রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব : লাভ-ক্ষতি


২৯ মে ২০২৫ ১১:২৬

॥ প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী ॥
আমাদের দেশের রাজনীতি দুটি ধারায় বিভক্ত। এক. আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় ১৪ দলীয় জোট, যারা ভারতের সমর্থনপুষ্ট। দুই. বিএনপির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ২০ দলীয় জোট। একটু পেছন ফিরে দেখা যাক, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ সরকার গঠন করে। খন্দকার মোশতাকের সরকার আওয়ামী লীগের নীতি ও আদর্শ থেকে ফিরে আসে। আওয়ামী লীগের পক্ষে সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করলে সিপাহি-জনতা সেই অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে জিয়াউর রহমানকে সামনে নিয়ে আসেন। আওয়ামী লীগ সরকার ভারতপন্থী হলেও এ দেশের ছাত্র-জনতা কখনোই ভারতপন্থী নয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি, তারা দেশের বা আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে কোনো তৎপরতা না চালানোর কারণে নিজেদের ও দেশের স্বার্থে শেখ মুজিবুর রহমান পর্যায়ক্রমে সবাইকে ক্ষমা করে দেন। রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা মিত্র বলে কিছু নেই। ঐ মুহূর্তে ইসলামপন্থীরা আওয়ামী লীগের জন্য হুমকি বা শত্রু ছিল না। রাজনীতিতে বর্তমান শত্রুকে বড় করে দেখা হয়। ভারতীয় শোষণ ও আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতা ও লুটপাটের কারণে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ভারতীয় আগ্রাসন ও আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ মেজর জলিল ও আ.স.ম. আব্দুর রবের নেতৃত্বে জাসদ গড়ে তুললে সরকারের জন্য সেটি হয় এক চ্যালেঞ্জ। মানুষ দলে দলে জাসদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। আওয়ামী লীগের জন্য বিপদ অনুভব করে সরকার চরম দমন-পীড়ননীতি অবলম্বন করে এবং একপর্যায়ে রক্ষীবাহিনী গঠন করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে থাকে। সরকারের অন্যায় আচরণের সমালোচনা বন্ধ করার লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় বাকশাল গঠন করেন। এক অজনপ্রিয় ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন সরকারকে উৎখাত করার জন্য কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার সাহসী উদ্যোগে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর পর্যায়ক্রমে তিনি বিএনপি গঠন করেন। নবগঠিত দলে মুসলিম লীগ, ভাসানী ন্যাপসহ ডান-বামের অনেকেই শামিল হন। তাঁর রাজনীতির দর্শন ছিল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ। ফলে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের বিভাজন নীতি থেকে সরে এসে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশ গঠনে সকলের ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেন। একদলীয় শাসন থেকে দেশে তিনি বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সেনাবাহিনীর আওয়ামীপন্থী একটি অংশ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা করলেও সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ আওয়ামী লীগের ফিরে আসাকে প্রতিহত করে। জিয়াউর রহমানের শাহাদতের পর বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির হাল ধরেন এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নীতি ও আদর্শ আঁকড়ে ধরে থাকেন। বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতকে বেশ মূল্যায়ন করেন। চারদলীয় জোট সরকার গঠিত হলে জামায়াতের দুই শীর্ষ ব্যক্তিকে তাঁর সরকারে গ্রহণ করেন এবং জামায়াতের দুজন নেতা দক্ষতা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। জামায়াতের শত্রুরাও দুজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি বর্তমানে তাঁদের নীতি ও আদর্শ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতি করে আসা ব্যক্তিবর্গই বর্তমানে বিএনপিকে নেতৃত্ব দান করছেন। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি মূলত দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভ। আমীরে জামায়াত থেকে মাঠের একজন কর্মীও মনে করে যে আল্লাহপাক তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের জানমাল জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন। ফলে জামায়াতের নেতাকর্মী সকলেই দল পরিচালনার জন্য খরচ করাকে আল্লাহর পথে খরচ ও আল্লাহকে ঋণদান এবং দলের জন্য সময়দানকে ইবাদত মনে করে। সাথে সাথে এটাও ঠিক, জামায়াতের এ আন্দোলন নৈতিক আন্দোলন। আল্লাহপাকের বিধানের মধ্য থেকেই জামায়াতকে আন্দোলন করতে হয়। একটি ক্যাডারভিত্তিক আন্দোলন হিসেবে নানা পর্যায় অতিক্রম করে জামায়াতের নেতা (রুকন) হতে হয়। ফরজ হিসেবে মৌলিক ইবাদতসমূহ (সালাত, জাকাত, রোজা ও হজ) নিষ্ঠার সাথে পালন এবং সকল প্রকার হারাম বর্জনের পাশাপাশি দীর্ঘ সিলেবাস অনুসরণ এবং নিয়মিত কুরআন-হাদিস পাঠের মাধ্যমে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সততা ও যোগ্যতার বিকাশ ঘটে। দল পরিচালনার জন্য একজন সহযোগী থেকে আমীরে জামায়াত পর্যন্ত সকলকেই আয়ের একটি অংশ দান করতে হয়। ফলে কর্মীদের সক্রীয় রাখার জন্য চাঁদাবজি বা কোনো অবৈধ পন্থা অবলম্বন করতে হয় না।
বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে বড় অংশ ইসলামের উত্থান চায় না। ফলে স্বাভাবিকভাবে জামায়াতের প্রতি তারা বিদ্বেষ পোষণ করে। বিশ্বাসগতভাবে বিদ্বেষী হলেও তারা জনগণের সেন্টিমেন্ট ও প্রয়োজন বিবেচনা করে জামায়াতের সাথে সখ্যতা বজায় রাখে। বিএনপি জামায়াতের উত্থান পছন্দ করে না, কিন্তু আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের মোকাবিলায় জামায়াতকে সাথে রাখা তাদের প্রয়োজন বলে মনে করে। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট কট্টোর ভারতপন্থী ও ইসলামবিদ্বেষী হওয়ায় তাদের মোকাবিলায় জামায়াতের জন্যও বিএনপি বা সমমনা দলগুলোর সাথে সখ্য দরকার। সম্প্রতি বিভিন্ন বার কাউন্সিল নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত পৃথকভাবে নির্বাচন করার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পরাজিত হচ্ছে।
বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতি এক নয়। বিএনপি মহাসচিবের মুখ থেকে একবার শুনেছিলাম, তিনি বলেছিলেন যে, দুই দলের আদর্শ এক নয়, তাঁরা নির্বাচনে সুবিধা লাভের লক্ষ্যেই জোট করেন। বিএনপির রাজনীতি আখিরাতে লাভের লক্ষ্যে নয়। ফলে তাদের কর্মীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও সততা জামায়াতের সাথে মেলানো যাবে না। ৫ আগস্টের বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে দেশ শাসন এবং বৈষম্যহীন সকলের বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তাদের স্লোগান ছিলÑ ‘ডব ধিহঃ ঔঁংঃরপব’। সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন একদল সৎ ও যোগ্য নেতা-কর্মী। এটি জামায়াতের রয়েছে। কিন্তু জনসমর্থন বাড়লেও কাক্সিক্ষত মানের নয়। দেশে ইসলামী শাসন (সুশাসন ও ন্যায়বিচার) আল্লাহপাকের এক নেয়ামত। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে না চাইলে আল্লাহপাক এ নেয়ামত দেবেন না। ৫ আগস্টে ফ্যাসিবাদের পতনের মধ্য দিয়ে আল্লাহপাক প্রত্যেক দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি জনগণের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ দান করেছেন। এ সুযোগকে (হুদায়বিয়ার সন্ধির মতো) কাজে লাগিয়ে জামায়াত ও শিবিরের লোকদের উচিত নেতিবাচক কোনো কাজ না করে (বিরোধীদের সাথে ঝগড়ায় না জড়িয়ে) শুধুই ইতিবাচক কাজ করা। আর আল্লাহপাকও বিরোধীদের অপপ্রচারকে শয়তানের প্ররোচনা বলে উল্লেখ করেছেন এবং এ অবস্থায় তাঁর আশ্রয়ে চলে আসার জন্য বলেছেন।
এখন প্রশ্নÑ বিএনপি-জামায়াতের এ দ্বন্দ্বে লাভ-ক্ষতি কার কতটুকু? লাভ যা তা সবই পতিত স্বৈরাচারের। ক্ষতি বিএনপি-জামায়াত উভয়েরই। অবশ্য রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। বিএনপি ও ছাত্রদলের অনেকেই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ভাষায় কথা বলছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং তিনি সফল হয়েছিলেন। এখনো স্পষ্ট হয়নি, আমার কাছে মনে হচ্ছে সামনে যে দল গঠিত হতে যাচ্ছে, তা মূলত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক একটি স্বতন্ত্রধারা সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। কতটুকু সফল হবে বলা যাচ্ছে না। তবে বিএনপি ও ছাত্রদল জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে প্ররোচনা অব্যাহত রাখলে তারা বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে স্বতন্ত্র জোট গঠনের দিকে এগোতে পারে। দেশের নাগরিক হিসেবে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসুক, তা কোনোভাবেই আমরা চাই না। আমরা চাই একটি শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ সমাজ যেখানে ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-লিঙ্গ কোনো কিছু ভেদাভেদ থাকবে না এবং সকলেই সমান অধিকার নিয়ে ‘সবার বাংলাদেশ’ গঠন করবে। আল্লাহপাক আমাদের সে তাওফিক দান করুন। লেখক: উপাধ্যক্ষ (অব.), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।