রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ১৩তম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ৭ আষাঢ় ১৪৩১ ॥ ১৪ জিলহজ ১৪৪৫ হিজরী ॥ ২১ জুন ২০২৪

॥ আবু রাশাদ ॥
মহাবিশ্বের রহস্য সম্পর্কে বিভিন্নকালে মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন জেগেছে। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে রহস্য যবনিকা উন্মোচন করে মহাসত্য উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু আজও যবনিকার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সব রহস্যাবলি মানুষের দৃষ্টিতে এল না; হয়তো কোনোদিনই আসবেও না। তাই বলে মানুষের চেষ্টা-সাধনাও থেমে থাকবে না।
বিশ^রহস্য সম্পর্কে প্রশ্ন জেগেছিল শৈশবেই হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর অন্তরে। তিনি সব রহস্যের পেছনে খুঁজে পেয়েছিলেন সর্বশক্তিমান আল্লাহকে তাঁর ইলহামী জ্ঞানের মাধ্যমে।
সাধারণ মানুষ চরম সত্য জ্ঞানার্জনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। অস্থির হয়ে উঠেছিল মহাবিশে^র ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে। এরিস্টটল থেকে শুরু করে টলেমী, গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস, কেপলার, নিউটন বিভিন্নভাবে মহাবিশে^র ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাঁদের মূল্যবান মতামত পেশ করেছেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে প্লাংক, আইনস্টাইনসহ অন্যান্য প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা বিশ্ববাসীর সামনে নতুন নতুন তথ্য পেশ করেছের। তাঁদের প্রস্তাবিত ব্যাপক অপেক্ষবাদ ও কোয়ন্টাম মেকানিক্স মহাবিশে^র রহস্য উদ্ঘাটনে সক্ষম হয়েছেন বলে তাঁরা দাবি করেননি।
বিজ্ঞানীগণ বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগে এসে যা কিছু সত্য জানতে সক্ষম হয়েছেন, তার কিছু কিছু তত্ত্ব জাগতিক শিক্ষার সাথে অপরিচিত রাসূল (সা.) বেশ কয়েকশত বছর আগেই বিশ^বাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। রাসূলের জ্ঞান ছিল চরম সত্যের জ্ঞান। দেড় হাজার বছর আগে অন্ধকার পৃথিবীর কাছে রাসূলের বিশ্বরহস্যের তথ্য প্রকাশ যে কত বড় মুজিজা তা ভেবে বিজ্ঞানীরা বিস্মত ও হতবাক। রাসূল (সা.) তাঁর তথ্য প্রকাশনার মাধ্যমে যেমন মহাবিশে^র নীতিমালা ব্যক্ত করেছেন, তেমনি এর পেছনে যে মহাসত্য ও পরিকল্পনা বিদ্যমান তাও তিনি যুগপৎ জানিয়ে দিয়ে গেলেন বিশ্ববাসীকে।
আধুনিক বিজ্ঞানীদের এক অংশ যখন মনে করেন যে, বিজ্ঞান কয়েকটি বিধির গুচ্ছ আবিষ্কার করেছে, যে বিধিগুলো অনুসারে আল্লাহ বিশ্বকে বিবর্তিত হওয়ার স্বাধীনতা দিয়ে তিনি এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। তখন রাসূল (সা.) প্রাপ্ত ওহির মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন প্রসারমান মহাবিশ্বের ধারণা। বিজ্ঞান বলছে, মহাবিশ্ব স্থিতি অবস্থায় নেই। মহাবিশ্ব শুরু থেকেই প্রসারমান, অর্থাৎ আল্লাহ বিশ্বব্যবস্থাপনা নিয়ে স্থির নেই। এ ধারণা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জগতের মানুষকে জানিয়ে দিলেন একটি ঘটনা দিয়ে তাঁর রাসূলের মাধ্যমে। ঘটনাটি এরূপ-
“আল্লামা ইবনে জওযী একাধারে দীর্ঘ দু’বছর ধরে ‘কুল্লা ইয়াওমিন হুয়া ফি শা’ন’ এ আয়াতের তাফসীর বয়ান করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি পরপর তিন দিন এক অপরিচিত ব্যক্তির প্রশ্ন- ‘আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় বোঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা প্রতি মুহূর্তেই নতুন নতুন শানে আবির্ভূত হন। বলুন তো এ মুহূর্তে আল্লাহ পাক কোন শানের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন?’
ইবনুল জওযী তিন দিন এ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে লা জওয়াব হয়ে গেলেন এবং তৃতীয় রাতে স্বপ্নযোগে তিনি রাসূলে করীম (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। হুজুর (সা.) বললেন, ‘ইবুনুল জওযী! যে ব্যক্তি এ প্রশ্ন উত্থাপন করে তোমাকে নির্বাক করে দিয়েছেন তিনি হযরত খিযির। তুমি জবাব দাও যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর অনাদি স্বরূপেই মাঝে মাঝে প্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন, সম্পূর্ণ নতুন কোনো কিছুরই প্রকাশ তিনি করেন না। এই মুহূর্তেও তিনি তাই করছেন, অনাদি যুগে তিনি যা করছিলেন।’ অনাদি যুগে মহাবিশ্ব যে ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছিল, সেই ব্যবস্থপনায়, সেই নীতিগুচ্ছ অনুসরণ করেই আজও বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে। আধুনিক মহাবিশ্ব সম্প্রসারণ সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক তথ্য উক্ত আয়াতের প্রতিধ্বনি।
সৌরজগতের চন্দ্র-সূর্য গ্রহণ, ধূমকেতুর আগমন, উল্কাপিণ্ডের পতন নিয়ে মানবসমাজে ভ্রান্ত ধারণা ও ভীতি বিরাজমান ছিল। মানবসমাজে বিভিন্ন দুর্ঘটনার সাথে এদের সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই অন্ধকার যুগের মানুষের সামনে রাসূল (সা.) এমন সব বৈজ্ঞানিক তথ্য পেশ করলেন, যা আজ বিজ্ঞানের আবিষ্কারে সত্য হিসেবে প্রমাণিত হলো।
চন্দ্র-সূর্য গ্রহণ সম্পর্কে রাসূলের ব্যাখ্যা ছিল তদানীন্তন জগতের কাছে অভিনব। যদিও আজকের বৈজ্ঞানিক তথ্যের আলোকে তা মামুলী মনে হতে পারে। রাসূলের মক্কী জীবনের বিরুদ্ধবাদীদের দৌরাত্ম্য যখন চরমে পৌঁছেছিল, ঠিক এমন এক দিনে সূর্যগ্রহণ দেখা দিল। এমন গ্রহণ যে চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেল। আকাশের তারা ভাসমান হয়ে উঠল। মানুষের মনে ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। ঠিক এ দিনেই রাসূল (সা.)-এর স্নেহের পুত্র হযরত ইব্রাহীম ইন্তেকাল করেন। লোকেরা বলাবলি করতে লাগল যে, রাসূলের পুত্রের মৃত্যুতেই সম্ভবত সূর্য গ্রহণ দেখা দিয়েছে। কথাটা নবী (সা.) জানতে পেরে সাহাবীগণকে সমবেত করে একটি ভাষণ দেন। তাতে তিনি বললেন, লোক সকল! চন্দ্র এবং সূর্য আল্লাহ তায়ালার দুটি নিদর্শন। কারো মৃত্যু হলে পর এগুলো নিষ্প্রভ হয় না। তোমরা যা কিছু দেখছ না, সেগুলো আমাকে দেখান হয়েছে। জান্নাত ও জাহান্নাম পর্যন্ত আমি স্বচক্ষে দর্শন করেছি।... দোজখের মধ্যে আবু ছুমামা, আমর ইবনে মালেককেও জ¦লতে দেখেছি, ওরা ছিল ঐ সব লোক যারা চন্দ্র বা সূর্যের গতি বিধির সাথে বিশিষ্ট লোকদের জন্মমৃত্যুর সংযোগ রয়েছে বলে বিশ্বাস করতো। গ্রহণ দেখার পর তোমরা নামাযের জন্য দাঁড়িয়ে যাও, যতক্ষণ না সেটি মুক্ত হয়।”
চন্দ্র-সূর্য গ্রহণ যে একটি প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন, যা বিশ^প্রভুর নিদর্শন। এ ধারণা মনে জাগ্রত করার লক্ষ্যেই তিনি গ্রহণকালে নামায আদায়ের জন্য উৎসাহিত করে গেলেন ঈমানদারদের।
উল্কাপিণ্ডের পতন নিয়ে মানবসমাজে ভ্রান্ত ধারণা চলে আসছে বহুকাল ধরে। আধুনিক যুগের পর্যবেক্ষণ উল্কা সম্বন্ধীয় ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়েছে। বর্তমান যুগের বৈজ্ঞনিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, দুরবিন প্রতিফলিত উল্কা রাশি যা দূর ঊর্ধ্বের শূন্যলোক থেকে নিচের দিকে ছুটে আসতে দেখা যায় তার সংখ্যা দৈনিক দশ হাজার কাটি। এ গুলির প্রায় দুই কোটি প্রতিদিন জমিনের উচ্চতর অঞ্চলে প্রবেশ করে। তন্মধ্যে খুব বেশি হলে এক কোটি জমিনের পৃষ্ঠ পর্যন্ত এসে পৌঁছে। উচ্চতর শূন্যলোকে এগুলোর গতি প্রায় প্রতি সেকেন্ডে কম বেশি ছাব্বিশ মাইল। অনেক সময় ৫০ মাইল পর্যন্ত দেখায়। অনেক সময় নগ্ন চক্ষু অসংখ্য তারকা বৃষ্টি হতে দেখতে পায়। রেকর্ডে রক্ষিত রয়েছে যে, ১৮৩৩ সালের ১৩ নভেম্বর উত্তর আমেরিকার পূর্ব এলাকায় কেবল একটি স্থানে অর্ধেক রাত্রি হতে সকাল পর্যন্ত দুই লক্ষ্য উল্কাপিণ্ড পতিত হতে দেখা গেছে।  
এই উল্কাপাত নিয়ে মানুষের মনে বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কার ছড়িয়ে ছিল। রাসূল (সা.) সেসব কুসংস্কার দূরীভূত করলেন যে সত্য প্রকাশের মাধ্যমে তা আজ বৈজ্ঞানিক তথ্য হিসেবে স্বীকৃত। সহীহ মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (স.) সাহাবাদের এক সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ইতোমধ্যে আকাশে তারকা খসে পড়ল। তিনি সাহাবাদের জিজ্ঞেস করলেন, জাহেলিয়াত যুগে অর্থাৎ ইসলাম পূর্বকালে তোমরা তারকা খসে যাওয়াকে কী মনে করতে? তাঁরা বললেন, আমরা মনে করতাম যে, বিশে^ কোনো ধরনের অঘটন ঘটবে। অথবা কোনো মহৎ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ কিংবা জন্মগ্রহণ করবে। তিনি বললেন, এটা অর্থহীন ধারণা। কারও জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এসব জ¦লন্ত অঙ্গার শয়তানদের বিতাড়নের জন্য নিক্ষেপ করা হয়।
দৈনিক ছুটে আসা দশ হাজার কোটি উল্কাপিণ্ড মহাশূন্যের অদৃশ্য প্রাচীরের আড়ালে জ¦লে ভশ্ম হয়ে যায়, কখনোবা দু-একটি ভূখণ্ডে এসে পৌঁছে। এসব জ¦লন্ত উল্কাপিণ্ড কীভাবে উচ্চতর আকাশে শয়তানের গতিপথে অন্তরায় হয় সে জবাব এখনো জানা সম্ভব হয়নি। হয়তো জমিনের উচ্চতর সীমা অতিক্রম করে শূন্যলোকে ১০ হাজার কোটি খসে পড়া তারকা বর্ষণ শয়তানের যাতায়াতকে অসম্ভব করে দেয়। প্রকৃত অবস্থা আল্লাহই ভালো জানেন।
এ ক্ষুদ্র আলোচনায় বিশ^সম্প্রসারণ বাদ, চন্দ্র- সূর্যগ্রহণ, উল্কা পতনের সম্বন্ধে বিজ্ঞানের জাহেলি যুগে রাসূল (স.) সত্যের যে ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন আজ তা প্রমাণ করে যে, রাসূলের জ্ঞানের উৎস মূল এই পৃথিবীর স্থান-কালের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তাঁর জ্ঞান আলো এসেছে সেই স্থান-কাল সীমানা থেকে যেখানে স্থান-কালের কোনো সীমানা নেই। রিসালাতের চরম মর্যাদা শীর্ষে অবস্থান করে রাসূল (সা.) বিজ্ঞান চর্চার যে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত করে গেলেন তা মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার এক মহাউদ্দীপক শক্তি।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণায় রসূলের অনুপ্রেরণার গভীরতা ফুটে ওঠে নিম্নবর্ণিত একটি হাদিসে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা যে একটি উত্তম ইবাদত, জান্নাতে পৌঁছাবার পাথেয় তা জানা যায় রাসূল (সা.)-এর বক্তব্য থেকে। যেমন- ‘তাফসীরে জওয়াহেরুল কুরআন’-এর লেখক আবদুর রহমান আল জাযায়েরী ‘কিতাবুর রুয়া’তে লিখেছেন, একবার আমি স্বপ্নযোগে রাসূল (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করি। তিনি আমাকে এরশাদ করেন, ‘যারা তিব্ব বা চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষা দেয়, তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, পরকালে তারা আমার সাথে জান্নাতে যাবে।’ (মাসিক মদীনা, ২৩ বর্ষ, দ্বাদশ সংখ্যা)।
উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, বিজ্ঞান চর্চায় মুসলমানদের অংশগ্রহণ সময়ের দাবি তো বটেই, ঈমানেরও দাবি। এ দাবির জবাবে সাড়া দেয়া মুসলিম বিজ্ঞানীদের একান্ত প্রয়োজন।
কুরআনের প্রত্যক্ষবাদী মনোভাব কুরআন অনুসারীদের মনে বাস্তবের প্রতি করেছিল গভীর শ্রদ্ধার সৃষ্টি। তার ফলেই পরিণামে তারা হয়েছিল আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা। একইভাবে যদি আধুনিককালের মুসলিম বিজ্ঞানীগণ হাদীসের প্রতি প্রত্যক্ষবাদী মনোভাব সৃষ্টি করতে পারেন, তবে মুসলিম জাতি হারানো গৌরব ফিরে পাবে।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।