![](images/1715784029Iqbal.jpg)
॥ মনসুর অহমদ ॥
পৃথিবীর মায়াবী কোড়ে যুগে যুগে এসেছে কমল-কোমল হৃদয় নিয়ে মধুর মধুর অধর নিয়ে, আঁখিতে সাগর সাগর তৃষ্ণা নিয়ে অসাধারণ মানবশিশুর দল। তারা ধরণীর রূপ-রস-গগ্ধ-সুধার খোঁজ পেয়েছেন, উপভোগ করেছেন আর সাধারণ মানবকুলকে তার বার্তা শুনিয়েছেন। তারা দেখেছেন এ ধরাতলের সৌন্দর্য শুধুমাত্র বাইরের আঁখি দিয়ে নয়, দেখেছেন অন্তরের চোখ দিয়ে কল্পনার শক্তি দিয়ে। তারা খুঁজে পেয়েছেন প্রতিটি বস্তুর মাঝে গোপন রহস্যের সন্ধান, শুনতে পেয়েছেন প্রতিটি হৃদয়ের মাঝে ক্ষণে ক্ষণে বেজে ওঠা ভালোবাসার আহ্বান। এসব ধূলির ধরণীর দুলালরাই মনের মাধুরী মিশিয়ে শব্দের প্রসূন দিয়ে গেঁথেছেন কথার মালা, সৃষ্টি হয়েছে কবিতা ও গান। এসব কবি সত্য ও সৌন্দর্যের সন্তান, মানবতার অলঙ্কার ও গৌরব। এ শতদলের নিকুঞ্জে ফোটা ফুল কবি ইকবাল বিশ^মানবতার সম্পদ মুসলমানদের অহঙ্কার।
তিনি এলেন কাব্যজগতে বুকে হেরার রোশনি নিয়ে। যখন পৃথিবী বস্তুবাদের কুহেলিকায় আচ্ছন্ন, গণতন্ত্রের জগদ্দলে নিষ্পেষিত, সমাজবাদে মোহাবদ্ধ, নাস্তিক্যবাদের স্রোতে বিশ্ব প্লাবিত, তখন এলেন ইকবাল বুকে উত্তুঙ্গ পর্বতের দৃঢ়তা নিয়ে, অন্তরে এক সাগর ওহিনিষিক্ত জ্ঞানের বার্তা নিয়ে, চোখে অনন্ত মালাকুতি জ্যোতি নিয়ে সব বিশ্বের গৌরব কিরীট রূপে। এ কারণেই মহীশূর টাউন হলে কবির সংবর্ধনা সভায় বলা হয়েছিল ‘The Muslim may claim Dr. Iqbal a million times their property, but he belongs to us all.’
হ্যাঁ, ইকবাল সবার কবি, সাধারণের কবি অসাধরণের কবি, মুটে-মজুর-চাষির কবি, রূপারূপ ভাবের কবি, তিনি নর-নারী সব মানুষের কবি, তনি সাম্য-শান্তি ও মানবতার কবি। তিনি রসিক দার্শনিক কবি। তাঁর কবিতা বারিধি অতলান্ত। এমন ডুবুরি কমই অছেন যাঁরা তাঁর কবিতা পারাবারের অতল তল থেকে মুক্তা কুড়িয়ে শেষ করতে পারেন, এমন সাঁতারু কমই আছেন যারা তার কূলহীন সিন্ধু পাড়ি দিয়ে অপর তীরে পৌঁছতে পারেন।
কবির কবিতা সাগরের অতল গভীরের একটি মুক্তা মাত্র নারী। যা লুকিয়ে আছে কবির পবিত্র কাব্য ঝিনুকের বুকে ওহিবিন্দু আকণ্ঠ পান করে পরিতৃপ্ত হয়ে।
মানব হৃদয়ে প্রেম-প্রীতির মঞ্জুল মঞ্জুষা দিয়েই স্রষ্টা পাঠিয়েছেন এ সুন্দর ধরাতলে তার সুন্দরতম সৃষ্টিকে। নর ও নারীর সৃষ্টি জগতের অপূর্ব ভূষণ, নর ও নারী একে অপরের আশ্রয় স্থল ও প্রেরণার উৎস। যুগ যুগ ধরে নর নারীকে দেখছে নানা রঙে নানা ঢঙে । নারীকে ঘিরে তার সুন্দর ভাবনা কল্পনা প্রকাশ করেছে গুহার গায়ে, পাথরের বুকে। নারীর বিরহে অন্তরে জাগা অব্যক্ত বেদনার সুর ও ছবি এঁকেছে তুলিতে, বাজিয়েছে বাঁশিতে। কবিদের হৃদয় সরোবরে নারীর প্রেম কমল ফুটেছে যুগে যুগ। পাওয়া না পাওয়ার অনন্দ-বেদনার তরঙ্গাঘাতে ও কমলে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে ক্ষণে ক্ষণে। সৃষ্টি হয়েছে কাব্য-গান। কবি নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি প্রাণ
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
বাঙালি কবির এ কথা যথার্থ। আমরা দেখি ইংরেজ কবি কিটস ফ্যানি ব্রনকে নিয়ে লিখেছেন তার প্রেম ও বিষাদপূর্ণ কবিতা, বায়রন রচনা করেছেন ডন জুয়ান কাব্য, যাতে রয়েছে কাম ও তৎকালীন জীবন প্রসঙ্গ ইতালির কবি এরয়াত্রিকে উদ্দেশ করে কবিতা রচনা করেছেন। বেক্কাচিও গিয়োভানি ‘মারিনা দাকিনো’-এর প্রেমে মুগ্ধ হয়ে রচনা করেন...প্রভৃতি।
একইভাবে আরবী কবি জমীল ইবনে ম’মর আল উযরী তার প্রিয়া বুসায়না কে নিয়ে তার কবিতা রচনা করেন। নারী সৌন্দর্যেও উপাসক উমর ইবনে আবী রাবিয়াহ রূপসী মহিলা দেখলেই তার নিকট কবিতার মাধ্যমে প্রেম নিবেদন করতেন। ফারসি কবি নিযামী রচনা করেন খসরু ও শিরীন ও লায়লা মজনু রোমান্স কাব্য। এভাবে সাহিত্যজগতের অনেকে নারী প্রেমে মাতায়ারা হয়ে কেউ বা নারী হৃদয়ের প্রেম ও দেহকান্তির সৌন্দর্য রসে আপ্লুত হয়ে রচনা করেছেন যুগে যুগে কাব্য সাহিত্য। কলিদাসের মেঘদূত-এ ফুটে উঠেছে নরীর দেহ সৌন্দর্য ও অন্তরের আকুতি, বাল্মীকির মহাকাব্য রামায়ণে ফুটে উঠেছে এক নারীকে ঘিরে সত্যের বিজয়াভিযানের গৌরব দীপ্তি।
আপামর কবির কবিতা নারীর প্রেম সৌন্দর্য প্রকাশিত- এ কথা ঠিক নয়। ধরণীর কাব্য মেলায় অনেক কবি সাহিত্যিকের সমাবেশ ঘটেছে যাদের কাব্যসম্ভার উজ্জ্বল ভাস্করসম আনন্দ জ্যোতি বিকিরণ করে চলেছে; যা সৃষ্ট নয় নর-নারীর আপতমধুর দেহজ প্রেমের ফসল রপে। এ দলের একজন কবি আল্লামা ইকবাল।
ইকবাল তাঁর কাব্যে স্রষ্টার প্রেম নির্ভরতা, বিশ্বপ্রেমের অতলান্ত প্রাণস্পর্শী অনুভূতিগুলোকে পবিত্র ভাব রসে স্নাত করে উজ্জ্বল আসমানী নূরালোকে আলোকিত করেছেন তাঁর কাব্যে। কবির কাব্যে নারী এসেছে দেহজ প্রেমের বেসাত হিসেবে নয়, আত্মজ প্রেমের ফসল ও ধরিত্রীর কল্যাণী রূপে আসন পেয়েছে নারী। শুধুমাত্র শিল্পরসে পাঠককুলকে রসসিক্ত করার মানসে হাজির করেননি তাঁর কবিতাঙ্গনে, যেমন কবি নিযামী ব্যক্তি লায়লাকে ঘিরে মজনুন এর আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেন,
‘বাতাসে যদি বা তোমার শ্বাস না থাকে,
নিব না এ শ্বাস, বলগো এ কথা তাকে।
তোমার শ্বাসেই আমার জীবন বাঁচে,
আমার জীবন তোমার মাঝেই আছে।’
কিন্তু ইকবাল তাঁর কাব্যে লায়লাকে অধিষ্ঠিত করেছেন রূপসী ব্যক্তি লায়লা বা প্রেমিকা লায়লা হিসেবে নয়, বরং লায়লা এসেছে সমগ্র নারী জাতির প্রতীক রূপে। কত সুন্দর এ প্রতীক চয়ন, যে প্রতীকের মাঝ দিয়ে গর্জে উঠেছে জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে হুঙ্কার, আহ্বান এসেছে সত্য প্রতিষ্ঠার। যখন পশ্চিমা নগ্ন সভ্যতা নারীর ইজ্জত-আব্রু নিয়ে খেলছে, পর্দার বিরুদ্ধে উন্নাসিকতার সয়লাব বয়ে চলছে তখন কবি সোচ্চার হলেন প্রতীকি লায়লাকে ঘিরে। কবি গেয়ে উঠলেন,
‘ উহ তো দেওয়ানা হ্যাঁয় বসতি মে রাহে ইয়া রা রাহে,
ইয়ে জরুরি হায় হিজাবে রুখে লায়লা না রাহে।
‘পশ্চিমা নগ্নতাবাদীরা পাগল হয়ে উঠেছে ‘লায়লা’কে অন্দর থেকে বন্দরে বের করার জন্য। চক্রান্ত চলছে পর্দা ও সৌন্দর্য নিরাপত্তাকে মুছে ফেলার। ’ এ লায়লা নিযামীর সৃষ্ট কয়েসের লায়লা নয়, এ লায়লা সমস্ত নারী জাতির প্রতীক। এভাবে কবি লায়লাকে তাঁর বিভিন্ন রচনায় হাজির করেছেন নারী জাতির প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব হিসেবে। চেতনা বিহীনদের চেতনা জাগাতে নারী পক্ষের জয়গান গেয়ে লিখলেন,
‘দরদে লায়লা ভি ওহী, কয়েস কি পাহলু ভি ওহী,
নজদ কি দশতে জাবাল মেঁ রামে আহুঁ ভি ওহী।
-তিনিই লায়লার প্রেম, তিনিই কয়েসের বাহু শক্তি। তিনি নজদের মরুদ্যানের পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান হরিণীর চোখের সৌন্দর্য। কবির ‘লায়লার’ এ উপমায় পাঠকের চিত্ত ধায় চির সুন্দরের অনুসন্ধানে।
কবি ‘লায়লা’ তথা নারীর প্রেমরসে আকণ্ঠ ডুবে জীবনের গতি হারিয়ে ফেলার দলে নন। তিনি বক্তি প্রেমকে অতিক্রম করে মানব প্রেমের আকর্ষণে সামনে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার দলের নির্ভীক ব্যক্তিত্ব। নারীরা পরশে প্রেমের আবেশে নিশ্চুপ নিথর না হয়ে অন্তরে গতির আবহ নিয়ে জোর কদমে সামনে আরও সামনে যাওয়ার গান শুনিয়েছেন। যে মানবপ্রেম জাতির গতিকে থামিয়ে দেয় তা কবির অপছন্দনীয়। তাই তিনি গেয়ে উঠলেন-
‘ তু রাহে না ওয়ারদে শওকে হায় মনযিল না কর কবুল,
লায়লা ভি হামনাশী হো তো মাহফিল না কর কবুল।
- প্রেমের পথের পথিক তুমি
কোনো মনযিলে নিও না বিশ্রাম
লায়লা তোমার পার্শচরী হলেও উটের হওদায় করো না আরাম।’
(অনুবাদ- আ. মান্নান তালিব)
একই কথা কবি বলেছেন ‘যবুর-ই-আজম’এ-
‘হোক দুনিয়া মন্দ ভালো
হাস্য ভরে এগিয়ে যাও;
কুলায়, খাঁচা ফাঁদ অথবা
কৃষ্ণ ফেলে হও উধাও।
প্রেমের প্রতীক লায়লাকে গোটা নারী জাতির প্রতিনিধি রূপে বাংলার বুলবুল কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কাব্যে নজরানা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন-
সাপিনীর মত বেঁধেছে লায়লী কয়েসে গো,
বাহুর বন্ধে চোখ বুঁজে বধু আয়েসে গো।
(ঈদ মোবারক)
নারীর রূপ সৌন্দর্যেও বর্ণনা দিয়েছেন বিভিন্নজনে বিভিন্নভাবে। ফারসী কবি দাকিকী তাঁর কাব্যে নারীর রূপ বর্ণনা করত গিয়ে লিখেছেন,
তোমার চুলের মতো কালো এই রাত
তোমার মুখের মতো দীপ্ত এই দিন।
তোমার ঠোঁটের ঐ সুদৃশ্য চত্বরে
শিল্পীর সৌন্দর্য ভরা মুক্তোর বিস্ময়।
যেখানে কবি দাকিকী নারীর বিভিন্ন অঙ্গের সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন প্রকৃতির বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর বস্তুর সাথে তুলনা করে, সেখানে কবি ইকবাল নারী সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন স্বর্গীয় আভায়। তিনি লিখলেন,
‘নারীর অস্তিত্বেই রঙানো বিশ^ জাহানের ছবি
তারি সুরে উত্তপ্ত জীবনের হৃৎপিণ্ড
তার এক মুঠো মাটি সম্মানিত সপ্তর্ষির চেয়েও
কেননা সব সম্মান ঐ মূল্যবান মোতির।
(জরবে কলিম)
ইকবাল তাঁর কাব্যে নারীর ব্যপারে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন মার্জি ও সুরুচিবোধসম্পন্ন শৈলীতে। এ লেখার মধ্য দিয়েই ইসলাম ও নরীর প্রতি কবির আন্তরিকতা ও মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে সুন্দর ভাবে। তিনি লিখেছেন,
‘মাতৃত্ব তো আল্লাহর রহমত
যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নবুয়্যতের সথে।
যার জন্য আল্লাহ বলেছিলেন, সৃষ্টি হোক জীবন,
তিনি ঘোষণা করেছেন, মায়ের পায়ের নিচে বেহেশত ।
-------------------
ধরুন কেন অজ্ঞ গেঁয়ো কৃষক রমণীর কথা।
কদাকার, স্থূলদেহী, অশিক্ষিত, অভব্য,
সরল সাদামাটা তার জীবন।
স্বপ্নশূন্য,
মাতৃত্বের যাতনা তার হৃদয়কে ছিন্ন ভিন্ন করেছে।
বিষণ্ন মলিন মুখ, চোখের নিচে তার পড়েছে কালি . . .
যদি তার কোল থেকে উম্মাহ লাভ করে
কোন এক উৎসাহী ঈমানদার মুসলিম বান্দা,
তা হলে বলতেই হবে-
সে মায়ের বেদনা আমাদের সত্তাকে সুরক্ষিত করেছে।
তার সূর্যাস্তের ঔজ্জ্বল্য ঝলসে ওঠে
আমাদের সূর্যোদয়ের সোনালী কিরণ।
এখন আসুন ঐ রমণীর কথায়-
ছিপ ছিপে গড়ন, কোল খালি, চোখেমুখে বিদ্রোহের ছাপ,
চিন্তা চেতনায় সে পাশ্চাত্যের প্রভাবের অধীন।
তা হলে সে রমণী নয়।
যে বন্ধন আমাদের সমাজকে নিরাপদ রেখেছে,
তাকে এই ব্যক্তি ধ্বংস করে দিয়েছে।
তার লাগামহীন যাতায়াত উস্কানি মূলক
গোপন সৌন্দর্য তার উদোম হয়ে গেছে,
বিনয় ও নম্রতাহীন চোখ দুটি র্স্পধায় জ¦লছে।
তার যে শিক্ষা দীক্ষা তাতে সে মায়ের দায়িত্ব
বহনে অক্ষম; সত্যিই দুর্ভাগা এই নারী ।
আমাদের বাগানে ফুলটি না ফুটলেই ভাল ছিল
ভাল হতো সমাজদেহে এমন অলংকার না থাকলে;
. . . . . . . . .
সতী সাধ্বী ফাতিমাই আদর্শ নমুনা।
সকল প্রাণী তাঁর আদেশ মানতো।
তবুও তিনি তাঁর সব ইচ্ছাই
সোপর্দ করেছিলেন মহৎ স্বামীর খাহেশের কাছে
লজ্জা ও সষ্ণিুতা ছিল তাঁর উজ্জ্বল ভূষণ।
আর তাঁর ঠোঁটে উচ্চারিত হতো আল্লাহর বাণী,
এ ভাবেই ঘরের কোণে ফাতিম যাঁতা পিষতেন।
. . . . . . . . .
ধুরন্ধর ধান্দাবাজ বর্তমান দিনকালের মানুষ;
এ যুগে ডাকাত ছিনিয়ে ধ্বংস করে ফাতিমার ঐশ^র্য।
যার মগজে আল্লাহর চিন্তা নেই সে অন্ধ।
নির্লজ্জরাই শুধু যুগের শিকারে পরিণত হতে পারে
এ যুগের বেলাগাম দৃষ্টি নিজেকে মুক্ত ভেবে বিভ্রান্ত হয়।
হে নারী তুমি সংরক্ষক,
আমাদের জাতির যা পুঁজি সম্ভ্রমকে বাঁচাও।
আমাদের শিশুরা তোমার বুকের দুধ খেতে খেতে
প্রথম তোমার কাছেই শেখে, আল্লাহ ছাড়া মা’বুদ নাই;
আমাদের মুরব্বিরা যে পরিচিত পথে চলে গেছেন,
তার অনুসরণেই সন্তুষ্ট থেকো।
লাভ-ক্ষতির হিসাব কষতে ব্যতিব্যস্ত হয়ো না।
যুগের অভিশাপ থেকে সতর্ক হও।
আর তোমার প্রসারিত বক্ষে জড়িয়ে ধর সন্তানদেরকে।
বাচ্চারাতো সবুজ চত্বরে বিচরণরত মুরগীর শাবক ।
উড়তে চাইলেও তাদের পাখা নাই;
তাদের উষ্ণ নীড় থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে;
তোমার আত্মার আকুতি শোন,
সময় থাকতে সচেতন হও
তোমার মডেল ফাতিমা দেখে ।
তবেই তো তোমার ঘরে আসবে নতুন হোসেন।
আমাদের বাগানে তখন সোনালী যুগ আসবে ।
(অনুবাদ -মীযানুল করীম)
বিভিন্নকালে বিভিন্ন দেশে নারীকে নিয়ে কবিতা লিখতে গিয়ে নারীর রূপ-সৌন্দর্য ও মাংসের গুণাগুণ গেয়েছেন বিভিন্নভাবে। তাতে নারীর মর্যাদা বাড়েনি বরং কমেছে। ও সব লেখা পড়ে মনে জাগে হালের এক কবির কথা-
যারা প্রতিদিন শিল্পের নামে প্রেমের ভিক্ষা মাগে
তাদের দুস্থ হৃদয়ে কেবলই পশুর তৃষ্ণা জাগে।
মৃত্যুর আগে হয় না মরণ কামনার নিবৃতি
প্রেমের প্রসূন ছাই হতে থাকে মাংসের অনুরাগে।
(বুলবুল সরোয়ার)
কিন্তু ইবালের কবিতা এমন সব নোংরামি থকে মুক্ত। ইকবাল তাঁর রচনায় নারীর সম্মানকে বাড়িয়ে তুলেছেন আকাশছোঁয়া। যেমন লিখেছেন,
‘মরিয়ম আজ নিসবতে ঈসা আজিজ
আজ সেহ নিসবত হযরত জোহরা আজিজ
নূরে চশমে রহমাতুল্লি আ’লামীন
আঁ ইমাম আউয়ালিন ওয়া অখেরিন-
-কেবলমাত্র ইসার কারণে মরিয়ম খ্যাতি
ত্রিবিধ কারণে মহামান্বিতা ফাতিমা খ্যাতি
বিশ^ আশীষ পয়গম্বরের নয়ন মনি,
নবীন প্রবীণ নবী ওলীদের ইমাম যিনি।
ইকবালের শিল্প সুন্দরের জন্য, জীবনের জন্য, আদর্শের জন্য। তাঁর উপলব্ধির গভীরতা অধিক, যে কারণেই তাঁর কবিতায় ভাষা-ছন্দ ছড়িয়ে গেছে দেশ কালের সীমানা অতিক্রম করে। তিনি লিখলেন-
‘শফকতে উহ শফকতে পয়গম্বারাস্ত,
সিরতে আকওয়ামে বা ছুরতি গরস্ত।
-মমতা মাতার, নবীর স্নেহ পুণ্যময়
জাতির স্বভাব গঠন কর্তী সে অক্ষম।
কবির এ লেখায় নারীর উপস্থিতি পুণ্যময়ী সত্তা হিসেবে। কিন্তু যখন পড়ি-
‘নগরের নটি চলে অভিসারে যৌবন মদে মত্তা।
অঙ্গে আঁচল সুনীল চরণ
রুণু ঝুনু করে বাজে আবরণ
সন্ন্যাসী গায়ে পড়িল চরণ থামিল বাসবদত্তা।’
তখন নারীসত্তা পুণ্যময়ী হিসেবে শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম হয় না। এ কারণেই ইকবালের নারী ও অন্যসব কবিদের নারীর মাঝে তফাৎ প্রচুর। তার কবিতায় পাওয়া যায় ব্যক্তি সত্তার সীমাতিক্রম এক আন্তর্জাতিক সুর। যে সুরের মাঝ দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে ঐশী সঞ্জাত প্রজ্ঞার শিক্ষা। তাই তিনি নারীকে নিয়ে লিখতে পারলেন-
‘ঊর্ধ্ব গগন বহু রঙ বদলালো
এ দুনিয়া খোদা সেখানেই আছে যেখানে ছিলো
নর ও নারীর মাঝে প্রভেদ দেখিনি
সেও নির্জনবাসী এও নির্জন বাসিনী -
এখনো পরদায় ঢাকা আদমের আওলাদ
কালের খুদীর প্রকাশ হয়নি অবাধ।
নারীর পূর্ণত্ব প্রেম শূন্য হৃদয় নয়, সন্তান শূন্য কোল নয়, যখন আধুনিক সভ্যতা সমঅধিকার ও নারী স্বাধীনতা নাম প্রেমশূন্য হৃদয় সন্তানশূন্য কোলের দাবি জানাচ্ছে তখন কবি তাদের এ দাবির অসারতা ও ভ্রান্তি তুলে ধরেছেন জাতির সামনে-
‘ কে জিজ্ঞেস করবে ইউরোপের দার্শনিককে
গ্রীস ও হিন্দুস্তান দলভুক্ত যার ,
পুরুষ নিষ্কর্মা আর নারীর হৃদয় শূন্য
এই কি পূর্ণতা সমাজ সভ্যতার?
(জরবে কালিম)
ইকবালের কবিতায় নারী হাজির হয়েছে জীবনের গতিশক্তির উৎস হিসেবে। তিনি লিখলেন-
‘আজ উমুমত গরম বকতারে হায়াত
আজ উমুমত কাশাফে আসরারে হায়াত।’
- মাতৃত্ব সে তপ্ত রাখে জীবন গতি
মুক্ত করে জীবন পথের গুপ্ত নীতি।
‘ইকবালের কাব্যে নারী’ এ আলোচনায় দেখা যায় ইকবালের কবিতায় কালানুক্রমিক পরিণতির ধারা অনুপস্থিত যা অনেক নামি দামি কবির লেখায় অবর্তমান। অনেক কবির প্রথম অবস্থার কবিতায় আছে সৌন্দর্যবোধের তীব্রতা যা কালানুক্রমে পরিণত হয়েছ ভোগ বিরত সরল গ্রাম্য সৌন্দর্যে, যার শেষ পরিণতি সৌন্দর্যের ‘কল্যাণী মূর্তি’ রূপ ধারণে। কিন্তু ইকবালের কবিতায় দেখা যায় বিবর্তন ক্রিয়ার কালানুক্রমিকতা উপেক্ষা করে নারী সর্বত্রই উপস্থিত হয়েছে কল্যাণী রূপে। এখানেই কবি ইকবালের নারী অন্য নারীদের থেকে অনেক বেশি মযর্দার অধিকারিণী। আর এক্ষেত্রে ইকবাল পৌঁছে গেছেন অন্য সব কবিদের ছেড়ে স্বর্গের কাছাকাছি।