জুলাইযোদ্ধা ও সনদের স্বীকৃতি গণভোটের মাধ্যমেই দিতে হবে

একেএম রফিকুন্নবী
২৩ অক্টোবর ২০২৫ ২০:০১

দীর্ঘ ৫৪ বছরের জমে থাকা ক্ষোভ ও চাওয়া-পাওয়ার অসঙ্গতিতে দেশের ছাত্র-জনতা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের সুযোগে জুলাই ২৪-এর এক দফার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হাসিনার সাম্রাজ্যের পতন হয়। দেশ থেকে পালিয়ে জীবন রক্ষা করে। হাজার হাজার মানুষ হাসিনার কারাগার থেকে মুক্ত হয়। আয়নাঘরের নির্যাতন থেকেও দীর্ঘদিন আটক থেকে বের হয়। খোলা আকাশের নিচে তাদের নির্যাতনের বর্ণনা দেয়। দেশের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যায়! নিরপরাধ মানুষকে এভাবে নির্যাতন করতে পারে। দেশ-বিদেশের অনুসন্ধানে নির্যাতনের ভয়াবহ অবস্থা উঠে আসে। জাতিসংঘে বিষয়গুলো স্থান পায়।
গুম কমিশনের রিপোর্ট প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকাশ পেয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাও গুমের কাহিনী ও আয়নাঘরের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যেই সামরিক বাহিনীর প্রায় ৩০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। বিচারের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে জুলাইযোদ্ধাদের এখন পর্যন্ত তালিকা হয়নি সরকারিভাবে। আহতরা এখনো হাত-পা-চোখের চিকিৎসার অভাবে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। জনতার জোর দাবি- নিহত ও আহতদের তালিকা করে তাদের শহীদি মর্যাদা দেয়া এবং আহতদের দেশে-বিদেশে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা দেয়া।
কয়েকদিন পূর্বে সরকার ঘটা করে মানিক মিয়া এভিনিউতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বৃষ্টির মধ্যেই খোলা জায়গায় দেশের বড়-ছোট প্রায় ২৫টি দল ও বিভিন্ন মতের লোকদের সমাবেশে প্রধান উপদেষ্টা হাস্যোজ্জ্বলভাবে জুলাই সনদের চূড়ান্ত কপি পড়ে শোনান এবং দলগুলোর প্রতিনিধিরা সনদে স্বাক্ষর করেন। বড় দল বিএনপি ও জামায়াত নেতারা স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ছিলেন। এনসিপি নেতারা উপস্থিত ছিলেন না। শুধু তাই নয়, প্রোগ্রাম শুরুর আগেই এনসিপি ও জুলাইযোদ্ধা নামে ব্যানার নিয়ে দক্ষিণ প্লাজা দখলে নেয়। নানা স্লোগানে এলাকা তোলপাড় করে ফেলে। পুলিশ এসে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়, টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। আহত হয় শতাধিক। একজন জুলাইযোদ্ধার কৃত্রিম হাত খুলে যায়। সড়কে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান তো বলেই বসেছেন, জুলাইযোদ্ধাদের মারধর করা একটি বড় লজ্জার ব্যাপার। জুলাইযোদ্ধাদের বদৌলতে আজ আমরা স্বাধীনভাবে চলতে-ফিরতে, মুক্ত রাজনীতি করতে পারছি, উপদেষ্টা হয়েছে, জুলাই সনদ ও তার আইনগত স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তাই জুলাই না ঘটলে আজ আমরা সনদ অনুষ্ঠান করতে পারতাম না। জুলাই সনদের আলোকে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হলেই কেবল জুলাই বিপ্লবের সার্থক পরিসমাপ্তি ঘটবে।
বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন জুলাইযোদ্ধাদের বলেই বসলেন, সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় যারা বিক্ষোভ করেছে তারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য। যারা ব্যাংক লুটেরা, এস আলম গ্রুপের পেইড ব্যক্তি দীর্ঘদিন ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, আবার জুলাই বিপ্লবে যাদের কোনো অবদান নেই বা জুলাই বিপ্লব না হলে দেশেও আসতে পারতো না, তাদের মুখে জুলাই বিপ্লবের লোকদের আওয়ামী ট্যাগ দেয়া খুবই অপ্রত্যাশিত। বিএনপি মহাসচিব তো বিপ্লবের কয়েকদিন পূর্বে বলেই ফেলেন, তারা ছাত্রদের আন্দোলনের সাথে নেই। এখন তারাই বড় দেশদরদির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নির্বাচন নির্বাচন জিগির তুলছে। তারা ইতোমধ্যেই নোয়াখালীতে মসজিদে গিয়ে কুরআনের অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করেছে এবং করছে। ক্ষমতার লোভ তাদের পেয়ে বসেছে। নির্বাচনে আসুন, দেখবেন কত ধানে কত চাল।
আমরা দেশ চালানোর জন্য অবশ্যই নির্বাচিত প্রতিনিধি চাই। তবে হাসিনা মার্কা নির্বাচন চাই না। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৬টি আসনে জয়লাভ করে আবার মহিলা কোটায় এমপি নিয়ে হাসিনার নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছিল। মূলত বিএনপি আর শহীদ জিয়ার বা বেগম জিয়ার বিএনপি নেই। নেই ছাত্রদলের বাঘা বাঘা সভাপতিদের প্রাধান্য। ছাত্রদলের সভাপতি ছিল তাদের কয়েকজনের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক আছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার জেল খেটেছি তাদের সাথে। আমরা বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে গড়তে চাই সব দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে নিয়েই। জনগণ যাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাবে, তারা দেশ চালাবে। আবার যারা বিরোধীদলে থাকবে, তাদের নিয়েই দেশ চালাতে হবে। আমরা কোনো দেশের প্রভুত্ব মেনে চলতে চাই না। দুনিয়ার সব দেশের সাথে আমাদের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক থাকবে। থাকবে ব্যবসা-বাণিজ্য। যেহেতু বাংলাদেশের জনসম্পদ রয়েছে। তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে গোটা দুনিয়ায় পাঠাতে চাই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য। তাদের আমরা র‌্যামিটযোদ্ধার আসনে বসাতে চাই, দেশের সুযোগ-সুবিধা তাদের প্রয়োজনে দিতে চাই।
আমাদের গর্ব জুলাই ২৪। ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে পালাতে বাধ্য করে। আমরা ছাত্র-জনতা এক চিন্তা-ভাবনায় দেশ গড়তে চাই। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের পাশের ছোট দেশ মালদ্বীপের মইজ্জু সাহেব ভারতবিরোধিতা করেই নির্বাচনে জিতেছে। আবার ভারতীয় সৈন্য তাড়িয়ে দিয়েছে। দেশ গড়ার কাজ জুলাই বিপ্লবের ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা হলো আমাদের সন্তান। আমাদের আগামী দিনের রাষ্ট্র পরিচালনার কর্ণধার।
ছাত্র-ছাত্রীরা ইতোমধ্যেই দেশের প্রধান ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি আনন্দঘন পরিবেশে ভোট দিয়ে দেশের শিক্ষিত, দুর্নীতিমুক্ত ছাত্র প্রতিনিধি বাছাই করেছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে। যারা গত বছরগুলোয় ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্বাচনের জাঁতাকলে পরীক্ষায় দেশদরদি। শহীদ হওয়া, গুম হওয়া, জেলে যাওয়া থেকে শুরু করে হাসিনার গুণ্ডা ছাত্রলীগ, তাদের নিয়োজিত আমলা পুলিশের জাঁতাকলে পড়েছে, ছাত্রজীবন শেষ হয়ে গেছে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, চোখ হারিয়েছে, পা হারিয়েছে, তারাও কিন্তু ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হয়েছে। এ প্যানেলে দেশের প্রতি আনুগত্যশীল মুসলিম, হিন্দু, পাহাড়ি সব গোত্রের ছাত্র-ছাত্রীর সমন্বয়ে প্যানেল ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শুরু করে নির্বাচনে সহযোগী দেশের সব লোকের সহযোগিতায় আনন্দঘন উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন করে একদিকে দেশের আপামর জনতার প্রশংসায় ভাসছে; অন্যদিকে বিজয়ী প্যানেল ছাত্র-ছাত্রীরা যোগ্য নেতৃত্বের পরিচয় দিয়ে ক্যাম্পাসে লেখাপড়ার পরিবেশে আমূল পরিবর্তন এনেছে কয়েকদিনের মধ্যেই। ছাত্র-ছাত্রীদের খাবারের মান, সহজে ক্যাম্পাসে যাতায়াত, লেখাপড়ার মানোন্নয়ন, হল দখল, রুম দখল নীতির অবসান; এমনকি শিক্ষার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে।
দেশের মানুষ, অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীসহ সবাই আনন্দিত হয়েছে। এমন নেতৃত্বই তারা আশা করেছিল, এদেশের ১৮ কোটি মানুষ। এ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রধান সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। যাদের জন্ম হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে ১৯৭৭ সালে। জন্ম থেকেই এ সংগঠনের সাথে আমার জড়িত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে। ডাকসু, জাকসু, চাকসু, রাকসুতে ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেলের অচিন্তনীয় বিজয় এদেশের দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে যে, ফ্যাসিস্ট, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন ও দেশ গড়া সম্ভব। মহান আল্লাহ তায়ালা দীর্ঘ ৫৪ বছরের জঞ্জাল যেমন ৫ আগস্ট ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন আর তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রশিবিরের সৎ, যোগ্য, মেধাবীদের সমন্বয়ে গঠিত প্যানেলকে বিজয় দান করেছেন। দেশের অন্যান্য দলের ছাত্র সংগঠনের কোনো প্যানেল বা ব্যক্তি ছাত্রশিবিরের কাছেও আসতে পারেনি।
তাই এদেশের মানুষ বহু রক্ত দিয়ে নির্যাতিত হয়েছে, জেল খেটেছে, আয়নাঘরে গেছে আর এখন ছাত্রশিবিরের বিপুল বিজয়ে জনগণের আস্থা এসেছে যে, জামায়াত-সমর্থিত প্রার্থীরাই আগামী জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে দেশ-জাতিকে যোগ্য নেতৃত্ব উপহার দিতে সক্ষম হবে, ইনশাআল্লাহ। মুরুব্বি সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যেই জুলাই বিপ্লবের অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে জোট গঠন করে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। তারা দেশের ৩০০ আসনেই যোগ্য মেধাবী শিক্ষিত দুর্নীতিমুক্ত প্রার্থী ঘোষণা করেছে। আর জামায়াত এ ঘোষণাও দিয়েছে যে, জোটের জন্য তারা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সিট ছেড়ে দেবে।
কয়েকদিন পূর্বে জামায়াত ৮ দল নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিয়েছে, জুলাই সনদের সাংবিধানিক রূপ দেয়ার জন্য জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে গণভোট দিয়ে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবকে প্রাতিষ্ঠানিক আইনগত রূপ দিতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের জন্য প্রাপ্ত ভোটে সংখ্যানুপাতিক সংসদ সদস্য নির্বাচন দিতে হবে। জুলাই বিপ্লবের সাথে ছাত্র-জনতা, পুরুষ-মহিলারা অংশগ্রহণ করেছিল, তারাসহ ইসলামী দলগুলো একসাথে মাঠে নামলে ভারতীয় আধিপত্যদের কোনো খাওয়া থাকবে না, যা ছাত্রদের নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আমরা বলতে চাই, স্বল্প সময়ের জন্য আপনারা জাতীয় প্রয়োজনে এসেছেন। তাই জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন জুলাই বিপ্লবকে স্বীকৃতি হিসেবে অনতিবিলম্বে জনতার রায় নেয়ার জন্য গণভোটের আয়োজন করুন।
জুলাই বিপ্লবের অংশগ্রহণকারী সব দল ও মতের সমন্বয় করেই আমরা জাতীয় নির্বাচনে যেতে চাই। কোনো দলের একক সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিতে চাই না। সবার ঐক্য চাই দেশের জন্য, জাতির উন্নয়নের জন্য। কেউ সরকারি দলে যাবেন, কেউবা বিরোধীদলে যাবেন। সবাই আমাদের দেশের ভালো চাই। সবার মতামতের ভিত্তিতেই কমন ইস্যুতে একমত হতে চাই। দেশ বাঁচলে, দেশের উন্নয়ন হলে আমাদের সবার ভালো হবে। পরবর্তী বংশধরদের আমরা একটি উন্নত স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি উপহার দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে চাই। দুনিয়ায় শান্তি চাই, আখিরাতের কল্যাণ চাই।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল : [email protected]