আজ ২৮ অক্টোবর: বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি কত দূর

সোনার বাংলা অনলাইন
২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৫০

ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে সন্ত্রাসীদের হামলায় আহতদের দেখতে হাসপাতালে তৎকালীন আমীরে জামায়াত ও শিল্পমন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নীচের ছবিতে সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব

স্টাফ রিপোর্টার : ২৮ অক্টোবর পল্টন ট্র্যাজেডি দিবস। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক একটি দিন। এ কলঙ্ক দূর করতে হত্যা মামলার বিচারের বিকল্প নেই বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা। কিন্তু পল্টন ট্র্যাজেডির পর ১/১১ ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলো হত্যাকারীরাই। তাই বিচার প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে নেয়ার পর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করে সে মামলাটি প্রত্যাহার করে বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। মামলার অন্যতম কৌঁসুলি এডভোকেট আবদুর রাজ্জাক সাপ্তাহিক সোনার বাংলাকে জানান, ফৌজদারি আইনের অধীনে নির্দিষ্ট কিছু গুরুতর অপরাধ, যেমন হত্যা কখনোই তামাদি হয় না। গত ২০০৬-এর ২৮ অক্টোবর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল পল্টন মোড়ে হাজার হাজার মানুষের সামনে, তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এ নিমর্মতা সারা দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ সরাসরি দেখেছে। এর বিচার অবশ্যই হতে তবে, তাই আমরা আবার মামলাটি রিভাইভ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
২০০৬ সালের ওই দিনে প্রকাশ্য রাজনৈতিক সমাবেশে হামলা চালিয়ে ৬ জনকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, আর আহত করা হয় অসংখ্য মানুষকে। শুধু হত্যাই নয়, মৃত লাশের ওপর নৃত্য করার দৃশ্যও প্রত্যক্ষ করে বিশ্ববাসী। এ ঘটনার পর নিন্দা ও ধিক্কারের ঝড় উঠেছিল বিশ্বজুড়ে। এটা শুধুমাত্র নৃশংস হত্যাকাণ্ডই নয়, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথচলা ব্যাহত হয়, ঘটে ব্যত্যয়। সর্বত্র বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার স্লোগান দেখা গেলেও এই নির্মম ঘটনার বিচার হতে দেখেনি দেশবাসী।
৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে গেছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য এবং ক্ষমতায় যাওয়ার পর যারা খুন হয়েছেন, তাদের স্বজনদের মনে আবার বিচার পাওয়ার আশা জেগেছে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্বজনদের মনে আবার নতুন করে বিচার পাওয়ার আশা জেগেছে। শহীদ মাসুমের মা শামসুন্নাহার রুবি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সবাইকে আইন মানতে হবে। কিন্তু আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের বিরুদ্ধের সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তবুও তারা আশা ছাড়েননি। তিনি তখন বলেছিলেন, এর বিচার এক দিন না এক দিন হবেই। শহীদ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মা মাহফুজা বেগম বলেন, মানুষকে আর যেন এভাবে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করা হতে না হয়। আর যেন সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে না হয়।
গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় সাংবিধানিকভাবে একটি নির্বাচিত সরকার যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া করছিল, তখন রাজধানীসহ দেশজুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে অসাংবিধানিক সরকারকে ক্ষমতায় আসার পথকে সুসংহত করা হয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের অংশ হিসেবে রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দল ১৪ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরকে বাধাগ্রস্ত করতে এ ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী শুরু করে তাণ্ডব। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াতের অফিসসহ নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি যেমন চালানো হয় পৈশাচিক হামলা, তেমনি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় অনেক অফিস, বাড়িঘর, দেশব্যাপী চলে তাণ্ডবতা।
পরদিন চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ ছিল বিকাল ৩টায়। সকাল থেকেই সভার মঞ্চ তৈরির কাজ চলছিল। হঠাৎ করেই বেলা ১১টার দিকে আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠা ও অস্ত্রধারীরা জামায়াতের সমাবেশস্থলে হামলা চালায়। তাদের পৈশাচিক হামলায় মারাত্মক আহত হন জামায়াত ও শিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মী। তাদের এই আক্রমণ ছিল সুপরিকল্পিত ও ভয়াবহ। একপর্যায়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পল্টনের বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়ে এবং নিরীহ জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের বেধড়ক পেটাতে থাকে।
সেদিন পল্টনজুড়ে ছিল তাণ্ডব। লগি-বৈঠা আর অস্ত্রধারীদের হাতে একের পর এক আহত হতে থাকেন নিরস্ত্র জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা। তারা শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলামকে পিটিয়ে হত্যা করে। একের পর এক আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জামায়াতকর্মী জসিম উদ্দিনকে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তারা তার লাশের ওপর উঠে নৃত্য-উল্লাস করতে থাকে।
অস্ত্রধারীদের ছোড়া গুলি মাথায় বিদ্ধ হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়েন জামায়াতকর্মী হাবিবুর রহমান ও জুরাইনের জামায়াতকর্মী জসিম উদ্দিন। আরো প্রাণ হারিয়েছেন শিবির নেতা গোলাম কিবরিয়া শিপন ও সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুম। এ ঘটনায় রাজধানীতে জামায়াত ও শিবিরের সহস্রাধিক নেতাকর্মী আহত হন।
সেদিন জামায়াতকর্মী হাবিবুর রহমানকে হত্যা করেই তারা ক্ষ্যান্ত হয়নি, লাশটি টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল গুম করার জন্য। কিন্তু পুলিশের সহায়তায় যখন লাশটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলো, সেখানেও চলতে থাকে লাশ দখলের খেলা। তারা নকল বাবা-মা সাজিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল লাশটি। পরবর্তীতে এ কারসাজি ধরা পড়ায় নকল বাবা-মা সটকে পড়ে।
সেদিন শুধু রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যাই নয়, জরুরি প্রয়োজনে রাস্তায় বের হওয়া নারী, শিশু ও খেটেখাওয়া মানুষও রেহাই পায়নি। একান্ত নিরীহ অসহায় হতভাগ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছোট-খাটো দোকানদার এবং ফুটপাতের হকারদেরও চরম ক্ষতির শিকার হতে হয়। এমনি এক হকার কাসেম মিয়া পল্টন এলাকায় বুক চাপড়াতে চাপড়াতে আর্তনাদ করে পাগলের মতো দৌড়াচ্ছিল আর বলছিল, ‘আমি পথের ফকির অইয়া গেলাম। আমি অহন আত্মহত্যা করুম।’
সে সময় সারা দেশে হত্যা ও নৈরাজ্য চলে। ২৭ অক্টোবর গাজীপুরে হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জামায়াতে ইসলামী গাজীপুর জেলা জামায়াতে ইসলামীর নেতা মুহাম্মদ রুহুল আমীনকে। ২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর ঢাকাসহ সারা দেশে জামায়াত-শিবিরসহ চারদলীয় জোটের ৫৪ নেতাকর্মী শাহাদাতবরণ করেন। আহত হয়েছেন ৫ সহস্রাধিক জামায়াত, শিবির, বিএনপি নেতাকর্মী, সাংবাদিক, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ। এ পৈশাচিকতা ও বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পায়নি মায়ের কোলের শিশু, নারী, বৃদ্ধ এবং নিরীহ জনগণও। তাদের তিন দিনের ধ্বংসলীলায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
ঘটনার পরদিন জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে পল্টন থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং-৬১(২৯/১০/০৬)। ধারা- ১৪৩/ ৩২৩/৩২৫/ ৩২৬/৩০২/ ৩০৭/ ১০৯/১১৪ দণ্ডবিধি। মামলায় আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের ৪০ নেতার নামসহ অজ্ঞাতসহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়।
উল্লেখ্য, ২৮ অক্টোবরের পথ ধরেই ওয়ান-ইলেভেনের অবতারণা হয়। আর তারই ধারাবাহিকতায় নীলনকশার নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট সরকার গঠন করে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের জনগণ হারিয়েছেন তাদের ভোটাধিকার। শুরু হয়েছে গণতন্ত্রহীনতার অবিরাম যাত্রা। ক্ষমতালিপ্সা কত জঘন্য, নৃশংস হতে পারে, রক্তাক্ত সেই আটাশ তার দৃষ্টান্ত হতে পারে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার তার মেয়াদ শেষে যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করছিল, যখন প্রশাসনও একটা অন্তর্বর্তী অবস্থানে দাঁড়িয়েছিল, সেই সময়ের সুযোগ নিয়ে সেদিন যে সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তা মানুষের স্মৃতিকে বহুকাল পীড়িত করবে। ২৮ অক্টোবর বার বার আমাদের মাঝে ফিরে আসে। আর স্মরণ করিয়ে দেয় লগি-বৈঠার সেই তাণ্ডব। লগি-বৈঠার পৈশাচিক নৃত্যের কথা স্মরণ হলে শিউরে ওঠে মানুষ।

২৮ অক্টোবর

সম্পর্কিত খবর