রহমানের বান্দার পরিচয় : পর্ব-২১ : অপরাধ ও দুর্নীতিমুক্ত জীবন গঠন : সফল মুমিনের পরিচয়
৮ নভেম্বর ২০২৪ ১১:০৮
॥ ড. মুহাম্মদ খলিলুর রহমান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
অশ্লীলতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রকাশ পেতে পারে, যেমন:
১. লেখা ও সাহিত্য: কিছু সাহিত্যকর্ম বা কবিতায় অশ্লীল ভাষা বা বিষয়বস্তু থাকতে পারে।
২. চলচ্চিত্র: সিনেমা বা টেলিভিশন শোতে অশ্লীল দৃশ্য বা সংলাপ থাকতে পারে।
৩. মিডিয়া ও বিজ্ঞাপন: কিছু বিজ্ঞাপন বা মিডিয়া প্রচারণায় অশ্লীলতা পরিবেশিত হতে পারে।
৪. অনলাইন প্ল্যাটফর্ম: সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ বা ফোরামে অশ্লীল মন্তব্য বা ছবি শেয়ার করা।
৫. শিল্পকর্ম: কিছু শিল্পকর্মে অশ্লীলতা বা যৌনতার প্রকাশ থাকতে পারে।
৬. সংগীত: গান বা সংগীত ভিডিওতে অশ্লীল ভাষা বা দৃশ্য থাকতে পারে।
* অভিভাবকদের পক্ষ থেকে সন্তানদের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হওয়া সময়ের অপরিহার্য দাবি : পরিবারের বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে সন্তানদের প্রতি বিশেষ সজাগ, সচেতন, সতর্ক ও আন্তরিক থাকা খুবই জরুরি। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ ‘ফাহজারুহুম’ এর অর্থও তাই। বিশেষ করে বর্তমান নেট দুনিয়ার ব্যাপক প্রভাবে এবং বিভিন্ন ডিভাইস-গ্যাজেটের অবাধ ব্যবহার সন্তান কাজ করে কোমলমতি, কলিজার টুকরা শিশুদের ধীরে ধীরে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। এখানে কিছু কার্যকরী উপায় তুলে ধরা হলো-
১. খোলামেলা আলোচনা : সন্তানদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করুন। তাদের প্রশ্নের উত্তর দিন এবং অশ্লীলতার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করুন।
২. ইসলামী মূল্যবোধ শেখান : ইসলামিক শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতা ও চরিত্র গঠনের গুরুত্ব বোঝান। কুরআন ও হাদিস থেকে উদাহরণ দিন।
৩. ভালো সঙ্গী নির্বাচন : সন্তানদের ভালো ও সৎ বন্ধুদের সাথে মেলামেশার সুযোগ দিন। সঠিক সঙ্গী নির্বাচন অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। প্রবাদে আছে ‘সৎ সঙ্গ স্বর্গবাস অসৎসঙ্গ সর্বনাশ’ তাই প্রয়োজনে পিতা-মাতাকে কখনো কখনো সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হতে হয় সন্তানদের জন্য। মহানবী (সা.) সুস্পষ্ট ভাবে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে পরিবারের সাথে জিনিস সবচেয়ে ভালো আচরণ করেন তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ’। (সুনসান সহীহ, তিরমিযী)।
৪. নেগেটিভ কন্টেন্ট থেকে দূরে রাখা : টেলিভিশন, সিনেমা, ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে অশ্লীল কন্টেন্ট থেকে সন্তানদের রক্ষা করুন। নিরাপদ এবং শিক্ষামূলক কনটেন্ট নির্বাচন করুন।
৫. সক্রিয়তার সুযোগ দিন : সন্তানদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর কাজে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করুন। এটি তাদের মনোনিবেশ এবং সৃজনশীলতা বাড়ায়।
৬. আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা : সন্তানদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলুন। তাদের সফলতার জন্য প্রশংসা করুন এবং তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন।
৭. শিক্ষা ও সচেতনতা : অশ্লীলতার ক্ষতিকর প্রভাব এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উপায় সম্পর্কে শিক্ষামূলক বই ও ভিডিও দেখান।
৮. নিয়মিত ধর্মীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ : পরিবারের সাথে নিয়মিত নামাজ, ধর্মীয় আলোচনা ও শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করান।
৯. শিক্ষাগত উদ্যোগ, নিরাপত্তার শিক্ষাদান : শিশুদের নিরাপত্তা সম্পর্কে শিক্ষাদান, যেমন অচেনা ব্যক্তির সাথে কথা না বলা এবং বিপদের সংকেত চিহ্নিত করা।
১০. প্রযুক্তিগত সুরক্ষা, প্যারেন্টাল কন্ট্রোল: শিশুদের ব্যবহৃত ডিভাইসে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সফটওয়্যার ব্যবহার করা।- নিরাপদ অ্যাপ নির্বাচন: শিশুদের জন্য উপযুক্ত এবং নিরাপদ অ্যাপ ও গেম নির্বাচন করা।
১১. পরিবেশগত নিরাপত্তা, নিরাপদ স্থান নির্ধারণ: শিশুদের খেলার জন্য নিরাপদ জায়গা নির্ধারণ এবং নিশ্চিত করা। নিয়মিত তদারকি: শিশুদের খেলার সময় এবং স্থান তদারক করা।
১২. সামাজিক যোগাযোগ, অভিভাবক-শিক্ষক সম্পর্ক: স্কুলে অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে আলোচনা করা। পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে যোগাযোগ: স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
১৩. আইনগত ব্যবস্থা, নিরাপত্তা আইন: শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
১৪. রিপোর্টিং সিস্টেম: শিশুদের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ঘটনা দ্রুত রিপোর্ট করার সহজ ব্যবস্থা তৈরি করা।
১৬. মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা, মনোসামাজিক সেবা: শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিশ্চিত করা। এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শিশুদের নিরাপত্তা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সফটওয়্যার ব্যবহারের কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা নিচে উল্লেখ করা হলোÑ
১৭. মনিটরিং: শিশুদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা, যেমন কোন ওয়েবসাইটে গেছে বা কীভাবে সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার করছে।
১৮. প্রাপ্তবয়স্ক কন্টেন্ট ব্লক: অশ্লীল বা অসঙ্গতিপূর্ণ কন্টেন্ট ব্লক করার মাধ্যমে নিরাপদ ব্রাউজিং নিশ্চিত করা।
১৯. যোগাযোগের নজরদারি: অচেনা ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ রোধ করতে সাহায্য করে।
২০. বিপরীত প্রতিক্রিয়া: কিছু শিশু প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের কারণে বিদ্রোহী হতে পারে ও নিরাপত্তার বিধি ভঙ্গ করতে পারে।
২১. সীমাবদ্ধতা: অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ শিশুদের স্বাধীনতা হ্রাস করতে পারে, যা তাদের আত্মবিশ্বাসে প্রভাব ফেলতে পারে।
শিশুদের এড়িয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে
২২. সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষা: শিশুদের নিরাপত্তা সম্পর্কে শিক্ষা দিন, যেমন অচেনা ব্যক্তির কাছে যাতায়াত না করা এবং বিপদের সংকেত চিহ্নিত করা। – নিরাপত্তা কথোপকথন: নিয়মিত আলোচনা করে নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করুন।
২৩. পরিবেশগত নিরাপত্তা, নিরাপদ পরিবেশ: শিশুদের খেলার জন্য নিরাপদ জায়গা নিশ্চিত করুন, যেখানে তাদের নজরদারি করা সহজ। নিয়মিত তদারকি: শিশুরা কোথায় যাচ্ছে এবং কাদের সাথে সময় কাটাচ্ছে তদারক করুন।
২৪. প্রযুক্তিগত সুরক্ষা, প্যারেন্টাল কন্ট্রোল: অনলাইনে শিশুদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সফটওয়্যার ব্যবহার করুন। – নিরাপদ অ্যাপ: শিশুদের জন্য নিরাপদ এবং উপযুক্ত অ্যাপ ও গেম নির্বাচন করুন।
২৫. সামাজিক যোগাযোগ, আস্থা তৈরি: শিশুদের সাথে একটি বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক তৈরি করুন, যাতে তারা সমস্যার কথা বলতে পারে। পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে যোগাযোগ: স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
২৬. মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা: ‘মানসিক স্বাস্থ্যসেবা’ শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখুন এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিন। সন্তানদের শারীরিক-মানসিক ও নৈতিক ভাবে পরিপূর্ণরূপে গড়ে তোলার জন্য মনস্তাত্ত্বিকভাবে সার্বিক সহযোগিতা করা আমাদের ঈমানী ও নৈতিক দায়িত্ব। আজকের শিশু আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর।
আমাদের সংবিধানের দণ্ডবিধি, ১৮৬০-ধারা ২৯২ ও ২৯৩ অনুযায়ী, অশ্লীল বই, পত্রিকা বা অন্য কোনো প্রকাশনা বিক্রি বা বিতরণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ।
* ইন্টারনেট আইন (২০০৬): অনলাইনে অশ্লীল বিষয়বস্তু প্রকাশ বা প্রচার করা নিষিদ্ধ।
সমাপনী: সফল নির্ভেজাল মুমিন হওয়ার জন্য ‘লাগব’ তথা বাজে কাজ, বাজে কথা, বাতিল কাজ, অনুচিত কর্মসমূহ, অশ্লীলতা-বেহায়াপনা, অপরাধপ্রবণতা, বেহুদা ইত্যাদি কাজ থেকে নিজকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত রাখা। এককথায় শিরকমুক্ত, বিদআতমুক্ত, অশ্লীলতা বেহায়াপনামুক্ত, রং তামাশা ঠাট্টা বিদ্রুপমুক্ত আত্মমর্যাদা দান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিই নিশ্চিত সফল ঈমানদার আল্লাহ তায়ালার কাছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সকল ধরনের বেহুদা কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন! আমিন। (চলবে)।
লেখক : প্রবন্ধকার: কলামিস্ট, লেখক, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। ওয়ার্ল্ড মুসলিম স্কলার্স ফোরাম কাতারের নির্বাহী সদস্য।
[email protected]