রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ২৮তম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ ॥ ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী ॥ ৪ অক্টোবর ২০২৪

॥ ড. মুহাম্মদ খলিলুর রহমান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
দারিদ্র্যবিমোচনে জাকাতের অর্থ বণ্টনে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ : জাকাতের ধর্মীয়, নৈতিক ও নানাবিধ ইতিবাচক উদ্দেশ্য থাকলেও এর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উদ্দেশ্য সবিশেষ গুরুত্ববহ। অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ একটি মারাত্মক অপরাধ। সম্পদের ব্যাপক ব্যয়-ব্যবহার এবং বিনিয়োগই হচ্ছে তার জন্য স্বাভাবিক ব্যবস্থা। জাকাত এ ব্যবস্থার বাস্তব সাংগঠনিক পদ্ধতি। এটি সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণের প্রধান প্রতিরোধক। কেননা ইসলাম সামাজিক শ্রেণিবৈষম্যকে শুধু অপছন্দই করে না; বরং তা দূরীভূত করার কথাও বলে। তাই একটি সুখী, সুন্দর এবং উন্নত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিত্তশালী মুসলিমদের অবশ্যই তাদের সম্পদের একটি অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের দুর্দশা মোচনের জন্য ব্যয় করতে হবে। এর ফলে যে শুধু অসহায় এবং দুস্থ মানবতারই কল্যাণই হবে তা-ই নয়, সমাজে আয় বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য অনেক হ্রাস পাবে। কিন্তু জাকাত বণ্টনে অব্যবস্থাপনার কারণে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোয় আজ দারিদ্র্যবিমোচন হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে ২০১৪ সালে এক গবেষণায় নাসিম শিরাজী বলেছেন যে, প্রতি বছর জাকাত সংগ্রহ করা সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক দরিদ্রতা বিরাজ করছে। বেশিরভাগ মুসলিম দেশে ৭০ শতাংশেরও বেশি মুসলিম জনগোষ্ঠী দরিদ্র এবং তারা প্রতিদিন ২ মার্কিন ডলারেরও কম অর্থে জীবনযাপন করে। শিরাজী বলেছেন, ১০টিরও বেশি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ-এর বেশি ১.২৫ ডলারেরও কম সীমায় জীবনযাপন করছে। জাকাত এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ মুসলিম দেশে মুসলমানদের মধ্যে নিরঙ্কুশ দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারেনি।
বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়ন ও মানবকল্যাণের যেসব ক্ষেত্রে জাকাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে, সেগুলো নিম্নরূপ:
দারিদ্র্যবিমোচন : ইসলামে জাকাত ব্যবস্থা দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে একটি সুনিশ্চিত কার্যকর পন্থা। এতে শুধু সমাজই নয়, রাষ্ট্রও উপকৃত হয় সমানভাবে। দরিদ্রতা যেকোনো দেশ ও সমাজে একটি জটিল ও তীব্র সমস্যা। অধিকাংশ সামাজিক অপরাধও ঘটে এ দরিদ্রতার জন্য। এ সমস্যার প্রতিবিধান করার জন্য জাকাত ইসলামের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। জাকাতের অর্থসম্পদ প্রাপ্তির ফলে দরিদ্রের জীবন যেমন আনন্দ ও নিরাপদ হয়, তেমনি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হয়। বাংলাদেশে জাকাত, উশর, খনিজসম্পদ ও প্রাণিকুলের জাকাত শরিয়ত নির্ধারিত নিয়মে বাধ্যতামূলকভাবে আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিকল্পিতভাবে দারিদ্র্যমোচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে খুব বেশি নয়, মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব। আল-কুরআনে বর্ণিত জাকাতের অর্থ ব্যয়ের যে আটটি খাতের কথা বলা হয়েছে, তাতে প্রথম খাতেই রয়েছে দরিদ্র ও অভাবী লোকদের মধ্যে জাকাতের অর্থসামগ্রী বণ্টন করা। এতে শুধু অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তা নয়; বরং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতিবেগের সঞ্চার হয়। জাকাতের অপর হিতকর ও কল্যাণধর্মী দিক হলো, ঋণগ্রস্তদের ঋণ মুক্তি ও প্রবাসে বিপদকালে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা লাভ। প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো প্রয়োজন মোকাবিলার কারণে যদি কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং সে উক্ত ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে, তাহলে জাকাতের অর্থ দিয়েই সংকট মোচন করা যায়। দেউলিয়া হয়ে সমাজে অসম্মানিত জীবনযাপনের গ্লানি মোচনে জাকাত এক মোক্ষম হাতিয়ার। দেশের অধিকাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী পল্লী অঞ্চলেই বসবাস করে থাকে। দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রধান দিক হলো পল্লী জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়ন। তাই দারিদ্র্য দূর করতে হলে সর্বপ্রথমে পল্লী অঞ্চলের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প ইত্যাদি দেশি-বিদেশি অনেক এনজিওসহ দেশের সরকারি ও আধাসরকারি বন্ড প্রতিষ্ঠান এ সংস্থা দারিদ্র্যবিমোচনে ঋণদানে এগিয়ে এলেও এখানে ঋণ সুদভিত্তিক হওয়ায় পল্লীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়ন বহুলাংশে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে এর অর্থ গরিব জনগোষ্ঠীর মাঝে বিনাসুদে বিনিয়োগ করা হলে দারিদ্র্যদূরীকরণ সম্ভব।
কল্যাণমূলক কর্মসূচি : জাকাতের অর্থ দিয়ে যদি দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষের কর্মক্ষম করার জন্য পুনর্বাসন প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানমূলক কল্যাণধর্মী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, তাহলে আগামী দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য সত্যিকার অর্থে বিদায় নেবে। এ প্রস্তাবিত কর্মসূচির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিধবা, বিকলাঙ্গদের কল্যাণ, বৃদ্ধদের জন্য মাসোহারা, কন্যাদায়গ্রস্তদের সাহায্য, ঋণগ্রস্ত কৃষকদের জমি অবমুক্তকরণে সাহায্য, এতিমদের প্রতিপালন, শরণার্থী সহায়তা ও উদ্বাস্তু পুনর্বাসন এবং অভাবী সাধারণ জনগণের সুচিকিৎসার জন্য ইউনিয়নভিত্তিক মেডিকেল সেন্টার স্থাপন। এছাড়া জাকাতের অর্থ দিয়ে গরিবদের জন্য স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করে দেয়ার নিমিত্তে রিকশা-ভ্যান কিনে দেয়া থেকে শুরু করে স্থায়ীভাবে বিভিন্ন ধরনের হালাল ব্যবসায় পুঁজি জোগান দিয়ে তাদের সাহায্য করা যেতে পারে।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচি : জাকাতের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণমূলক অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্য জাকাতের অর্থ দিয়ে গরিব ছাত্রদের বই কিনে দেয়া থেকে শুরু করে তাদের জামাকাপড় ও লিল্লাহ  বোডিংয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের তাদের শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষা বৃত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এ অর্থ দিয়েই কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে গরিব জনশক্তিকে অধিকতর উৎপাদনমুখী করা যেতে পারে। এছাড়া ইসলামী সাহিত্য প্রকাশ ও প্রসারের জন্য জাকাতের অর্থ ব্যয় করে জনসাধারণকে ইসলামমুখী করা যেতে পারে। জাকাত ব্যয়ের খাতে উল্লিখিত ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ দ্বারা এর বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
কর্মসংস্থান ও গৃহায়ন কর্মসূচি : জাকাতের প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কর্মসংস্থান ও গৃহায়ন কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। গরিব কৃষকদের গরুর বলদ ক্রয়ে এ অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যেতে পারে। এছাড়া এ অর্থ দিয়ে ক্ষুদ্র আকারের উৎপাদনমুখী কর্মসূচি; যেমনÑ চাল, চিঁড়া, মুড়ি তৈরি, নার্সারি তৈরি, তাঁতসামগ্রী তৈরি, হাঁস-মুরগি পালন, মাছের চাষ, সেলাই মেশিন, ইলেক্ট্রিকসামগ্রী মেরামত, রিকশা-ভ্যান তৈরি ও মেরামত ইত্যাদি। এছাড়া ক্ষুদ্রাকারের ব্যবসা, যেমনÑ মুদি দোকান, চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকান, মাছের ব্যবসা, ফলের ব্যবসা ইত্যাদি পরিচালনা করা যেতে পারে। যাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এছাড়া বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, অসহায় মহিলাদের এ অর্থ দিয়ে সেলাই, কাটিং ও বুটিকসহ বিভিন্ন কুটির শিল্পসামগ্রী তৈরি করার প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করা যেতে পারে। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক লোক বন্যা, নদীভাঙন ও অগ্নিকাণ্ডে তাদের ঘরবাড়ি হারায়। জাকাতের অর্থ দিয়ে এ বাস্তুহারা মানুষকে গৃহনির্মাণে সহায়তা দেয়া যেতে পারে। (চলবে)
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।
Email: khalilmadani07@gmail.com

এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।