আলোকে তিমিরে

মহীউদ্দীন আহমদের ‘সোনার বাংলা’

মাহবুবুল হক
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:০৬

সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র জন্মকথা গত সপ্তাহে কিছুটা বলেছি, সেদিকে আর যাচ্ছি না। মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যায়, এখন পর্যন্ত সোনার বাংলার মুদ্দত বা পর্ব তিনটি বলে নির্ণয় করা যায়। শিশু পর্বটি ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অব্যবহিতকালের। বোধ হয় আরও একটু স্পষ্ট করে বলা যায়, ১৯৬৬ সালের কোনো এক মাসে। এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লেখালেখির জায়গাটা দেখাশুনা করতেন বঙ্গবন্ধুর বড় ভাগিনা শেখ মনি।
সুতরাং আন্দাজ করা যায়, তখন এ পত্রিকার ভূমিকা কী ছিল। এখন যে আমরা বৈষম্য নিয়ে কথা বলছি বা উচ্চকিত হচ্ছি, সে বিষয়টা তখন সমুজ্জ্বল ছিল, যা আমরা ৬ দফায় দেখতে পেয়েছি। এখানে আর সে বিষয়গুলো পুনরায় টেনে আনা প্রয়োজনবোধ করছি না।
সে সময়কার প্রথিতযশা সাংবাদিকদের কাছ থেকে অনেক মজার মজার গল্প শুনেছি। সেসব কথা অনেকেই অনেকভাবে বলেছেন, আমরা শুনেছি মাত্র। তবে বিশিষ্ট সাংবাদিক একসময়ের দৈনিক ইনকিলাবের দীর্ঘকালীন বার্তা সম্পাদক সুলতান আহমেদ ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে আমাদের সামনে কথা রেখেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, বিভিন্ন কারণে তার দুপুরের লাঞ্চ ও রাতের ডিনার মহীউদ্দীন সাহেবের বাসায় সম্পন্ন হতো। ১০৯, ঋষিকেশ দাস রোডের সাড়ে তিন তলায় মহীউদ্দীন সাহেব থাকতেন। তিনতলায় বসবাস করতেন আত্মীয়-স্বজন নিয়ে, বেশ বড় পরিবার। তিনতলার ছাদের এক অংশে মহীউদ্দীন সাহেব অবস্থান করতেন। বেশ বড় একটা রুম। এক পাশে বড় একটা চৌকি, আলনা, আলমারি, কাঠের ডাইনিং টেবিল এবং সাময়িক অতিথিদের বসার জন্য চেয়ার টেবিল। সব আসবাবপত্র ছিল খুবই প্রয়োজনীয় এবং সাধারণ। সকাল এবং রাত ছাড়া মহীউদ্দীন সাহেব এখানে অবস্থান করতেন না। নিচতলা, দোতলা ও তিন তলা ছিল সরগরম। শুধু ছাদের বিশাল রুমটি ছিল নীরব ও নিথর। এখানে মহীউদ্দীন সাহেবের বিশেষ মেহমানরা মাঝে মাঝে আপ্যায়িত হতেন। এখানকার আপ্যায়নের বিষয়ে সুলতান ভাই বলেছিলেন, সে এক মহারাজকীয় ব্যাপার! অষ্টব্যঞ্জন বলে বাঙালি ঘরানায় বহুল আলোচিত বিষয় রয়েছে। টক-ঝাল-মিষ্টি সবকিছু মিলিয়ে কোনো কোনো সময় ডজনতম ব্যঞ্জনকেও ছাড়িয়ে যেত। খাদ্য থেকে খাদ্যের বাহন তথা কোকারিজ ছিল দামি এবং সুশোভিত। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একবার মহীউদ্দীন সাহেবের সাধারণ আসবাবপত্রের দিকে তাকাতাম আবার চব্যচষ্যসহ বর্ণাঢ্য তৈজসপত্রে’। দারুণ বৈচিত্র্য ছিল বিষয়টিতে। মনে হতো একদিকে প্রজা; আরেকদিকে রাজা। টাঙ্গাইলের জমিদার নন্দিনী নিজের অবস্থানে সম্ভবত টইটুম্বুর ছিলেন। আর মাগুরার মহীউদ্দীন আহমদ ছিলেন নিজের ঐতিহ্যিক মুসলিম পরিবারের অবস্থানে। অর্থাৎ কৃচ্ছ্র ছিল দারুণভাবে। এভাবে তিনি প্রায় একই রঙের জামা-প্যান্ট-জুতা নিয়ে সারা জীবন কাটিয়েছেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তার জুতা ছিল ফিতে লাগানো- এক্সিকিউটিভ স্যু।
এখন আমরা সোনার বাংলায় দ্বিতীয় পর্বে আসি। এই পর্বটা শুরু হয় ১৯৭২ সালের ঠিক রমজান মাসের সময় অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর।
আমি তখন কিছুটা অবসর। তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের যে দফতরে চাকরি করতাম, তা তখন ‘ডিফাংক্ট’Ñ অবলুপ্ত। সরকারি নির্দেশে হাটখোলার বইয়ের গুদামে বসতাম আমরা দুজন- আমি ও লেখক আবু জাফর মো. ইকবাল (পরবর্তী সময় তিনি অ্যাডিশনাল সেক্রেটারির পদমর্যাদায় প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন)। আমাদের সাথে কয়েকজন সহকারী ছিলেন। তাদের কিছু কাজ থাকলেও আমাদের দুজনের তেমন কোনো কাজ ছিল না।
আমি কিছুটা অস্থির প্রকৃতির মানুষ। জাফর সাহেব লেখাপড়া করতেন আর আমি ছটফট করতাম কিছু একটা করার জন্য। আমাদের পারিবারিক যে প্রিন্টিং প্রেস ছিল, যার নাম ছিল ‘বর্ণলিপি মুদ্রায়ন’- তা তখন বলতে গেলে আর নেই। লুটপাট হয়ে গেছে। তখন ছোট চাচা ও এক ফুপাতো ভাইসহ বসবাস করি নারিন্দার শরৎ গুপ্ত রোডে। হোল্ডিং নাম্বার ছিল ২০। নারিন্দা পীরসাহেবের মসজিদের পাশে। হঠাৎ একদিন মনে হলো, মহীউদ্দীন সাহেবকে বলি তার ‘সোনার বাংলা’টা পুনঃপ্রকাশ করতে।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় মহীউদ্দীন সাহেবের আস্তানায় আমাদের আড্ডা হতো। রাজনীতিবিদ টাঙ্গাইলের নবাব সাহেব, শর্শিনার মাওলানা আব্দুল মতিনÑ আরো অনেকে আসতেন। বিভিন্ন মতের মানুষ। মহীউদ্দীন আহমদ সাহেব তখন বিব্রত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। দেড় দিন তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময় তাকে পাওয়া গিয়েছিল তখনকার ইকবাল হলে (শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)।
কালের এমন একটি সন্ধিক্ষণে একদিন একা পেয়ে মহীউদ্দীন সাহেবকে বললাম, আসুন আমরা এখন দেশ গড়ার জন্য ‘সোনার বাংলা’টা প্রকাশ করি।’ কথাটা শুনে উনি লাফ দিয়ে উঠলেন। বললেন, ‘সোনার বাংলার শুরুটা’ তো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে।’ আমার হাতে তিনি হাত মেলালেন। বললেন, ‘সব আপনি করবেন। আমি আপনার পেছনে চীনের প্রাচীরের মতো অবস্থান করব।’
পরদিনেই গ্যারাজ ও নিচতলার বাইন্ডিং খানার পাশে ছোট্ট একটা টেবিল-চেয়ার নিয়ে ‘সোনার বাংলা’র কাজ শুরু হয়ে গেল। আমি একা, আমার সাথে আর কেউ নেই। মহীউদ্দীন আহমদ সাহেব নিউজ প্রিন্টের প্যাড, লাল-কালো পেন, পেন্সিল, ব্লেড, কাঁচি, আঠা, স্কেল এবং কিছু পুরনো পত্রিকা ও বই আমার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, ‘আবুল মনসুর আহমদের কাছে যান। তিনি হবেন এখন আমাদের প্রধান উপদেষ্টা। আমি আপনার কথা তাকে অলরেডি বলে দিয়েছি। সবকিছু মনে নেই, কয়েক সংখ্যা বের করার পর কপিগুলো নিয়ে বরেণ্য সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের সাত মসজিদ রোডের ঐতিহাসিক ঈদগাহ ময়দানের পাশে তার লাল বাড়িটায় প্রথম যেদিন গিয়েছিলাম, সেদিন তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। বলেছিলেন, তোমার নামটা ভুল আছে। তোমার নাম হবে, মহবুব-উল-হক। জান, আমার মেজো ছেলের নাম মাহবুব আনাম। আজ সে বাসায় নেই, থাকলে তোমার লগে পরিচয় করায় দিতাম। কিন্তু তুমি তো এতো ছোট, আর সে তো বয়সে অনেক বড়। তোমাদের মিতালী কেমন করে হবে? আমি তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেছিলাম। তিনি বললেন, না, তুমি আমারে ‘স্যার’ বলবা না। আমারে চাচা মিয়া বা চাচাজান বলবা।
সে থেকে ১৯৭৯ সালের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন সাপ্তাহিক সোনার বাংলার প্রধান উপদেষ্টা।
মাঝে সাপ্তাহিক জাহানে নাও পত্রিকার সম্পাদক হাফেজ হাবিবুর রহমানের সৌজন্যে আর একজন উপদেষ্টা আমরা পেয়েছিলাম, তিনি হলেন জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ। সোনার বাংলার যে কপিটি কবির কাছে আমরা প্রথম নিয়ে গিয়েছিলাম, যতদূর মনে পড়ে দুই ইঞ্চি কাঠের হেডিংয়ে লেখা ছিল ‘ফরিদ আহমদ আরাকানে।’ হেডিং দেখে তিনি মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললেন। আরো বললেন, ঠিক জায়গায় গেছেন। ওটাই ছিল একসময় মুসলিম বাংলার রাজধানী। কত আগে সেখানে মুসলিম সভ্যতার কত কাজ হয়েছে। কত তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন আরাকানে এসে বসতি স্থাপন করেছে। আরবের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে। এখানকার বড় বড় নারিকেল, আরবের তৃষিত মানুষের হৃদয় ও মনকে স্পর্শ করেছে। এর সন্নিকটেই তো ইসলামাবাদ (চাটগাঁ বা চট্টগ্রাম)-কে তিনি ‘ইসলামাবাদ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। আলাওলের ‘পদ্মাবতী’সহ কাব্য সাহিত্যের অনেক কথাই বলেছিলেন এবং এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, আবার এখানে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হবে।
পাকিস্তান আমলে তার কাছে কয়েকবার গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ আমলেও ‘সোনার বাংলা’র কারণে হাফেজ হাবিবুর রহমান ও অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমানের সাথে আরো কয়েকবার তার কাছে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
সেসব স্মৃতি এখন থাক। অন্য স্থানে সেসব কিছু কথা তো অনেকবার বলেছি। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। সুতরাং আবুল মনসুর আহমদের মতো তার উপদেশ ও পরামর্শ খুব বেশি একটা পাওয়ার সুযোগ আমরা পাইনি।
‘সোনার বাংলার’ দ্বিতীয় মুদ্দত বা পর্বের আরো কিছু কথা আছে। পত্রিকা প্রকাশের সম্ভবত মাসখানেক পর সহযোগী হিসেবে পেলাম সাংবাদিক মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে। আমার হাতটা একটু শক্তিশালী হলো। এর পরপর অর্থাৎ ৭২ সালের মধ্যে একে একে পেলাম সাংবাদিক আলতাফ হোসেন, হাফেজ হাবিবুর রহমান, কাজী শামসুল হক, আব্দুল কাদের মিয়া, বগুড়ার আবদুল আজিজ, চট্টগ্রামের আহমদ ইয়াহিয়া খালেদ, এ কে এম হানিফ, আবুল হোসেন মাহমুদ, সানাউল্লাহ আখুন্জীসহ আরো অনেকে। সবার নাম এখন আর মনে পড়ছে না। তবে পাশে থেকে উৎসাহ জোগাতেন এবং নানাভাবে সহযোগিতা করতেন এম এ হান্নান, মহাজাতক শহীদ আল বুখারী, মোহাম্মদ মুসাসহ আরো অনেকে।
সোনার বাংলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এখানে আমরা সবাই পরিপূর্ণভাবে স্বাধীনতা ভোগ করেছি। প্রকাশক ও স্বত্বাধিকারী মহীউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকতার স্বাধীনতায় কোনোদিন হস্তক্ষেপ করেননি। এমনকি সাংবাদিক ও আনুষঙ্গিক স্টাফ নিয়োগেও তিনি কোনো মতামত প্রকাশ করতেন না। কার পদ-পদবী, বেতন ভাতা কী হবে- এসবেও তিনি নাক গলাতেন না। আমরা নিজেরাই সব ঠিকঠাক করে নিতাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মীয় বই ও সংবাদপত্রের জন্য নিউজপ্রিন্ট কম দামে বিক্রি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশ বা প্রজ্ঞাপন যথাযথভাবে পালিত হয়েছিল। ‘সোনার বাংলা’ কম দামে প্রতি মাসে ১৫ টন নিউজপ্রিন্ট গ্রহণ করার অনুমোদন পেয়েছিল। সে সময়ের জন্য এটা কম কথা ছিল না।
ধীরে ধীরে দেশবাসীর মতো আমরাও সরকারবিরোধী হয়ে গেলাম। আমরা ব্ল্যাকলিস্ট হয়ে গেলাম। আমাদের কাগজের কোটা ও বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে গেল।
এ সময় মহীউদ্দীন আহমদ সাহেব সোনার বাংলার জন্য দুটি খুব উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেন। প্রথমটি হলোÑ প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে ‘সোনার বাংলার’ সাথে সম্পৃক্ত করলেন। দ্বিতীয়ত, সারা দেশে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি স্কুল-কলেজ-মাদরাসা ও ইউনিয়ন পরিষদে ‘সোনার বাংলার’ গ্রাহক হওয়ার জন্য আবেদনপত্রসহ মানি অর্ডার ফরম পাঠালেন। এটা ছিল একটা অভিনব ব্যবস্থা। আল্লাহর রহমতে বেশ কাজ হলো। কারণ মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। তখনো সব এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে সংবাদপত্র পৌঁছেনি। আর পত্রিকার মূল্যও ছিল নামকাওয়াস্তে।
সাংবাদিক আলতাফ হোসেন ছিলেন ‘সোনার বাংলা’র সার্কুলেশন ম্যানেজার। বাংলাবাজারে অবস্থিত সদরঘাট পোস্ট অফিসে তিনি প্রতিদিন গিয়ে ‘মানি অর্ডারে’র টাকা তুলতেন। বেশ টাকা আসতো।
আবদুল গাফফার চৌধুরী আমাদের পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। তার বাসাও ছিল নারিন্দায়। আমাদের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। মহীউদ্দীন আহমদ সাহেব তাকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুসহ সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ ‘সোনার বাংলা’র ওপর থেকে ব্ল্যাকলিস্ট তুলে নেবে, এ আশায়। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। ইত্যবসরে তার সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ প্রকাশিত হলো। একই সাথে তিনি দুটি সাপ্তাহিক দেখাশুনা করতেন। এর কিছুদিন পর খান আব্দুস সবুর খানের পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় (জনারণ্যে আলোচিত) ‘দৈনিক জনপদ’ আব্দুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো। তিনি আমাকেও সেখানে সহকারী সম্পাদক পদে নিযুক্তি দিয়েছিলেন। আমি যেতে পারিনি। আমার পরিবর্তে আমার বন্ধু হাফেজ মাওলানা আকরম ফারুককে সেখানে দিয়েছিলাম। এ সময় বাধ্য হয়ে তিনি ‘সোনার বাংলা’ ছেড়ে চলে যান।
নিউজপ্রিন্টের অভাবে ‘সোনার বাংলার’ কাটতি কিছুটা কমে গিয়েছিল। বেশি দাম দিয়ে নিউজপ্রিন্ট কেনার সাধ্য ‘সোনার বাংলার’ ছিল না। এ ধরনের একটা পরিস্থিতিতে মহীউদ্দীন আহমদ সাহেব আমাকে বললেন, ‘মাহবুব সাহেব কাগজটি তো আপনি চালিয়ে আসছেন। এবার আর্থিকসহ সব দায়দায়িত্ব নিয়ে নিন।’
আমি অপারগতা প্রকাশ করলাম। তবুও তিনি জোর করে আমাদের বড় ভাই ওয়াহিদুর রহমানের নামে প্রকাশকের ডিক্লারেশন নেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন।
আমাদের সিনিয়র বন্ধু ডাইজেস্ট পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক ও ব্যাংকার আব্দুর রশিদ চৌধুরীর সহযোগিতায় পূবালী ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় ‘সোনার বাংলা’র নতুন ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়েছিল।
দেশব্যাপী ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহক এবং হকারদের সহযোগিতায় ‘সোনার বাংলা’ চলছিল। আমরা উপলব্ধি করেছিলাম ব্যবসায়িক প্রয়োজনে পত্রিকা হস্তান্তর করার প্রক্রিয়াটি তিনি সম্পন্ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমি বা আমাদের বড় ভাই এসবে মোটেই রাজি ছিলাম না। কারণ আমাদের অর্থ-বিত্ত ছিল না। তাছাড়া আমি ছিলাম সরকারি চাকুরে।
তখনো সরকারি চাকরি ছাড়ার কোনো চিন্তা আমি করতে পারেনি। যদিও মহীউদ্দীন আহমদ সাহেব চাকরি ছেড়ে ব্যবসায়ী হওয়ার জন্য আমাকে বরাবর উৎসাহ জোগাতেন।
এর পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় শাসন প্রবর্তন করে বসলেন। মাত্র ৪টি সংবাদপত্র ছাড়া সকল সংবাদপত্র বন্ধ ঘোষণা করলেন। একদিকে ‘সোনার বাংলা’র কাছে গ্রাহকদের অনেক পাওনা ছিল। অপরদিকে হকারদের কাছে ‘সোনার বাংলা’র অনেক পাওনা ছিল। বিষয়টি আমরা কোনো না কোনোভাবে সামলানোর চেষ্টা করতাম।
১৯৭৫ সালের সম্ভবত শেষ দিকে ‘বাকশাল’ বাতিল হওয়ার পর পুনরায় ‘সোনার বাংলা’ শুরু করা হয়। আবারও পূর্বের মতো মহীউদ্দীন আহমদ ও আমরা সংবাদপত্রটি প্রকাশের উদ্যোগ আয়োজন করি। কিন্তু পূর্বের উৎসাহ-উদ্যম আর সেভাবে বজায় থাকেনি। সাংবাদিক বন্ধুরা প্রায় সবাই পুরাতন ও নতুন দৈনিক সংবাদপত্রে নিয়োজিত হয়ে যান।
বাংলাদেশে ‘সাপ্তাহিক পত্রিকা’র চেয়ে ‘দৈনিক পত্রিকা’র গুরুত্ব সবসময় বেশি ছিল। ‘সোনার বাংলাকে’ আমরা যদি দৈনিক সংবাদপত্রে রূপান্তরিত করতে পারতাম, তাহলে হয়তো বন্ধুরা ‘সোনার বাংলা’ ছেড়ে চলে যেতেন না। ১৯৭৬-৭৯ সাল পর্যন্ত পুরনো সংবাদপত্র ছাড়াও নতুন নতুন অনেক দৈনিক পত্রিকার জন্ম হয়। ওই সময়টা ছিল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের জন্য একটা স্বর্ণযুগ। বাকশালের পূর্বে ‘হক কথা’সহ যেসব সাপ্তাহিক পত্রিকা, দৈনিক পত্রিকার বিকল্প হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, বাকশাল-পরবর্তী সময় সেসব আর পূর্বের মতো উচ্চকিত হতে পারেনি।
এ সময় ‘সোনার বাংলা’কে বিপুলভাবে সহযোগিতা করেছেন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা ও রাজনীতিবিদ অধ্যাপক ফজলে আজিম। ‘৭৯ সাল পর্যন্ত এ পত্রিকার সাথে তিনি সংযুক্ত ছিলেন। তার উদ্যোগে ও পরামর্শে ১৯৮০ সালে ‘সোনার বাংলাকে’ প্রখ্যাত ছাত্রনেতা ও রাজনীতিবিদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের হাতে উন্নয়ন ও বিকশিত করার জন্য অর্পণ করা হয়।