আলোকে তিমিরে

অন্তর্বর্তী সরকার হয়ে উঠুক ‘সংস্কারক সরকার’

মাহবুবুল হক
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:০০

মাহবুবুল হক 

বিপ্লবোত্তর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে নানারকম কথা ও গুজব রয়েছে। এ সরকারের পক্ষে যারা আছেন, তারাও দ্বিধাহীন নন। সরকারের নামকরণ নিয়ে তাদের মধ্যেও নানামাত্রিক বিশ্লেষণ রয়েছে। আবার যারা এ সরকারের বিরোধী, তাদের মধ্যেও এ বিষয়ে ঐকমত্য নেই। যারা এ সরকারকে উচ্চকিত করতে চান, তারা শুরুতে ‘বিপ্লবী সরকার’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু সরকার গঠনে তিন দিন পিছিয়ে যাওয়ায়, বিপ্লবের ‘তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠা’ ভাবটা বেশ কমে যায়। নতুন নামকরণ করা হয় ছাত্র-জনতার ‘গণঅভ্যুত্থান’। এ নামটা সরকারি ও বেসরকারিভাবে একযোগে প্রচারিত হতে থাকে। সাধারণ বিশ্লেষকরা প্রচার করতে থাকেন, যেকোনো বিপ্লবের তো একটু নির্দিষ্ট কিছু ফর্মুলা থাকে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে সে ইনগ্রিডিয়েন্টগুলো পরিদৃষ্ট নেই। আরো সহজ করে বলা যায়, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য-লক্ষ্য পূর্ব থেকে নির্ধারণ করা ছিল না। শুরুটা হয়েছিল অনেক দূর থেকে। যেমন ‘কোটা আন্দোলন’ থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’। তারপর হঠাৎ করেই ‘সরকার পতনের আন্দোলন’। সরকার পতনকালে বিপ্লবের কথাটা চাঙ্গা হয়। সরকারের ‘টপ ব্রাশের’ লোকজন পালিয়ে গেলেও রাষ্ট্রের প্রধান ‘রাষ্ট্রপতি’ বঙ্গভবনে রয়ে গেলেন। ফলে সাত-পাঁচ বা ভবিষ্যতের কথা না ভেবে দেশে রয়ে যাওয়া রাষ্ট্রপতির হাতে শপথ গ্রহণ করে ‘সরকার’ গঠিত হয়ে গেল। যে মুহূর্তে এ অসাবধানী কাজটি হলো, মুহূর্তেই ‘বিপ্লব’ শেষ হয়ে গেল। ভাগ্যিস খন্দকার মোশতাকের মতো প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন আওয়ামী সরকার গঠন করেননি। করলে ভালো হতো না মন্দ হতো, সে আলোচনা এখন আর করে লাভ নেই।
কোথায় যেন শুনলাম, গ্রামের একজন চাষি আরেকজন চাষিকে জিজ্ঞেস করছে, এ সরকারের নাম যেন কী? অন্য চাষি জমির আইলে বসে জবাব দিচ্ছেÑ এটা হলো ‘অন্তর্বর্তী’ সরকার অর্থাৎ এ সরকারের অন্তর দেশবাসীর জন্য মায়া-মমতায় ভর্তি হয়ে আছে। এসবের বিশ্লেষণ করতে গেলে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলা যাবে।
একসময় সরকারের নামগুলো ছিল আইয়ুব সরকার, মুজিব সরকার, জিয়া সরকার, খালেদা সরকার, এরশাদ সরকার এবং হাসিনা সরকার।
আমাদের আরবান জগতে ‘ইউনূস সরকার’Ñ এ নামটাও মোটামুটি সঞ্চালিত হচ্ছে। কিন্তু দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে যে ‘অন্তর্বর্তী’ শব্দটি চালু হয়ে গেছে, তা না মেনে উপায় নেই।
মূল নাম ছিল ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’। কে বা কারা শব্দটি বাদ দিয়ে অন্তর্বর্তী বানিয়েছে, সেটা আমাদের না জানলেও চলবে। তবে এটা বর্তমান সরকারের জন্য ‘ব্লেসিং ইন ডিসগাইজ’, তা অবশ্য বলাবাহুল্য।
সরকার গঠনের আগে ইউনূস সাহেবের সুনাম ও বদনাম সমানতালে ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী মানুষ ‘সুদের বিষয়টা’ মনে রেখে তার কথা বিবেচনা করত। কিন্তু ইউনূস সাহেব কর্তৃক সরকার গঠনের পর ইসলামপন্থীদের মনে তার বিষয়ে আর তেমন কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই।
এখন ‘আওয়ামীপন্থী’ ছাড়া অন্য দল ও মতের লোকেরা ধারণা করে জাতির জন্য ইউনূস সাহেবের বিশাল অন্তর মায়া-মমতায় ভর্তি হয়ে আছে।
বর্তমান পৃথিবীতে ধর্ম-বর্ণ-মতবাদ নির্বিশেষে তিনি ‘এক নম্বর’ মানুষ। ধর্মের জায়গাটি ছাড়া দুনিয়ার সকল প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে এক পাল্লায় চড়িয়ে, অন্য পাল্লায় যদি ইউনূস সাহেবকে চড়ানো হয়, তাহলে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায় তার পাল্লাটি ইনশাআল্লাহ ভারী হবে। এ ধরনের একজন মানুষের ‘দিল’ বা অন্তর শুধু মানুষের জন্য নয়, সৃষ্টির কল্যাণে পরিপূর্ণ বা ভর্তি থাকবে তা তো অবশ্যই আশা করা যায়। ইসলামী বিধানে আছে মহান আল্লাহ কোন মানুষের দ্বারা কোন কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত করবেন, তিনি ছাড়া আর কেউ অনুমান করতে পারে না। এটা সব মানুষের জীবনে চরম বাস্তবতা। সারা জীবন দুষ্কর্ম করে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মানুষ কালে কালে, যুগে যুগে, সংস্কারক হয়েছেন, এমন তুলনা মেলা ভার নয়।
দেশ-বিদেশের বিজ্ঞজন ইউনূস সাহেবকে রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখছেন না বা দেখতে চাচ্ছেন না। তাকে ‘চিন্তাশীল সংস্কারক’ হিসেবে দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এর কারণ অনেক।
আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, আমাদের দেশে সব ধরনের ‘বড় মানুষ’ আছেন। শুধু পেশা বা নেশার ক্ষেত্রে নয়, সর্বক্ষেত্রে বা সব জায়গায় পণ্ডিত বা বিশেষজ্ঞ শ্রেণির অভাব নেই। শুধু অভাব সংস্কারকের।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বিনয়ের সাথে একটা কথা বলতে পারি, জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান প্রতিষ্ঠিত একটি অতি ছোট-খাটো কৃষ্টি-সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সাথে আমরা কয়েকজন বন্ধু গত প্রায় ৩০ বছর যাবত জড়িত। আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাত্রার বিশিষ্ট ও বরেণ্য মানুষকে পদক প্রদান করেছি (প্রায় দেড় হাজার জন)। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, ‘সংস্কারক’ হিসেবে এখনো কাউকে আমরা পদক প্রদানের জন্য সিলেক্ট করতে পারিনি। সমাজচিন্তক, সমাজহিতৈষী, সমাজসেবক, সমাজকর্মী, সমাজনেতা এ ধরনের উপাধিতে আমরা বিভিন্ন সময় পদক প্রদান করার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ‘সংস্কারক’ হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করতে পারিনি।
এককালের আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার মহান নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে ‘সংস্কারক’ হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়েও তাকে আমরা ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে চিহ্নিত করতে বাধ্য হয়েছি। ইন্ডিয়ার প্রতিথযশা সাংবাদিক জয়প্রকাশ নারায়ণকে সেদেশের আপামর জনসাধারণ সম্ভবত ৫০-এর দশকের শেষ ভাগ থেকে ‘সংস্কারক’ হিসেবে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন।
তাই বলে কি এ ব-দ্বীপে কখনো কোনো সংস্কারক ছিলেন না, সে কথা কিন্তু বলা যাবে না। হযরত শাহজালাল, শাহ মখদুম, খানজাহান আলী, ফকির মজনু শাহ, তিতুমীর, ফরায়েজি আন্দোলনের হাজী শরীয়তুল্লাহ, মুন্সী মেহের উল্লাহ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, চট্টগ্রামের মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব ফয়জুন্নেসা, বেগম রোকেয়া, হাজী দানেশ, আর পি সাহা প্রমুখ।
যেসব সম্মানিত সংস্কারকের নাম এখানে কিঞ্চিত উল্লেখ করার প্রয়াস পেলাম, এদের প্রায় সবারই জন্মশতবর্ষ পূর্বে। ইতোমধ্যে এদেশে বড় কোনো সংস্কারকের জন্ম হয়েছে, সেটা আমরা নির্ণয় করতে পারছি না। মনে হয় এটাই আমাদের অনেক বড় দুর্ভাগ্য।
গত প্রায় একশত বছর ধরে আমরা রাজনীতিবিদদের ওপর ভরসা করছি। আমরা আশা করে আসছি, রাজনীতিবিদরাই রাজনীতির মাধ্যমে বা ভোট-নির্বাচন ইত্যাদির মাধ্যমে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করবেন। শিক্ষা-দীক্ষায় জনগণকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির চূড়ান্ত সোপানে পৌঁছাবেন। সে আশায় এখন গুড়ে বালি। ইদানীংকালের সর্বশেষ গবেষণায় উঠে এসেছে যে, গত ৫৩ বছরে পেশাজীবী তথাকথিত রাজনীতিবিদগণ একটাই ‘ব্রেক থ্রো’ করেছেন। আর তা হলো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ‘চোরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা (স্যালুট টু দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য)।
পুনরায় জাতির বর্তমান প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ চিন্তাশীল মানুষের কথায় ফিরে আসি। তাদের সহজ, সরল, সাবলীল কথা হলো অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপকভাবে সংস্কারধর্মী কাজ করুক। তবে সংস্কারের নামে মঈন উ আহমেদ ও ফখরুদ্দিনের মতো ‘ইউটার্ন-এর’ সংস্কার করার দরকার নেই। আর কেউ যেন, ওদের মতো ব্লাফ দিতে না পারে। সংস্কারের জন্য প্রয়োজনে লাগুক না চার বছর।
দেখতে দেখতে ৫৪ বছর তো চলেই গেল। হাসিনা সরকার যদি তাদের টার্ম শেষ করতে পারত, তাহলে হিসাব করুন আরো ৪ বছর লাগত।
মহান আল্লাহর রহমতে আবাবিল পাখিরা যদি জেহাদ না করত, তাহলে যেসব রাজনৈতিক দল এখনই নির্বাচন দাবি করছে, তাদের অন্তত ৫টি বছর মুখে ‘কুলুপ মেরে’ বসে থাকতে হতো। এটা আন্দাজ বা অনুমানের কথা নয়।
গত ১৬ বছরের সাধারণ যে অভিজ্ঞতা, তাতে প্রমাণিত হয়েছে যে, হাসিনা সরকারের বিপক্ষে যারা ছিল, তারা অবশ্যই ছোট-খাটো আন্দোলন করেছে। মাঝে মাঝে দেশবাসীকে মেঘের গর্জন, বজ্রপাতের আওয়াজ শুনিয়েছে। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি বা তুফান দেখাতে পারেনি। অথচ এখন তারা জোর গলায় বলছে, তাদের এ ছোট ছোট বজ্রাঘাতে দেশ নাকি মাঝে মাঝে অচল হয়ে গিয়েছিল। বহু অচলাবস্থা সৃষ্টির কারণে বর্তমান বিপ্লব সম্ভব হলো। এ বিপ্লব নাকি ‘লেগাসি অব দি পাস্ট’। অতীতের একটা ধারাক্রম। ক্রমাগত মেঘের ধাক্কাধাক্কিতে যে বৃষ্টি হয়েছিল, তারই নাকি ফল এ বিপ্লব। কিন্তু দেশ ও বিদেশবাসী অর্থাৎ দুনিয়াবাসী মেঘও দেখলো না, বজ্রপাতও দেখল না, সামুদ্রিক ঝড়-তুফান দেখলো না। হঠাৎ দেখল আবাবিল পাখির মতো দেশব্যাপী ছোট ছোট গ্যাং। আবাবিলরা ছোট ছোট পাথর দিয়ে ‘আবরাহার’ শত শত হাতি, ঘোড়া ও সৈন্যকে চর্বিত ঘাসের মতো নিষ্ট-পিষ্ট করে তুলেছিল। বিষয়টা একটা ধারাক্রম ছিলÑ এ কথাটা কেউ মানবে না।
একটা কথাই সবাই বলছে এবং মানছে, বিপ্লবটা ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। সুতরাং আবাবিলদের বিষয়টিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা দয়া করে বন্ধ করুন। করলে মহান আল্লাহ যে, জাতিগত আজাব-গজব অবশ্যই দিতে পারেন। সেক্যুলার হয়েছেন, এ নিয়ে আমাদের কোনো কথা নেই। তবে একটাই অনুরোধ, দয়া করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর দিকে চশমা লাগিয়ে একটু তাকান। কেন দয়াময় মেহেরবান মহান আল্লাহ গত প্রায় ৮০ বছর ধরে মুসলিম জাতিকে থেমে থেমে বিরতি দিয়ে ধ্বংস করে যাচ্ছেন?
আমরা কি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের থেকে উত্তম মানুষ। ওদের পারিবারিক জীবন দেখলে তাই কি মনে হয়? ওদের জগৎ ও জীবন গবেষণা করলে তারা একেবারে নিকৃষ্ট শ্রেণির মানুষ তা কি প্রমাণিত হয়। সুতরাং সহজেই বলা যায়, যারা এখনই জাতীয় নির্বাচন চাচ্ছেন, তারা ‘অন্ধের মতো হাতি দেখার’ প্রয়াস পাচ্ছেন।
হাসিনার হাতে আরও ৪ বছর সময় ছিল। সেই সময়টা মহান আল্লাহ কেড়ে নিয়ে আবাবিলদের হাতে দিয়েছেন। সেখানে আপনাদের নাক গলানোর কোনো অবকাশ নেই। পারলে বা সম্ভব হলে আবাবিলদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সংস্কারের মহান কর্মে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করুন। মহান আল্লাহ হাসিনাদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে পুরনো রাজনৈতিক দলের হাতে প্রদান করেছেনÑ এমন কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। কুরআনে আছে, প্রয়োজনে মহান আল্লাহ এক জাতির কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অন্য জাতিকে প্রদান করেন। এক জাতিকে ধ্বংস করে অন্য জাতিকে সমুজ্জ্বল করেন। কত সত্য এ কথাগুলো।
উপর্যুক্ত কথাগুলো কুরআনের মাত্র এক জায়গায় আছে? না, বহু জায়গায় আছে। শুধু মাজারে গিয়ে আল্লাহর কাছে আহাজারি করলে কোনো কাজ হবে না। ওখানে এমন কেউ নেই যে, আপনাদের কথা শুনে আপনাদের পক্ষে রায় দিতে পারে।
এই তো দেখুন, মেঘের গর্জন ছাড়াই হঠাৎ করে আষাঢ়ে বৃষ্টি এসে গেল। এ জাতির হারানো বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির নাম ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার।’
ক্ষমতাসীন সরকার নিরপেক্ষভাবে সততার সাথে সত্যকে বুকে ধারণ করে বহু বছর যাবত সত্য, স্বচ্ছ, স্বাভাবিক নির্বাচন দিতে বার বার ব্যর্থ হয়েছে। এখনই সত্য, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিহীন সুবিচারপূর্ণ নির্বাচন করার একটা পথ (এ ওয়ে আউট) মহান আল্লাহর তরফ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রোডম্যাপ এসে গেল।
জামায়াতে ইসলামী তখন খুব জাঁদরেল অবস্থানে ছিল। তারাই জাতির সামনে তথা সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করল। প্রধান বিরোধীদল তখন আওয়ামী লীগ। তারা জামায়াতে ইসলামীর শত্রু হলেও বিষয়টিকে লুফে নিল। ক্ষমতাসীন দল তখন বিএনপি, তারা কোনোভাবেই এটাকে মেনে নিল না। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দাবি করল, তত্ত্বাবধায়কের আবিষ্কার ছিল তাদের। তারা তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করল। কিন্তু শতভাগ ফলপ্রসূ হলো না। দলীয় স্বার্থ নির্মমভাবে প্রসারিত হলো। সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ঘটল। সুবিচার-অবিচারের নির্ঘণ্ট তৈরি হলো। এ সময় আবার বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইল। পূর্বে যে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রক্রিয়াকে বিরোধিতা করেছিল, তা তারা বেমালুম ভুলে গেল।
যা হোক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে একেকবার একেক লবঝ সংযুক্ত হলো। যেমন ‘সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘি ও সরিষার তেলের সাথে ডালডা, বনস্পতি, পামওয়েল, সয়াবিন মিশিয়ে এমন একটা নির্ঘণ্ট বানালোÑ যার ফলে শেষের দিকে যে জগাখিচুড়ি ‘কনসিভ্ড নির্বাচন’ হলো, তা থেকে যে ‘সিজার করা সরকার’ ভূমিষ্ঠ হলো, তা আওয়ামী সরকার না হয়ে হলো হাসিনা সরকার।
এরা ইতিহাসের জঘন্যতম অত্যাচার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে দিল। ক্ষমতাসীন সরকার যাতে চিরদিন প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে, গত ১৬ বছরে সেই ব্যবস্থা তারা প্রতিষ্ঠিত করে ছাড়ল।
২০৪১ সাল পর্যন্ত ধরে নেওয়া হলো, হাসিনা বেঁচে থাকবেন। ততদিন পর্যন্ত যেন ‘হাসিনা সরকার’ টিকে থাকে, সে ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হলো। সে ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, অনেক করুণ, অনেক মর্মান্তিক, দুঃসহ ও দুর্বহ। সে ইতিহাসের সাথে এদেশের ১৮ কোটি মানুষ ছিল এবং আছে।
আল্লাহর রহমতে এবং ছাত্র-জনতার নিপুণ পরিকল্পনায় যে বিপ্লব সংঘটিত হলো, তার ক্যানভাস হয়েছে বিশাল এবং বিপুল।
‘সংস্কারের খনি’ তালাশ করতে করতে মহান আল্লাহর তরফ থেকে হারিয়ে যাওয়া একটা সুন্দর, ন্যায্য, সত্য ও বাস্তব সমাধান বেরিয়ে এলো।
কয়েকদিন ধরে চিন্তাশীল নাগরিকগণ বেশ খোলামেলাভাবে আলোচনা করছেন অন্তর্বর্তী সরকার ৪ বছরের মধ্যে (হাসিনার নির্ধারিত সময়) সংস্কারের কাজটা সমাপ্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা গ্রহণ করুন। সংস্কারের অবিনাশী কাজটা সমাপ্ত হলে সাথে সাথে পূর্বের মতো ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন এবং তাদের হাতে প্রথমে স্থানীয় সরকার ও পরবর্তীতে বা সাথে সাথে আকাক্সিক্ষত ‘জাতীয় নির্বাচন’ সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করুন।