদের পিটিয়ে বের করে দেয়। অনুষ্ঠানস্থল থেকে বেরিয়ে এসে মানিক মিয়া এভিনিউতে তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। সেখান থেকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ তাদের ধাওয়া দেয়। এ পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ইটপাটকেল ছোড়ে এবং রাস্তায় কয়েক স্থানে আগুন জ¦ালায়। কয়েকটি পত্রিকায় এমন রিপোর্টও করা হয়েছে যে, বিক্ষোভকারীরা নাকি ৩-৪টি ককটেলেরও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
প্রায় সমস্ত পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট করেছে যে, বিক্ষোভ করেছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারা নিজ নামে না এসে জুলাইযোদ্ধা নামে এসেছিল। আসলে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আহত জুলাইযোদ্ধাকেও দেখা যায়। আতিক নামে এক আহত জুলাইযোদ্ধা বিপ্লব বা অভ্যুত্থানকালে পুলিশের গুলিতে তার একটি হাত হারায়। হাতের একটি অংশ কেটে ফেলা হয়। ওই অংশটি প্লাস্টিকের কৃত্রিম হাত দিয়ে জোড়া লাগানো হয়। ঐ দিন অর্থাৎ ১৭ অক্টোবর পুলিশের লাঠির আঘাতে তার হাতের প্লাস্টিকের অংশটি খুলে পড়ে যায়। তারপরও পুলিশের লাঠির আঘাত খাওয়ার পর সে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘জুলাই বিপ্লবে একটি হাত হারিয়েছি। আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হলে আরেকটি হাতও হারাতে রাজি আছি’। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কোনো অনুপ্রবেশকারী ছিল কিনা, সেটি তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। তবে বিক্ষোভটি যে ছিল এনসিপির, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
এনসিপির এ বিক্ষোভ নিয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কেউ বলছেন, জুলাই সনদ একটি ঐতিহাসিক ব্যাপার। এ অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা ঠিক হয়নি। কিন্তু অপর পক্ষ বলছেন, তাদের বিক্ষোভ করা সঠিক হয়েছে। তাদের কথা হলো, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর এনসিপি একতরফা ভাবে শহীদ মিনার থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদ ঘোষণা করতে চেয়েছিলো। ৩১ জুলাই সন্ধ্যায় তাদের এ ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তার ২ ঘণ্টা আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ঘোষণা দেন যে, প্রধান উপদেষ্টা নিজেই এ ঘোষণা দেবেন। তাই ছাত্রদের একতরফাভাবে কোনো কিছু করার দরকার নেই। তখন একটি ধারণা দেওয়া হয় যে, মার্চ মাসের মধ্যেই সরকারি সনদ আসবে। এরপরে মার্চ থেকে আবার সরকার সরে যায়। তারা বলে যে, জুলাই মাসে সনদ ঘোষিত হবে।
জুলাই মাসও পার হয়ে যায়। কিন্তু সরকারি ঘোষণার দেখা নেই। তার পরিবর্তে চলতি বছরের ৫ আগস্ট সরকারের তরফ থেকে প্রধান উপদেষ্টা মানিক মিয়া এভিনিউতে ২৮ দফা সংবলিত জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এনসিপি নেতারা দাবি করেন যে, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকার তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। কারণ ৫ আগস্ট ঘোষণার আগে তাদের সরকার ঘোষণাপত্রের যে খসড়া দেখিয়েছিলো বাস্তবে দেখা গেলো যে অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস কর্তৃক পঠিত ঘোষণার সাথে তাদের দেখানো ঘোষণার খসড়ার কোনো মিল নেই। এভাবে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকার জুলাই বিপ্লবের সাথে প্রতারণা করেছে।
কারণ জুলাই ঘোষণাপত্রের ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, যেহেতু জনগণের দাবি অনুযায়ী অবৈধ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের আলোকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তাই ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার একটি সাংবিধানিক সরকার।
অথচ এ ঘোষণাটি সঠিক নয়। কারণ ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে গঠিত হয়নি। এটি গঠিত হয়েছে একটি বিপ্লবের মাধ্যমে। বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান সর্বোচ্চ সংবিধান। অর্থাৎ সংবিধানের ওপরে সংবিধান। জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে।
এ নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে। ৮৪টি সুপারিশ নিয়ে জুলাই সনদ প্রণীত হয়েছে। তার মধ্যে ৪৭টি সুপারিশেই রয়েছে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি। যে ২৪টি দল জুলাই সনদ স্বাক্ষর করলো, তারা কি ঐ নোট অব ডিসেন্ট সংবলিত ৪৭টি সুপারিশকেও মেনে নিলো? তা তো নয়। কারণ জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য ইসলামী দল এবং জাগপা ঐসব নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি; বিশেষ করে বিএনপির নোট অব ডিসেন্টের সাথে একমত নয়।
বলা হয়েছে যে, জুলাই সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। কীভাবে হবে? তার তো কোনো পথনির্দেশ নেই। ঐ ৪৭টি নোট অব ডিসেন্টও কি সংবিধানের অংশ হবে? নোট অব ডিসেন্ট তো কোনোদিন সংবিধানের অংশ হয় না।
বলা হয়েছে যে, সংবিধানের অংশ করতে অর্থাৎ জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে সকল দল গণভোটে রাজি হয়েছে। সেই গণভোটটি কবে হবে? জুলাই সনদে যারা স্বাক্ষর করলেন, তারা নিজেরাও কি জানেন যে কবে গণভোট হবে? নির্বাচনের আগে? নাকি নির্বাচনের দিন? বিএনপি তো চায় নির্বাচন ও গণভোট একসাথে হোক। জামায়াত এবং অন্য ৭টি দল নির্বাচনের আগেই গণভোট চায়। গণভোটের মাধ্যমে যে জুলাই সনদটি বেরিয়ে আসবে, সেই সনদের ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, বর্তমান সংবিধানের অধীনে নয়।
এনসিপি এবং জামায়াতসহ অন্যান্য দল দাবি করেছে যে, সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য একটি প্রভিশনাল সাংবিধানিক ফরমান জারি করা হোক। বিএনপি এর ঘোরতর বিরোধিতা করেছে। বলেছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক ফরমান জারির কোনো ক্ষমতা নেই।
যদিও এনসিপির মূল দাবি হলো, বর্তমান সংবিধান বাতিল এবং নতুন সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠন। বিএনপি তাতে রাজি নয়। সেক্ষেত্রে এনসিপি বলেছে যে, আগামীতে যে সংসদ গঠিত হতে যাচ্ছে, সেই সংসদের থাকবে দ্বৈত ভূমিকা। প্রথম কয়েক মাস তারা গণভোটের রায়ের ভিত্তিতে সংবিধানের সংশোধন করবে। সংবিধান প্রণয়ন বা সংশোধন কমপ্লিট হয়ে গেলে সেটি রেগুলার সংসদ হিসেবে কাজ করবে। এ সম্পর্কেও কোনো কথা স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে নেই।
এনসিপির আরো দাবি হলো, সাংবিধানিক ভিত্তি দিতে গিয়ে যদি বিশেষ ফরমান (বর্তমানে বলা হচ্ছে স্পেশাল অর্ডার) জারি করতে হয়, তাহলে সেটি করবেন প্রধান উপদেষ্টা, প্রেসিডেন্ট নয়। কারণ প্রধান উপদেষ্টা হলেন জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার চয়েস। প্রেসিডেন্ট চুপ্পু হলেন বিতাড়িত আওয়ামী লীগ সরকারের নমিনী।
গত ২০ অক্টোবর সোমবার প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রে একটি খবর বেরিয়েছে যে, স্বাক্ষরিত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একটি বিশেষ আদেশ (বিশেষ ফরমান) প্রণয়ন করছে। এ আদেশের ভিত্তিতেই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। ঐ খবরে আরো বলা হয়েছে যে, ঐ বিশেষ আদেশে আগামী নির্বাচনে গঠিতব্য সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা দেওয়া হবে। একটি হলো জুলাই সনদ মোতাবেক সাংবিধানিক সংশোধন এবং অন্যটি হলো নিয়মিত সংসদ হিসেবে কাজ করা। ঐকমত্য কমিশন এটা নিয়ে ৬ জন সংবিধান বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ-আলোচনা করছেন। এ আলাপ-আলোচনার উদ্দেশ্য হলো ঐ বিশেষ আদেশের খসড়া বা ভিত্তি রচনা করা। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক ঐ বিশেষ আদেশটি এমনভাবে প্রণীত হবে, যেটি জুলাই বিপ্লব থেকে উদ্ভূত জনগণের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটাবে।
যেসব বিশেষজ্ঞের সাথে ঐকমত্য কমিশন আলাপ-আলোচনা করছেন, তারা হলেনÑ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন, সাবেক বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্টের এডভোকেট ড. শরীফ মিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ একরামুল হক, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক এবং ব্যারিস্টার তামিম হোসেন।
গত বৃহস্পতিবারের মধ্যেই বিশেষ আদেশের পূর্ণাঙ্গ খসড়া প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেওয়ার কথা। আগামী সংসদকে Constituent Power বা সাংবিধানিক ক্ষমতা দেওয়া হবে। সেই ক্ষমতা বলে গণভোটে প্রদত্ত রায় মোতাবেক তারা সংবিধান সংস্কার করবেন।
ওপরের এ আলোচনা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বিশেষজ্ঞ কমিটিও মনে করেন না যে, ড. ইউনূসের সরকার সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক একটি সাংবিধানিক সরকার। বরং এক্ষেত্রে তারা জামায়াত এবং এনসিপির মতামতকেই সমর্থন করেন যে, এ সরকার জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
সুতরাং এ সরকারের সাংবিধানিক ফরমান বা আদেশ জারির ক্ষমতা রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা তাদের অবস্থান মারফত সেই ক্ষমতার কথাই বার বার বলছে।
Email:[email protected]