রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ৫ম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ॥ ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী ॥ ২৬ এপ্রিল ২০২৪

কারিগরির সার্টিফিকেটে কারিগরি কারসাজি
॥ সামছুল আরেফীন॥
সনদ জালিয়াতির অভিযোগে স্ত্রী গ্রেফতারের পর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এখন গোয়েন্দা হেফাজতে। মূলহোতা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামানকে গ্রেফতারের পর একে একে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত ৩০ জনের নাম বেরিয়ে এসেছে। এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যানের স্ত্রীসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ২৩ এপ্রিল মঙ্গলবার বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খানকে তলব করা হয় ডিবিতে।
শুধু কারিগরি বোর্ডেই নয়, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পর্যবেক্ষণে শিক্ষা খাতে ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত এ দুর্নীতির বিস্তার। মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণির কর্মকর্তা অর্পিত ক্ষমতাবলে নথি নিষ্পত্তি না করে দুর্নীতির পথ সৃষ্টি করেন। প্রকল্পের গাড়ি অবৈধভাবে ব্যবহারের মাধ্যমেও হচ্ছে দুর্নীতি। এছাড়া পূর্ত কাজে দরপত্র থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ে আছে অনিয়ম। পাঠ্যবই মুদ্রণের আগেই প্রকাশকদের কাছে ফাঁস করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের প্রবণতা আছে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং প্রশ্নপত্র জালিয়াতি, কোচিং, অবৈধ বই ও গাইড বাণিজ্য তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে শিক্ষায় অন্তত ১২টি খাত ও কাজের দিক চরম দুর্নীতিপ্রবণ।
সরাসরি এসব ক্ষেত্রের দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন অভিভাবক, শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ব্যয় বাড়ছে। বিঘ্নিত হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষাকার্যক্রম। শিক্ষার মানে নেমেছে ধস। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভাব-মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। সরকারের বিভিন্ন ধরনের ব্যয়ও বাড়ছে। দুদকের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে এ চিত্র। এসব তথ্য উল্লেখ করে সংস্থাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন ও সুপারিশ পাঠিয়েছিল।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে শিক্ষা খাতের সার্বিক যে চিত্র উঠে এসেছিল, তা এককথায় ভয়াবহ। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, সর্বত্র দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা জেঁকে বসেছে। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় এমপিওভুক্তি, নিয়োগ, বদলি, পাঠদানের অনুমতিসহ বিভিন্ন কাজে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত (ঘুষ) অর্থ দিতে হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ও এর অধীন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির (মাসে বেতন বাবদ সরকারি টাকা) কাজে চার স্থানে ‘হাদিয়া বা সম্মানী’ দিতে হয়। এ কাজে পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূতভাবে দিতে হয়।
সম্প্রতি কারিগরি বোর্ডে ভয়াবহ জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ায় শিক্ষা খাতে দুর্নীতি আবারো সামনে এসেছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামানের সিন্ডিকেট পাঁচ হাজারের বেশি সনদ বিক্রি করেছে। দালালসহ দুই থেকে তিন হাত ঘুরে এসব সনদ গেছে মূল ক্রেতার হাতে। ঢাকা ও নরসিংদীর কিছু দালাল এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরকারি-বেসরকারি কারিগরি স্কুল, কলেজ, পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, সার্ভে ইনস্টিটিউটের পরিচালক-প্রিন্সিপালদের মাধ্যমে এসব সনদ বিক্রি করত চক্রটি, যা ছিল ওপেন সিক্রেট। একেএম শামসুজ্জামান ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকায় এসব সনদ বিক্রি করলেও ক্রেতা পর্যায়ে দাম পড়েছে ন্যূনতম ২ লাখ টাকা। ফলে ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০০ কোটি টাকার সনদ বাণিজ্য হয়েছে। শামসুজ্জামানের এ সনদ বাণিজ্যে জড়িত কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এতে রয়েছে পরিদর্শক, কম্পিউটার অপারেটর, সিস্টেম অ্যানালিস্ট শাখার কর্মকর্তারা।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ বাণিজ্যের অভিযোগে গত ১ এপ্রিল রাজধানীর মধ্য পীরেরবাগ থেকে প্রথমে শামসুজ্জামান ও তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সালকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যে কুষ্টিয়ার গড়াই সার্ভে ইনস্টিটিউটের সানজিদা আক্তার ওরফে কলির নাম বেরিয়ে এলে ৫ এপ্রিল তাকেও গ্রেফতার করা হয়। তিনজনের জবানবন্দি ও তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ডিভাইস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত হিলফুল ফুজুল টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ সরদার গোলাম মোস্তফা ওরফে মোস্তাফিজুর রহমানকে গত ১৮ এপ্রিল মিরপুর থেকে এবং ঢাকা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের (মেডিকেল) পরিচালক মাকসুদুর রহমান ওরফে মামুনকে ১৯ এপ্রিল শুক্রবার যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ গত ২০ এপ্রিল শনিবার গ্রেফতার করা হয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যানের স্ত্রী সেহেলা পারভীনকে। গত ২১ এপ্রিল রোববার সেহেলাকে ঢাকার আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন ডিবির পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম। শুনানি শেষে আদালত দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
২১ এপ্রিল কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খানকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরে সংযুক্ত করা হয়। একই দিনে অন্য একটি প্রজ্ঞাপনে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আইসিটি পরিচালক অধ্যাপক মো. মামুন উল হককে বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার কথা জানানো হয়। ২৩ এপ্রিল মঙ্গলবার প্রায় ৩ ঘণ্টা মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খানকে। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, সার্টিফিকেট বাণিজ্যে সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খানকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি। তাকে দুদিন নজরদারিতে রাখা হবে। এর মধ্যে বুয়েটের স্পেশালিস্ট এসে দেখবে, তারা এখন পর্যন্ত কতগুলো সার্টিফিকেট বিক্রি করেছে।
কারিগরি বোর্ডের জালিয়াতির বিষয়ে ডিএমপির গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামান ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকায় সনদ বিক্রি করতেন। তবে গ্রাহক পর্যায়ে ন্যূনতম দুই লাখ টাকায় এসব সনদ বিক্রি হতো। এ চক্রে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। যেসব প্রধান শিক্ষক ও প্রিন্সিপাল মধ্যস্থতা করে গ্রাহক নিয়ে আসতেন, তাদের নামের দীর্ঘ তালিকা এসেছে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। এছাড়া সনদ বাণিজ্যের বিষয়ে জানতেন বোর্ডের ছোট-বড় সব কর্তাই। পর্যায়ক্রমে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
এ ঘটনায় দুদক সচিব গত ২২ এপ্রিল সোমবার সাংবাদিকদের জানান, একেএম শামসুজ্জামানকে যে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সেটি পুনরায় সচল করে তদন্ত করা হবে। বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা হয়েছে বলেও তিনি জানান। এছাড়া সনদ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধান শুরু করবে দুদক।
এদিকে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত শামসুজ্জামান জানান, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদের কাগজ প্রতি বান্ডিলে ৫০০টি করে থাকে। বান্ডিল করা এসব কাগজ শামসুজ্জামান শিক্ষা বোর্ডের অফিস থেকে সংগ্রহ করতেন। তবে তার কাছে জাল সার্টিফিকেট তৈরির এত চাহিদা থাকত যে বোর্ড অফিসের কাগজ পর্যাপ্ত হতো না। কাগজের জোগান ঠিক রাখতে রাজধানীর পুরান ঢাকা ও রংপুরের একটি প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদেরকে আসলে কাগজের নমুনা দেখানোর পর তারা হুবহু সার্টিফিকেটের কাগজ তৈরি করে দিতেন শামসুজ্জামানকে।
শামসুজ্জামান প্রতিদিন অফিস শেষ করে বাসায় গিয়ে এসব কাগজ দিয়ে জাল সার্টিফিকেট তৈরি করতেন। সার্টিফিকেট প্রিন্ট করার কাজ করতেন তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সাল। রাজধানীর পীরেরবাগ এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল সার্টিফিকেট প্রিন্ট করার জন্য। সেখানে এসব জাল সার্টিফিকেট প্রিন্ট করতেন ফয়সাল। তারপর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে গিয়ে এসব জাল সার্টিফিকেট আপলোড করে দিতেন শামসুজ্জামান। আপলোড করার পর এসব সার্টিফিকেট বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে ভেরিফাই করা যেত।
জানা যায়, শিক্ষার্থীরা প্রথমে দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। দালালরা শমসুজ্জামানের সঙ্গে  যোগাযোগ করত। সনদ প্রতি ৩০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিতেন শামসুজ্জামান। এ ব্যাপারে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকরাও যোগাযোগ করতেন তার সঙ্গে। পরিচালকরা সার্টিফিকেট প্রতি ৩০-৫০ হাজার টাকা দিতেন। তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আরও  মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন। প্রায় ৩০ জনের মতো দালাল ও প্রতিষ্ঠান পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে শামসুজ্জামানের। নরসিংদী, ময়মনসিংহ, খুলনা, দিনাজপুর, গাজীপুর, ঢাকা ও কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার দালাল ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা তার কাছ থেকে সার্টিফিকেট বানিয়ে নিতেন।



এ পাতার অন্যান্য খবর

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।