মায়ের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস অনাগত সন্তানের ক্ষতির কারণ : মৃত্যুও হতে পারে


৮ নভেম্বর ২০২৪ ০০:০৮

॥ হামিম উল কবির॥
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস গর্ভবতী মায়ের গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যুর কারণও হতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে গর্ভস্থ সন্তান আকারে বড় হয়। ফলে স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব হয় না, সিজারিয়ানে যেতে হয়। আর তা করতে না পারলে সন্তানের মৃত্যু হয়ে থাকে। ডায়াবেটিসের কারণে হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোকও হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে, কিডনির কার্যকারিতা কমতে থাকে এবং পায়ের আঙুলে পচন ধরতে পারে। রোগীকে বাঁচানোর জন্য পায়ের আঙুলসহ অন্যান্য অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বব্যাপী ৪২ কোটি বেশি লোকের ডায়াবেটিস রয়েছে এবং ১৫ কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য ডায়াবেটিস দায়ী। খাবার থেকে পাওয়া চিনি বা গ্লুকোজ শরীর যখন পুরোপুরি পোড়াতে না পারে, তখন অবশিষ্ট চিনি বা গ্লুকোজ শরীরে থেকে যায় এবং শরীরের সেই অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলা হয়। টাইপ-১ বা জন্মগত ডায়াবেটিস বিশ্বব্যাপী ৩ শতাংশ হারে বাড়ছে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয় কেন
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে সন্তান প্রসবের প্ল্যাসেন্টা (গর্ভফুল) পড়ে গেলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। গর্ভকালীন ফুল বা প্ল্যাসেন্টা থেকে এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়ে থাকে। এ হরমোনগুলো ইনসুলিনকে কাজ করতে দেয় না। সন্তান প্রসবের পর প্ল্যাসেন্টা পড়ে গেলে ইনসুলিন তার কার্যক্ষমতা ফেরত পায়, কোনো ব্লাডসুগার এজেন্ট (ইনসুলিন) ছাড়াই ভালো থাকে। কিন্তু সবক্ষেত্রে এটা হয় না। কিছু কিছু নারীর ক্ষেত্রে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সন্তান প্রসবের পরও থেকে যায়। এ সংখ্যা কম না। সন্তান প্রসবের ছয় সপ্তাহ পর টেস্ট করে নিশ্চিত হতে হবে- ডায়াবেটিস সেরে গেছে কি না। ওই টেস্টে যদি ডায়াবেটিস নেগেটিভ আসে, তাহলেই বলা যাবে যে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এখন আর নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, সবার ক্ষেত্রে একই রকম ঘটনা ঘটে না। সাধারণভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, যাদের গর্ভকালীন ইনসুলিন লাগে না, শুধু খাবার বা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হয়ে যায় বা খুব অল্প ডোজের ইনসুলিন লাগে সাধারণত সন্তান প্রসবের পর তারা স্বাভাবিক হয়ে যান। আর যাদের গর্ভাবস্থায় অনেক হাই ডোজের ইনসুলিন লাগে, তাদের সন্তান প্রসবের পরও ইনসুলিন নিতে হয়। তাদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস পরেও থেকে যায়।
ভ্রুণের ম্যাক্রোসোমিয়া
ভ্রুণ ম্যাক্রোসোমিয়া রোগ নয়, তবে প্রসবের সময় জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে এবং মা এবং নবজাতক উভয়ের জন্য প্রসবোত্তর নানা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ভ্রুণের ম্যাক্রোসোমিয়ার কারণ জেনেটিক (বংশগত), বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্টর ভ্রুণের ম্যাক্রোসোমিয়াতে ভূমিকা পালন করে। আকারে বড় বাচ্চা হওয়ার ইতিহাস আছে এমন পরিবারে এ অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা বেশি। উপরন্তু, কিছু জেনেটিক রোগ ভ্রুণের অত্যধিক বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। পিতা-মাতার জৈবিক বৈশিষ্ট্য, যেমন উচ্চতা এবং শরীরের গঠন, ম্যাক্রোসোমিয়ার সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ভ্রুণের ম্যাক্রোসোমিয়া হওয়ার প্রবণতা বাড়ায়। এছাড়া স্থূলতা এবং গর্ভাবস্থায় অত্যধিক ওজন বৃদ্ধি ম্যাক্রোসোমিক শিমু প্রসবের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিতে পারে।
গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টি গ্রহণে ভারসাম্যহীনতা, অত্যধিক পুষ্টি বা অপুষ্টির কারণে ম্যাক্রোসোমিয়া শিশু হওয়ায় ভূমিকা রাখে। বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার মহুয়া বলেন, ‘ভ্রুণের সর্বোত্তম বিকাশের জন্য সুষম এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য খেতে হবে।’ মাতৃত্বের বেশ কিছু ঝুঁকির কারণ ভ্রুণের ম্যাক্রোসোমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। ডায়াবেটিস ছাড়াও মায়েদের স্থূলতা ম্যাক্রোসোমিক বাচ্চা প্রসবের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ওজন বৃদ্ধি ভ্রুণের ম্যাক্রোসোমিয়ায় অবদান রাখতে পারে। ভ্রুণের ম্যাক্রোসোমিয়া প্রায়ই আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে নির্ণয় করা যায়।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের অনিষ্টতা
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে মায়ের মতো সন্তানেরও ঝুঁকি আছে। সেক্ষেত্রে ডায়াবেটিস খুব ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখলে ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। ডায়াবেটিস থাকলে গর্ভপাত হতে পারে, যেকোনো সময় হঠাৎ করে রক্তপাত শুরু হয়ে যেতে পারে, সন্তান প্রসবের সময় বাচ্চা আটকে যেতে পারে। ফলে নরমাল ডেলিভারি সম্ভাবনা কমে যায় এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়ের ভূমিষ্ঠ সন্তানের বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি হতে পারে। মায়ের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে অনেক বড় সাইজের বাচ্চা হয়, ফলে প্রসবের সময় সমস্যা তৈরি হতে পারে। জন্মের পর শিশুর হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা লো ব্লাডসুগার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া ইলেক্টোলাইট বা বিভিন্ন লবণের কম-বেশি হতে পারে। এক্ষেত্রে বাচ্চা ডায়াবেটিস নিয়ে জন্ম নেবে কিনা- একটা প্রশ্ন থেকে যায়। চিকিৎসকরা বলেন, মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে বাচ্চার ডায়াবেটিস নাও হতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস গর্ভাবস্থার উচ্চঝুঁকি তৈরি করে। শিশুটি সর্বদা মায়ের সাথে সরাসরি শারীরবৃত্তীয় যোগাযোগে থাকে। ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধ করা যায় না, তবে কিছু ব্যবস্থা নেয়া হলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
সন্তান গর্ভে থাকার সময় মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে নানাভাবে সন্তানের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জন্মগ্রহণের পরপরই হৃৎপিণ্ড ও শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যার মতো আরো কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। ভবিষ্যতে অতিরিক্ত ওজন বিশিষ্ট হওয়ার বা ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া জন্মের পর থেকেই স্নায়ুতন্ত্র এবং হৃৎপিণ্ডের সমস্যার পাশাপাশি আরো কিছু সমস্যা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। টাইপ-১ বা টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিকে গর্ভধারণের অন্তত তিন মাস আগে থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। ডায়াবেটিস আক্রান্ত নারীর গর্ভধারণের পরিকল্পনার আগে নিশ্চিত করতে হবে যে তার ডায়াবেটিস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ডায়াবেটিসের জন্য যেসব ওষুধ গ্রহণ করতে হয়, চিকিৎসকের পরামর্শে গর্ভকালীন অবস্থায় ওষুধ গ্রহণের মাত্রা আরো বাড়াতে হয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগী গর্ভধারণ করলে সাধারণভাবে খাওয়া যায় এমন হাইপোগ্লাইসেমিক এজেন্ট (রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ানোর ওষুধ) বন্ধ করতে হবে এবং উচ্চরক্তচাপের ওষুধও পরিবর্তন করতে হবে। চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভকালীন অবস্থায় অবশ্যই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এটা করতে হবে মা ও অনাগত শিশুর কল্যাণের জন্য। গর্ভকালীন অবস্থায় খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৪.৫ মিলিমোল/লিটার থেকে ৫ বা সর্বোচ্চ ৫.৫ মিলিমোল/লিটার হতে পারে। খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ডায়াবেটিসের মাত্রা হবে ৫ থেকে ৬ মিলিমোল/লিটার। ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, ডায়াবেটিস আক্রান্ত নারীদের গর্ভধারণের চেষ্টার সময় থেকে গর্ভধারণের পর ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রতিদিন অন্তত ৫ মিলিগ্রাম ফলিক এসিড ট্যাবলেট খাওয়া উচিত। এর ফলে জন্মগ্রহণের সময় শিশুর বিভিন্ন রকম জটিলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
গর্ভাবস্থায় নানা সমস্যা
গর্ভাবস্থায় প্রথম ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে গর্ভের শিশুর ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত মায়ের সন্তানের স্নায়ু টিউবের ত্রুটি হতে পারে, মাথার খুলির অনুপস্থিতি, মাথা ছোট হওয়া, মেরুদণ্ডের হাড়ের সমস্যা, হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র হওয়া, কিডনি সমস্যায় ভোগা, কিডনিতে পানি জমতে পারে, ক্ষুদ্রান্ত্র এবং বৃহদান্ত্রের সমস্যা হতে পারে, পেটের সামনে মাংসপেশির অনুপস্থিতি, নাড়ির সমস্যা, জন্মের পরে বাচ্চার শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হতে পারে, গর্ভেই শিশুর মৃত্যু হওয়া এবং হঠাৎ রক্তে চিনির পরিমাণ কমে গেলে বাচ্চা নেতিয়ে পড়তে পারে। শুধু শিশু সমস্যা নয়, ডায়াবেটিসে মায়েদেরও নানা সমস্যা হতে পারে। এগুলো জরায়ুতে পানির পরিমাণ বেশি জমে, গর্ভপাত হতে পারে, ইনফেকশন হতে পারে, প্রি-একলামশিয়া বা গর্ভকালীন প্রেসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বা চোখের সমস্যা হতে পারে, ডায়াবেটিক স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা হতে পারে, হৃদযন্ত্রের শিরার সমস্যা, জন্মের সময় বাচ্চার বিভিন্ন স্থানে আঘাতপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে, মায়ের প্রসবের রাস্তা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে।
ডায়াবেটিস উর্বরতাকে প্রভাবিত করে
ডায়াবেটিস থাকার কারণে নারীদের ফ্যালোপিয়ান টিউবের মতো প্রজনন অঙ্গ সংক্রমণের শিকার ও ক্ষতি হতে পারে। রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজ গর্ভপাত বা ভ্রƒণের জন্মগত ত্রুটির কারণ হতে পারে। ক্রমেই বেড়ে ওঠা ভ্রƒণের জন্য রক্তের গ্লুকোজ এবং অতিরিক্ত পুষ্টি ম্যাক্রোসোমিয়া শিশু (বড় শিশুর সিনড্রোম) হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। ক্লান্তি, বিষণ্নতা এবং উদ্বেগের কারণে বেশিরভাগ ডায়াবেটিক নারীর যৌন ইচ্ছা হ্রাস জনিত সমস্যায় ভোগেন। ডায়াবেটিসে উৎপন্ন অ্যান্টিবডি মায়ের ডিম্বাণুকে আক্রমণ করতে পারে। স্থূলতা অনিয়মিত মাসিক চক্রের সাথে যুক্ত এবং এর সাথেও যুক্ত পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (চঈঙঝ) হতে পারে। যাদের পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম থাকে সেই নারীদের ৫০-৭০ শতাংশের মধ্যে ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়।
গর্ভকালীন নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা
গর্ভকালীন নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে গর্ভের শিশু এবং মা সুস্থ থাকেন। ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, নিয়মিত ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রণ করা, ৩ মাস পর পর ঐনরঈ/ঐনধরপ পরীক্ষা করা, ১৩-১৪ সপ্তাহে এনটি স্ক্যান করা, ২০-২২ সপ্তাহে এনোমালি স্ক্যান করা, গর্ভকালীন রুটিন চেকআপ করা, লিভার এবং কিডনির জন্য রুটিন টেস্টগুলো করানো। যেকোনো জটিলতা থেকে রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবেও রোগী এবং তার পরিবারকে সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে।