রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ১ম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ৮ চৈত্র ১৪৩০ ॥ ১১ রমজান ১৪৪৫ হিজরী ॥ ২২ মাচ ২০২৪

॥ মাসুম খলিলী ॥

তুরস্কে এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে জল্পনা বেশ জমে উঠেছে; বিশেষ করে বৃহত্তম নগরী ইস্তাম্বুল ও রাজধানী আঙ্কারার মেয়র কে হবেন, সেটি নিয়ে। তবে এর চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে দেশটির দুই যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা রজব তৈয়ব এরদোগানের রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার বার্তা নিয়ে। এমন কথাও অনেকেই বলছেন, তিনি কি সত্যিই তুর্কি রাজনীতি ও ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবেন? এরদোগানের ভক্তরা জানেন যে, তাদের প্রেসিডেন্ট মিথ্যা বলেন না। তবে কথা বলা ও বাস্তব কাজে তিনি বেশ কৌশলীও। বর্তমান সংবিধান অনুসারে এরদোগান তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচন করতে পারবেন না। কিন্তু এ সংবিধান পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট থাকার ক্ষেত্রে দুইয়ের জায়গায় তিন করা সম্ভব। এরদোগান সেটি করবেন বলে মনে হয় না তার কথা বলার ধরন দেখে। সে যাই হোক, আজকের মূল বিষয় আগামী ৩১ মার্চ অনুষ্ঠেয় তুরস্কের স্থানীয় সরকার নির্বাচন।আগের সাফল্য ও এবারের অবস্থা৩১ মার্চ ২০২৪ তারিখে তুরস্কের ৩০টি মেট্রোপলিটন, ১ হাজার ৩৫১টি জেলা পৌর মেয়র এবং ১ হাজার ২৫১টি প্রাদেশিক ও ২০ হাজার ৫০০টি পৌর কাউন্সিলর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগের নির্বাচনে রজব তৈয়ব এরদোগানের নেতৃত্বাধীন একে পার্টি ৭৪২ মেয়র, ১০ হাজার ১৭৩ কাউন্সিলর, ৪৪.৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। গত নির্বাচনে কামালপন্থী বিরোধীদল সিএইচপি ২৪০ মেয়র, ৪ হাজার ৬১৩ কাউন্সিলর, ৩০.১২ শতাংশ ভোট পায় আর মেরাল আকসেনার নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী গুড পার্টি ২৪ মেয়র, ১ হাজার ৯২ কাউন্সিলর, ৭.৪৫ শতাংশ ভোট লাভ করে। ডেভলেট বাহচেলির জাতীয়তাবাদী সরকারি জোট শরিক এমএইচপি ২৩৩ মেয়র, ২ হাজার ৮১৯ কাউন্সিলর এবং ৭.৩১ শতাংশ ভোট পান। একই নির্বাচনে পিকেকেপন্থী বলে কথিত কুর্দিদের ডেম পার্টি ৫৭ মেয়র, ১ হাজার ২৯৩ কাউন্সিলর, ৪.২৪ শতাংশ ভোট লাভ করেন আর ইসলামিস্ট সাদাত পার্টি ২১ জন মেয়র, ২৯৮ কাউন্সিলর, ২.৮৪ শতাংশ ভোট পায়।গতবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, দেশের তিনটি প্রধান মেট্রোপলিটন শহর ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা ও ইজমিরে বিরোধীদল সিএইচপি জয়ী হয়েছিল। এর মধ্যে ইস্তাম্বুলে সিএইচপি জয় পায় ২৫ বছর ধরে একেপি এ শহরটি দখলে রাখার পর। আঙ্কারাও একসময় একেপির নিয়ন্ত্রণে ছিল কিন্তু ইস্তাম্বুলের আগেই রাজধানী শহরটি হাতছাড়া হয়ে যায় একেপির। তুরস্কের ইউরোপীয় শহর ইজমিরে সবসময় সেক্যুলার সিএইচপির প্রাধান্য বজায় ছিল, এখনো তার ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা কমই রয়েছে।এবার এরদোগানের উত্থানের স্মৃতিময় আপন শহর ইস্তাম্বুল যদি শাসকদল নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে, সেটি তাদের জন্য বড় সাফল্য হতে পারে। ইস্তাম্বুলে ক্ষমতাসীন একে পার্টি প্রার্থী সাবেক পরিবেশমন্ত্রী মুরাত কুরুম এবং বর্তমান মেয়র একরেম ইমামোলু নেক টু নেক ফাইটে আছেন। ছয়টি জরিপ সংস্থার জরিপে দেখা গেছে যে, শীর্ষ দুই প্রতিযোগী, সাবেক পরিবেশ ও নগরায়ণমন্ত্রী কুরুম এবং প্রধান বিরোধীদল সিএইচপির ইমামোলুর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে।ডি-এন রিসার্চের জরিপ অনুসারে, কুরুমের ৩৮.২ শতাংশ সমর্থনের তুলনায় ইমামোলু ৪৩.৮ শতাংশ সমর্থনে এগিয়ে রয়েছেন। আর সোনার বাংলা রিপোর্ট করেছে, ইমামোলুর সমর্থন যেখানে ৪১.৯ শতাংশ সেখানে কুরুমের সমর্থন ৪১.৩ শতাংশ। ওআরসি রিসার্চ কুরুমকে ইমামোগলুর বিরুদ্ধে ৩৬.৫ শতাংশ ও ৩৭.৭ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন বলে দেখিয়েছে। ইউরোপ ইলেক্টসের সমষ্টিগত জরিপ অনুসারে, একেপি প্রার্থি সিএইচপির বর্তমান মেয়র একরেম ইমামোলুর থেকে এক শতাংশ এগিয়ে রয়েছেন, যিনি ৩৭ শতাংশ ভোটারের সমর্থন পেতে পারেন। গত মে মাসের সাধারণ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে প্রকাশিত সুপ্রিম ইলেকশন কাউন্সিলের (ওয়াইএসকে) পরিসংখ্যান অনুসারে, ১ কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যার ইস্তাম্বুলে ১ কোটি ৫ লাখেরও বেশি যোগ্য ভোটার রয়েছে।গত নভেম্বরে দলীয় নির্বাচনে ইমামোলুর সমর্থনে নির্বাচিত দলীয় প্রধান ওজেল আরেকটি জোট গঠনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু আইপি ও ওয়াইএসপি উভয়ই সিএইচপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সব বিরোধীদল ইস্তাম্বুলে তাদের নিজস্ব মেয়র প্রার্থী নিয়ে মাঠে নামছে, যেটি কার্যকরভাবে ভোট কমিয়েছে ইমামোলুর জন্য। এছাড়া ইমামোলু একটি মামলার আইনি লড়াইয়ে রয়েছেন, যা তাকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করতে পারে। এর বাইরে তার অফিসের সাথে যুক্ত পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ক্রমবর্ধমান ঘটনা, দুর্ঘটনা ও ভাঙনের কারণে সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছেন তিনি।কুরুমের প্রচারাভিযান এখন পর্যন্ত ভূমিকম্প-প্রবণ ইস্তাম্বুলের শহুরে রূপান্তরের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে, যে শহরটি ভূমিকম্পের একটি বড় ফল্ট লাইনে পড়েছে। এর পাশাপাশি গণপরিবহনকে শক্তিশালী করা এবং প্রযুক্তিগত ও সামাজিক অবকাঠামোকে শক্তিশালী করা তার অন্যতম অঙ্গীকার।ইমামোলুও শহরকে অতিক্রম করে একাধিক নতুন মেট্রো লাইন, আরও সবুজ স্থান, বর্জ্য থেকে শক্তি প্রকল্প এবং দুর্যোগ ও সংকটের বিরুদ্ধে একটি ‘মজবুত ইস্তাম্বুল’-এর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।ইস্তাম্বুলের পরে রাজধানী আঙ্কারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার। তুর্কি বিরোধীরা আসন্ন স্থানীয় নির্বাচনে রাজধানী আঙ্কারায় তাদের ২০১৯ সালের নির্বাচনী সাফল্যের পুনরাবৃত্তি পাবেন বলে আশা করছেন। বিভিন্ন জনমত জরিপে দলের প্রার্থী, বর্তমান মেয়র মনসুর ইয়াভাস স্বস্তিকর ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। ইউরোপ ইলেক্টসের সমষ্টিগত জরিপ অনুসারে ইয়াভাস ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতবে বলে অনুমান করা হয়েছে সে তুলনায় একেপি প্রার্থী ৯ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছেন। অবশ্য একেবারে সাম্প্রতিক জরিপে দুই প্রার্থীর ব্যবধান একেবারে ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে এসেছে বলে জানা যাচ্ছে। ফলে আঙ্কারায় জনপ্রিয় মেয়রের বিরুদ্ধে একেপির জয় কঠিন হলেও একেবারে অসম্ভব কিছু নয়।রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণএবারের পৌর নির্বাচনের আগে তুরস্কের রাজনীতিতে নানা ধরনের মেরুকরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। এটি শাসক জোটের ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে, তেমনি বিরোধী জোটেও। বিরোধী সিএইচপি-তে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবার তুরস্কের প্রাচীনতম দলের সমর্থক ঘাঁটির মধ্যেও জনমতকে প্রভাবিত করেছে। কুরুমের প্রতি একে পার্টির পিপলস অ্যালায়েন্স পার্টনার ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির (এমএইচপি) সমর্থন থাকলেও, ইমামোলু অনানুষ্ঠানিকভাবে জাতীয়তাবাদী গুড পার্টি (আইপি) এবং পিকেকে-অনুষঙ্গী সবুজ বাম দল (ওয়াইএসপি) এর মতো সাবেক মিত্রদের সমর্থন নেই।পৌর নির্বাচনের তিন সপ্তাহ আগে শাসক জোট পিপলস অ্যালায়েন্স এবং নিউ ওয়েলফেয়ার পার্টির সম্পর্ক আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বর্তমান নির্বাচনী চক্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ছিল বিরোধীদলগুলো এবার নিজস্ব প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা প্রধান বিরোধীদল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) সাথে ২০২৩ সালের মে মাসে জোট গঠন করেছিল।গুড পার্টির চেয়ারম্যান মেরাল আকসেনার, সিএইচপির ক্রমবর্ধমান সমালোচনা এবং তার দল থেকে বেশ কয়েকটি পদত্যাগের মুখেও একসময় জোটের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এখন তিনি আলাদাভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করছেন। একসময়ের বিরোধী জোটের শরিক ভিক্টোরি পার্টি (জেডপি), ডেমোক্রেসি অ্যান্ড প্রগ্রেস পার্টি (দেভা), ফেলিসিটি পার্টি (এসপি), ফিউচার পার্টি (জিপি) এবং হোমল্যান্ড পার্টি (এমপি) তাদের নিজস্ব মেয়র প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে ডেম পার্টি নামে পরিচিত পিকেকেপন্থী গ্রিন লেফট পার্টি (ওয়াইএসপি) তাদের নিজস্ব প্রার্থী দিয়েছে। যদিও দলটি সিএইচপির সাথে একটি জটিল এবং গোপন জোট গঠন করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে ইস্তাম্বুলে তাদের ঘোষিত মেয়র প্রার্থী প্রচারণা না চালানোর কারণে।বিরোধীদলগুলো তাদের ‘তৃতীয় উপায়’ পদ্ধতির কথা বললেও ঘুরেফিরে শাসক জোট ও প্রধান বিরোধীদলের সমালোচনা করে প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে তাদের যুক্তি সফলভাবে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আবহাওয়া তৈরি করেছে এমনটি বলা যায় না। এর বিপরীতে সিএইচপি নেতৃত্ব তাদের নিজ নিজ সমর্থকদের জয় করার প্রয়াসে তাদের সাবেক মিত্রদের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকছে। ‘তৃতীয় উপায়’ পদ্ধতিটি শুধু বিরোধীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তুরস্কের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি ছিল একে পার্টির রাষ্ট্রপতি প্রার্থী রজব তৈয়ব এরদোগানকে সমর্থন করা নিউ রিপাবলিকান পার্টি (ওয়াইআরপি)। দলটি ২০২৩ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট পদে এরদোগানকে সমর্থন করে সংসদে তার নিজস্ব সংসদীয় প্রার্থী দাঁড় করায়। বিরোধীদলগুলোর বিপরীতে ওয়াইআরপি সেই অংশীদারিত্ব থেকে উপকৃত হয়েছে এবং ২.৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে।এবার একে পার্টি তার শর্তে রাজি হয়নি বলে ওয়াইআরপি তার নিজস্ব মেয়র প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লক্ষণীয় যে, দলটি একে পার্টির সাবেক রাজনীতিবিদদের বিপুলসংখ্যককে মনোনয়ন দিয়েছে। তবে তাদের সিদ্ধান্ত হল একে পার্টি সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে যথাযথ সম্মান জানানো। একে পার্টি এ পদ্ধতিতে খুশি হওয়ার কথা নয়। একক জোটের বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে কিছু স্তরের অস্থিরতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। তবে নিউ ওয়েলফেয়ার পার্টি এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা স্পষ্টভাবে সিএইচপির উপকারে আসে।প্রত্যাশিত হিসেবে প্রেসিডেন্ট এরদোগান পিপলস অ্যালায়েন্স বেসকে ওয়াইআরপি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। একে পার্টির প্রাদেশিক প্রচারণা পরিচালকদের একটি সাম্প্রতিক সমাবেশের পর এ ধরনের প্রথম বিবৃতি এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘অনেক জায়গায় (ওয়াইআরপি) এমন প্রার্থীদের মাঠে নামিয়েছে যারা হয় আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অথবা আমাদের বিরোধিতা করেছে।’অন্য কথায় তুর্কি রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব পথে যাওয়ার পছন্দকে সম্মান করেন। কিন্তু অন্য আন্দোলনগুলোকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। তিনি চান না যে একে পার্টির জন্য ব্যয়বহুল হতে পারে এমন রাজনীতির একটি ব্র্যান্ড, তার আন্দোলনের কাছাকাছি প্রতিষ্ঠিত হোক, সে দলটি পিপলস জোটের অংশ। এভাবে একে পার্টি এবং নিউ ওয়েলফেয়ারের মধ্যে এখন লাইন পরিষ্কার হয়ে গেছে।প্রধান বিরোধীদল গত নভেম্বরে তার চেয়ারপারসনকে প্রতিস্থাপন করেছে। তবে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়াটি নতুন নেতৃত্বের ‘পরিবর্তন’ এজেন্ডাকে ছাপিয়ে গেছে। এ সময়ে বিরোধীদলে একটি গ্রুপের মধ্যে বিরোধকে দলের প্রধান ওজেল, যাকে ‘অসন্তুষ্ট কয়েকজন’ বলে অভিহিত করেছেন। বাস্তবে এসব ভিন্নমতাবলম্বী ৩১ মার্চ রাতের ফলের জন্য অপেক্ষা করছে। সাবেক সিএইচপি চেয়ারম্যান কামাল কিলিকদারোগলু রাজনীতি থেকে অবসর নেননি, ফলে স্থানীয় সরকারের যে কোনো বিপর্যয়কর ফলে তিনি আবার ১ এপ্রিল সহজেই প্রত্যাবর্তন করতে পারেন।ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা ও ইজমিরসহ ১১টি মেট্রোপলিটন পৌরসভা হারানোর ভয় প্রধান বিরোধীদলকে তার ২০১৯ সালের ঐক্যের ভিত্তি খুঁজতে বাধ্য করে। ২০১৯ এবং ২০২৩ সালের জোট বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় শাসক জোটের সম্ভাব্য বিজয়ের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াইয়ের আবহ এখন নেই।এদিকে প্রেসিডেন্ট এরদোগান সিএইচপিকে এমন একটি রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে চিত্রিত করেছেন যেটি অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত রয়েছে। ইতোমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়া এরদোগান বিরোধিতা সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনার কারণে তার অবশিষ্ট শক্তি হারিয়েছে। অধিকন্তু সিএইচপি সদস্যরা নিজেরাই নিজেদের আন্দোলনকে ‘খণ্ডিতকরণ’ ও ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ বলে অভিযুক্ত করে।কিলিচদারুগলু সিএইচপি প্রধান থাকাকালে ‘ছয় এর জন্য টেবিল’ গঠন করেছিলেন। এর ফলে বিরোধী জোট ২০২৩ সালের মে মাসের নির্বাচনে ইস্তাম্বুলে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। ইমামোলু ২০১৯ সালের মতো একই প্রচারণা চালাচ্ছেন, কিন্তু পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে। অবশিষ্ট বিরোধীদলগুলো তাদের ভোটারদের ধরে রাখলে ইমামোলুর ভোট কমে যেতে পারে। ইস্তাম্বুলে জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীল ভোটার নির্বাচকদের ৫৫ শতাংশেরও বেশি। ফলে পিপলস অ্যালায়েন্স প্রার্থী এবং পরিবেশ, নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাবেক মন্ত্রী মুরাত কুরুম ইস্তাম্বুলকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে দিয়ে জয়ী হতে পারেন।৩১ মার্চ স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল ইস্তাম্বুলের ওপর নির্ভর করতে পারে। বিশেষ করে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারায় একে পার্টির বিজয় বিরোধীদের ওপর উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। এর বিপরীতে যদি বিরোধীদল ইস্তাম্বুলকে সুরক্ষিত করে, তবে এটি মধ্যমেয়াদি রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি করতে পারে।এরদোগান কি বিদায় নিচ্ছেন?তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান ঘোষণা করেছেন যে, স্থানীয় ব্যালটের আসন্ন রাউন্ড তার জন্য ‘চূড়ান্ত’ নির্বাচন হবে। তুরস্কের প্রতিটি শহর, প্রদেশ ও পৌরসভার নাগরিকরা ৩১ মার্চ মেয়র এবং কাউন্সিলর নির্বাচনের জন্য ভোট দিচ্ছেন। এরদোগানের বক্তব্য অনুযায়ী আইন অনুসারে, এ নির্বাচনই তার শেষ নির্বাচন। এটিই হবে শেষ ভোটÑ যাতে তিনি প্রচারে জড়িত থাকছেন। একেপি ২০০২ সালে ক্ষমতায় আসার পর এর প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা এরদোগান দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক দশকের বেশি সময় পার করেছেন। এরপর ২০১৪ সাল থেকে তিনি তুরস্কের নির্বাহী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।এরদোগান বলেছেন যে, ‘স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের পরিকল্পনার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। এ নির্বাচনের ফলাফলটি হবে তারপর আসা ভাইদের কাছে উত্তরাধিকার হস্তান্তর। তাই আমরা এর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছি।’আধুনিক তুরস্কের সবচেয়ে সফল রাজনীতিবিদ এরদোগান দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০০২ সাল থেকে এক ডজনেরও বেশি নির্বাচনে বিজয়ী, এরদোগান ২০২৩ সালের মে মাসে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সময় পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য পুনরায় নির্বাচিত হন।এরদোগান শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ও রাজনীতি থেকে বিদায় নেবেন কিনা, তা নিয়ে তার দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক বিরোধীদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। জার্মান ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল অ্যান্ড এরিয়া স্টাডিজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হাক্কি তাস উল্লেখ করেন, ‘২০০৯ সালে, তিনি বলেছিলেন যে, এটি তার শেষ নির্বাচন হবে; ২০১২ সালে তিনি বলেছিলেন যে, এটি তার শেষবারের মতো দলীয় সভাপতির জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এবং ২০২৩ সালে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ভোটারদের সমর্থন চাওয়ার এটাই শেষ সময় হবে তরুণ প্রজন্মের কাছে।’প্রতিটি নির্বাচনে জয়লাভের পর এরদোগান তার এজেন্ডাকে এগিয়ে নেন এবং তার রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রসারিত করেন। এখন তিনি আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি সরকার পরিচালনা করেন এবং তার দলের নেতৃত্ব দেন। তাস বিশ্বাস করেন, এরদোগানের ঘোষণাটি একটি কৌশলগত বিষয়Ñ তার সমর্থকদের একত্রিত করার একটি উপায়, যারা আবেগগতভাবে রাষ্ট্রপতির সাথে সংযুক্ত বোধ করে এবং তাদের আস্থার জন্য জিজ্ঞাসা করে। তাস যেভাবে তার কথাগুলোকে তুলে ধরুক না কেন, এরদোগান যেভাবে এর আগে তার কথাগুলো বলেছিলেন তার সাথে কাজ মেলালে আক্ষরিকভাবে সাংঘর্ষিকতা সেভাবে পাওয়া যাবে না।যদি কোনো আগাম সংসদীয় বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন না হয়, তাহলে এরদোগান ২০২৮ সাল পর্যন্ত তুরস্ক শাসন করতে পারেন। স্থানীয় নির্বাচনে তার দল ভালো করলে পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন যে, এরদোগান তার ক্ষমতা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করতে পারেন, সম্ভব হলে সংবিধান পরিবর্তন করবেন এবং তার সম্ভাব্য উত্তরসূরি নিয়ে চিন্তা করবেন। এটি করার জন্য তাকে ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা, ইজমির এবং আন্টালিয়ার মতো বড় শহরগুলোর সমর্থন প্রয়োজন। কারণ তারা দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক অবদান রাখে।তুরস্ক বিশেষজ্ঞ জার্মান তাস বিশ্বাস করেন যে, আসন্ন নির্বাচনে একেপির বিজয় দলটির আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তুলবে। যেকোনো নির্বাচনী লাভ জাতীয় সরকারের সামগ্রিক এজেন্ডাকে সমর্থন হিসেবে দেখা হবে, এটিকে আরও র‌্যাডিকাল নীতির সাথে এগিয়ে যেতে একেপি নেতৃত্বকে উৎসাহিত করবে।এরদোগানের অবসর নেওয়ার পরিকল্পনাকে অনেকে অবিশ্বাস করলেও কে তার উত্তরসূরি হতে পারেন, তা নিয়ে ক্রমবর্ধমান আলোচনা চলছে। সম্প্রতি ছবি এবং ভিডিওগুলো দেখা যাচ্ছে যে, ৭০ বছর বয়সী এরদোগানের স্বাস্থ্য আগের মতো ভালো দেখা যাচ্ছে না।তার জ্যেষ্ঠ জামাতা বেরাত আল-বায়রাক অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় সাফল্য দেখাতে ব্যর্থ হওয়ার পর অনেকের সন্দেহ এরদোগান তার ছেলে বিলাল এরদোগান বা তার ছোট জামাতা সেলকুক বায়রাকতারকে তার উত্তরাধিকারী করার জন্য প্রস্তুত করছেন। কিন্তু সবাই মনে করেন না যে, তারা এরদোগানের মতো সফলভাবে একেপি পার্টিকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবেন অথবা আসলেই এরদোগান তাদের উত্তরাধিকার করার কথা আদৌ ভেবেছেন। এরচেয়ে বরং সংসদদের স্পিকার নুমান কুরতুলমাস, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকারকে বেশি সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে ভাবেন।এদিকে তুর্কি সাংবাদিক রাগিপ সোয়লু সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ বলেছেন যে, ২০২৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পর্যন্ত অনেক কিছু ঘটতে পারে। আগামী বছরগুলোয় এরদোগান আরও কয়েকবার তার মন পরিবর্তন করতে পারেন অথবা এমনকি এর মধ্যে সংবিধান পরিবর্তন করার চেষ্টা হতে পারে, সেটি হলে বর্তমানে রাষ্ট্রপতিদের অফিসে দুই মেয়াদে সীমাবদ্ধতা আরো বর্ধিত হতে পারে।আসলে এরদোগানের একেপি পার্টি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার জন্য কাজ করছে। যাই হোক, বর্তমানে সাংবিধানিক সংশোধনী বা আগাম নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় ৪০টি সংসদীয় আসনের অভাব রয়েছে সরকারি জোটের। এ সময়ে দলটি কিছু ছোট বিরোধীদলের সমর্থন পেতে পারে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। এ সমর্থন পেলে নতুন সংবিধান পাস করা সম্ভব হতে পারে।এরদোগানের বিরোধিতা দেশের ভেতরের চেয়ে বাইরে বেশি। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য গেজি পার্কের বিক্ষোভ আর ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে বলে মনে করা হয়। এরদোগানের সে বিরোধিতা গাজা যুদ্ধের এ সময়ে আরো বেড়েছে বলে মনে হয়। টাইমস অব ইসরাইলে বলা হয়েছে, এরদোগানের অধীনে তুরস্ক তার ধর্মনিরপেক্ষ পথ থেকে সরে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। তার সময়ে একসময়ের মিত্র ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটেছে। তুরস্ক হামাসের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যে গোষ্ঠী ৭ অক্টোবর গাজা থেকে চালানো একটি নজিরবিহীন হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরাইলিকে হত্যা করে এ অঞ্চলটিকে যুদ্ধে নিমজ্জিত করেছে। এরদোগান যুদ্ধের কয়েক মাস আগে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক উষ্ণ করার প্রচেষ্টার মধ্যে ছিলেন, কিন্তু তারপর থেকে তিনি তীব্রভাবে পিছু হটেছেন এবং একই ভীতিকর আক্রমণে ফিরে এসেছেন, যা ইসলামপন্থী নেতার আগের অনেক বছর ক্ষমতায় থাকার বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে। নেতানিয়াহু এবং এরদোগান পরবর্তী বছরগুলোয় গণহত্যার পারস্পরিক অভিযোগসহ একে অপরের প্রতি বার বার ইটপাটকেল লক্ষ করেছিলেন। জুলাই ২০১৪ সালে এরদোগান গাজার সাথে যুদ্ধের সময় ইহুদি রাষ্ট্রকে ‘হিটলারের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখার’ জন্য অভিযুক্ত করেন। গাজায় সহিংসতা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের জেরুসালেমে তার দূতাবাস স্থানান্তরের মধ্যে উভয় দেশ ২০১৮ সালে তাদের রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাহার করে।টাইমস অব ইসরাইলের মূল্যায়নে স্পষ্ট ইসরাইল ও আমেরিকান ডিপ স্টেট এরদোগানের ক্ষমতায় ছেদ ঘটানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়ার থাকলে সেটি নিতে পারে। তবে তুরস্ক এখন অনেক পরিণত একটি রাষ্ট্র হিসেবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার ভূমিকা রাখছে। ফলে এরদোগান ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু থেকে সরে গিয়ে ওআইসির মতো বৈশ্বিক ফোরামের ভূমিকায় চলে গেলে রাষ্ট্র তার ধারাবাহিকতা নিয়ে এগিয়ে যেতে অক্ষম হবে না। এক্ষেত্রে বর্তমান স্থানীয় সরকার নির্বাচনের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।