আমের অজানা কথা
১ মে ২০২৫ ১৮:০০
আলমগীর আলম
আম নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে। আম জন্মানোর ইতিহাসও বেশ পুরনো। কয়েক হাজার বছর আগে এর জন্ম। এ উপমহাদেশ থেকেই মূলত আম ছড়িয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
আমরা যে আম খাই, তারও ৪০০০ থেকে ৫০০০ বছর আগে বর্তমানের পূর্ব ভারত, পাকিস্তান ও বার্মায় আম জন্মানোর ইতিহাস আছে। এর বীজ ৩০০ বা ৪০০ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় মানুষের সঙ্গে ভ্রমণ করেছিল এবং প্রথমে মালয়েশিয়া, পূর্ব এশিয়ার পাশাপাশি পূর্ব আফ্রিকায় চাষ করা হয়েছিল। অন্যদিকে পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা আফ্রিকা ও ব্রাজিলের মানুষের কাছে আমের প্রবর্তন করেছিলেন।
ভারতে কাউকে এক ঝুড়ি আম দেওয়া বন্ধুত্বের কাজ বলে মনে করা হয়।
আম দীর্ঘকাল ধরে ওষুধের ঐতিহ্যবাহী ফার্মগুলোয় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর নিরাময় বৈশিষ্ট্য জানলে মৌসুমে আম খাবেনই। আয়ুর্বেদিক তথ্যমতে, পুষ্টিকর, রোগ নির্মূল করতে, গলাকে প্রশমিত করতে এবং আর্দ্রতা তৈরি করে শরীরে তরল বাড়াতে সাহায্য করে আম।
এদিকে ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধে আম হজমশক্তি, শারীরিক তরল তৈরি করতে এবং কাশি কমাতে ব্যবহার করা হয়। আম শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপ বাড়ায় বলেও মনে করা হয়, যা রক্ত সঞ্চালনকে উন্নত করতে পারে এবং কিউইকে (শক্তি) পুষ্ট করতে পারে, যা অঙ্গগুলোর অত্যাবশ্যক শক্তি।
১৮৮০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় এ ফলের উপস্থিতি এবং চাষের আগে ১৮০০ সালে ফ্লোরিডা ও হাওয়াইয়ে আমের চাষ শুরু হয়।
ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের জাতীয় ফল আম! সেই সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় গাছ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমের পাতা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সম্প্রদায়ের উৎসব ও উদযাপনের পাশাপাশি বিয়ের অনুষ্ঠান সাজাতে ব্যবহার করা হয়। ভারতীয় পুরাণে অনেক গল্পে আমগাছের কথা উল্লেখ আছে। বুদ্ধ একটি আমগাছের ছায়ায় ধ্যান করেছিলেন বলে কথিত আছে।
পৃথিবীতে ১০০০টিরও বেশি জাতের আম পাওয়া যায়। চীন, মেক্সিকো, ব্রাজিল ও থাইল্যান্ডেও আম চাষ করা হয়। ভারত বিশ্বের প্রধান আম উৎপাদনকারী দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ফ্লোরিডা আমের প্রধান উৎপাদক। কিছু আমগাছ ৩০০ বছরেরও বেশি সময় বেঁচে আছে এবং এত বয়সেও সেসব গাছে ফল ধরে।
বিশ্ববিখ্যাত আমের জন্মস্থান যে ভারত, এটা ইংরেজরা মেনে নিতে চাইছিল না। তারা বলার চেষ্টা করল, আম দূর প্রাচ্যের ফল। এটা মূলত শ্যামদেশ (থাইল্যান্ড), কম্বোজ (কম্বোডিয়া) আর মালয়ের (মালয়েশিয়া) জঙ্গলে জন্মায়। এটি একটি জংলি ফল, যা পরবর্তী সময়ে মিয়ানমার (বার্মা) হয়ে ভারতে পৌঁছায়। কিন্তু তাদের কথার পাল্টা জবাব দেওয়া হয়েছিল, ‘ম্যাংগো’ শব্দটাই ভারতীয়। তামিল ভাষায় আমকে ‘ম্যান-কে’ বলে, কোথাও কোথাও ‘ম্যান-গে’ বলে। সে থেকেই পর্তুগিজরা ‘ম্যাংগা’ শব্দটি নিয়েছিল। সেখান থেকে ইংরেজি ‘ম্যাংগো’ হয়েছে। তখন থেকে ইংরেজদের ভারতবর্ষকে ছোট করার প্রবণতা আর টিকে থাকেনি।
আমকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যান চায়নিজ গবেষক হিউয়েন সাং, যিনি সাত শতকের চৈনিক বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী। তিনি ভারত ও বাংলা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ লিখে গেছেন।
কাবুল ও সমরখন্দে আম জন্মাত না! মোগল সম্রাট আকবর ১৫৭০ থেকে ১৫৮০ সালের মধ্যে উঁচু স্থান দেখে বিহারের দ্বারভাঙায় এক লাখ আমের চারা রোপণ করেন। এ উপমহাদেশে এটাই প্রথম কোনো পরিকল্পিত আম চাষ, যা টিকে অছে।
ফজলি আমের নামকরণ নিয়ে একটি গল্প আছে। ভারতের মালদহের কালেক্টর র্যাভেন একদিন গরমের দুপুরে গৌড়ের পথে যাচ্ছিলেন। চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে এক গাছতলায় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামেন। তখন তৃষ্ণায় তাঁর প্রাণ ওষ্ঠাগত। তিনি পানি চাইলে এক বৃদ্ধা তাঁকে পানির সঙ্গে একটি আম খেতে দেন। সেই আম খেয়ে তার স্বাদে সাহেব মজে গেলেন। তিনি জানতে চাইলেন, এই আম কোথায় পেয়েছেন? বৃদ্ধা জানালেন, এই আম তাঁরই গাছের।
র্যাভেন আমের স্বাদ গ্রহণে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে সেই নারীর নামে আমের নামকরণ করেন ফজলি। ফজলি বিবির আতিথেয়তায় আমের একটি জাতের নাম হয়ে যায় ফজলি। এই আম আগে ‘ফকিরভোগ’ বলে পরিচিত ছিল। আমটির উৎপত্তি ভারতের মালদহ জেলায়। ঠিক আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওপারে।
লেখক: খাদ্য ও পথ্য বিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র।